ঈদ মানেই পরিবার, আনন্দ আর উৎসবের সময়। কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা নিজেদের শখ, আবেগ ও স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের একজন পুলিশ কনস্টেবল মো. জাহাঙ্গীর আলম।
“আমি পুলিশ, আমারও শখ আছে। কিন্তু জননিরাপত্তাই আমার প্রধান কাজ। শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েই এই পোশাক পরেছি। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঈদ করি। কিন্তু উপায় নেই। গত ১৫ বছর ধরে ঈদের দিন পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারিনি। পরিবারও বিষয়টি মেনে নিয়েছে।"
ঈদের দিন (৩১ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ থানার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল মো. জাহাঙ্গীর আলম।
ঈদ মানেই দায়িত্বের ডাক
যখন সবাই পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ি ফেরে, তখন নগরীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। জনসাধারণ যেন নির্বিঘ্নে ঈদ উদযাপন করতে পারেন, সে জন্য নিজেদের ঈদের আনন্দ উৎসর্গ করেন তারা।
কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের ছুটি দিলে শৃঙ্খলা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। আমাদের মানসিকতা সেভাবেই তৈরি করতে হয়। ঈদে বাড়ি যেতে মন চায়, কিন্তু দায়িত্বের কাছে সেই ইচ্ছা ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। থানার সহকর্মীরাই তখন পরিবার হয়ে ওঠেন। এই পোশাকের মধ্যেই আমাদের সুখ, দুঃখ, হাসি, বেদনা।”
গত ১৫ বছরের চাকরিজীবনে মাত্র একবার পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার সুযোগ পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। সেটাও ৭-৮ বছর আগে। এরপর প্রতিটি ঈদই কেটেছে দায়িত্ব পালন করে।
সড়কে দায়িত্ব, সেমাইও জোটেনি
ঈদের দিনে যখন সবাই ঈদগাহে যায়, তখন রাজধানীর ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন যানবাহন নিয়ন্ত্রণে। বিজয় সরণি সিগন্যালে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মো. সেলিম আহমেদ। সকাল ৬টা থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
“অন্যান্য বছর সকালে সেমাই, মিষ্টিসহ নাশতা পাঠানো হতো। এবার কিছুই আসেনি। সকাল থেকে এক বোতল পানিও জোটেনি,” আক্ষেপের সুরে বললেন তিনি।
সেলিম জানান, ঈদের নামাজের পর সহকর্মীদের সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন। কিন্তু পরিবার থেকে দূরে থাকার কষ্টটা রয়েই গেছে। “সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হয়েছে। তবে এটাই আমাদের জীবন। মানুষের সেবা করাই আমাদের কাজ।”
প্রথম ঈদ, অভ্যাসে পরিণত হবে হয়তো
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট রায়হান চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর এবারই প্রথম পরিবারের বাইরে ঈদ করছেন।
“পরিবার থেকে বারবার ফোন আসছে। বুঝিয়েছি, ঈদে ছুটি নেই। সবাই যদি ছুটিতে যায়, তাহলে তো সমস্যা। প্রফেশনে ঢুকেছি, তাই ইমোশনের জায়গা নেই। জনগণের সেবা করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”
আরেক সার্জেন্ট শফিক আহমেদ বলেন, “আমার তিন সন্তান, তারা জানে না যে ঈদে তাদের সঙ্গে থাকবো না। সকালে ফোনে কথা হলো, বললাম ঘুম থেকে উঠলে বাবাকে দেখতে পারবে। তারা এখন ছোট, বড় হলে বুঝবে, বাবা একজন পুলিশ সদস্য, যিনি চাইলেও পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারেন না।”
‘এই ত্যাগই আমাদের আনন্দ দেয়’
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোবারক হোসেন বলেন, “জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের ঈদের আনন্দ। দায়িত্ব পালন করতে পারাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “ঈদে দায়িত্ব পালন করা দেশের জনগণের প্রতি আমাদের কমিটমেন্ট। এটাই আমাদের তৃপ্তি দেয়। এই ত্যাগই আমাদের আনন্দ।”
ঈদের দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রত্যেক সদস্য সরকারিভাবে নির্দিষ্ট বরাদ্দ পান। থানায় বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থাও থাকে।”
দায়িত্বের মধ্যেই আনন্দ
ঈদের সকালে বাবারা যখন নতুন পাঞ্জাবি পরে সন্তানদের নিয়ে ঈদগাহে যাচ্ছেন, তখন পুলিশের সদস্যরা ছুটছেন দায়িত্ব পালনে। তারা হয়তো পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারেন না, কিন্তু শহরের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের ঈদের আনন্দ।
এই পোশাকের মধ্যেই তাদের হাজারো কষ্ট, এই পোশাকের মধ্যেই হাজারো সুখ। তারা জানেন পরিবার ছাড়া ঈদ কাটানো কতটা কষ্টের। তাদের ভেতরে আবেগ-অনুভূতি থাকলেও যেন ক্লান্তির ছোঁয়া প্রকাশ করেন না তারা।