বিমানবন্দরে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কেউ না কেউ ধরা পড়লেও নিত্যনতুন কৌশলে দেশে আসছে স্বর্ণের চালান। মূলত হযরত শাহজালাল, শাহ আমানত এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ব্যবহার করে এক শ্রেণির চোরাকারবারি তাদের চোরাচালান অব্যাহত রেখেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি স্বর্ণ চোরাচালানের নানা কৌশল চোখে পড়েছে। তবে চোরাকারবারিদের এ তৎপরতা রুখে দিতে কাস্টমস, কাস্টমস গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের উপ-কমিশনার (প্রিভেনটিভ) ইফতেখায়েরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে কাস্টমস হাউজ আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি ব্লেন্ডার, চার্জার লাইট, হুইল চেয়ারে বিশেষ কায়দায় আনা-সহ নানা কৌশলে দুই বা তিন কেজির চালান আনার ঘটনা ঘটছে। আমরা সেগুলো ধরেও ফেলছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চোরাকারবারিরা নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করলেও আমাদের নজর এড়ানো তাদের জন্য কঠিন।’
বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েত থেকে আসা জাজিরা এয়ারলাইন্সের যাত্রী সজিবের গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে তল্লাশি শুরু করেন কাস্টমসের কর্মকর্তারা। প্রাথমিকভাবে তার লাগেজসহ শরীরে স্বর্ণের কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে তার আনা একটি চার্জার লাইটের ওজন দেখে সন্দেহ হয় কর্মকর্তাদের। এক পর্যায়ে সেই চার্জার লাইটের ভেতরে সু-কৌশলে আনা ২ কেজি ১০০ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া যায়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবে ওমরা পালন শেষে হাবিবুর রহমান নামের এক যাত্রী দেশে ফেরেন। তার বেশভূষা দেখে যে কেউই তাকে সন্দেহের বাইরেই রাখবেন। তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে তার কাছেও কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে তার আনা একটি ব্লেন্ডার মেশিনের ভেতরে লুকানো অবস্থায় ৩ কেজিরও বেশি ওজনের স্বর্ণ পাওয়া যায়।
এদিকে চলতি মাসে সবচেয়ে বড় স্বর্ণের চালান জব্দ হয়েছে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর থেকে। সেখানে কৌশলে ফ্যানের ভেতরে করে আনা ১৭ কেজির স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ সময় দুই যাত্রীর আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় তাদের লাগেজ তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিতে তাদের লাগেজের ভেতর ফ্যানের মধ্যে কৌশলে রাখা ১২০টি স্বর্ণের বার ও চারটি গোলাকার স্বর্ণপিণ্ড উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় সাড়ে ১৭ কেজি। এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতারও করা হয়।
গত ৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া থেকে আসা কাছ থেকে পাঁচ যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় ৭ কেজি সোনা জব্দ করেছে ঢাকা কাস্টমস হাউজের একটি দল। এ সব সোনার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়াও ২৭ ডিসেম্বর শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের ভেতরের স্পর্শকাতর স্থান থেকে ২০টি স্বর্ণের বার জব্দের পাশাপাশি ওই ফ্লাইটটিকেও জব্দ করলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এমনকি গত শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্লাইটের সিটের নিচে লুকানো আটটি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, চোরাকারবারিরা বড় চালানে সুবিধা করতে পারবে না জেনেই এখন ছোট ছোট চালান আনার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে তারা নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করছে। কিন্তু আমাদের নজরদারি তারা এড়াতে পারছে না। তারা যে কৌশলই ব্যবহার করুক, কাস্টমস হল পার হওয়া অসম্ভব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অন্তত অর্ধশতাধিক কৌশল ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা স্বর্ণপাচার করে থাকে। কখনও ফ্লাইটের কেবিন ক্রু, বিমান বালা, পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার, ট্রলি ম্যান, ক্লিনারকে ব্যবহার করেছে। আবার কখনও যাত্রীবেশী বাহক দিয়ে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মোটর, দেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির ওপরের হ্যান্ডেল, মানিব্যাগে করে স্বর্ণপাচারের ঘটনা ঘটছে। এমনও রয়েছে স্বর্ণের ওপর কালো অথবা সিলভারের প্রলেপ দিয়েও পাচারের চেষ্টা করা হয়েছে।
এছাড়াও রোগী সেজে হুইল চেয়ার, থাই অ্যাংলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমর বন্ধনী, শার্টের কলার, স্যান্ডেল, সাবান কেস, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপ্টার, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কোটা, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতর, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতর, মানিব্যাগের ভেতর ও গলায় স্বর্ণের একটি চেইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে লকেট হিসেবে বার আনা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিনহাজ উদ্দীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে চোরাকারবারিরা নানা কৌশল অবলম্বন করে এবং করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের নজরদারি ঠিকমতো না থাকলে, তারা ঠিকই বের হয়ে যাবে। আমাদের সঠিক নজরদারির ফলে তারা ধরা পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক গোয়েন্দা তীক্ষ্ণ নজরদারি রাখছে, যাতে কোনও চোরাইপণ্য দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে।’