রাজধানীর নটর ডেম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ধ্রুবব্রত দাস (১৮) ও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাতের (১৮) মৃত্যু ঘিরে চলছে নানান জল্পনা-কল্পনা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনায় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে দুই পরিবারে। এ দুটি মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও অমীমাংসিতই থেকে গেছে ঘটনা। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ বলছে, দুটো মৃত্যুই দুর্ঘটনায়। তবে পরিবারের দাবি, তাদের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনও ঘটনা লুকিয়ে আছে।
গত ১২ মে (সোমবার) দুপুর সোয়া ৩টার দিকে নটর ডেম কলেজের ফাদার টিম ভবনের তৃতীয় তলা থেকে পড়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ধ্রুবব্রত দাসের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। একই দিন বিকাল সোয়া ৫টার দিকে কমলাপুরে একটি বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারা যান কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একই কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে সহপাঠী ও অভিভাবকদের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। একই সঙ্গে তাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নানান প্রশ্ন উঠছে। যদিও এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলাতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গত সোমবার (১২ মে) দুপুর তিনটার দিকে শিক্ষার্থী ধ্রুবব্রত কলেজ‑চত্বরে ‘ফাদার টিম’ ভবনের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হন। পরে সহপাঠীরা দ্রুত তাকে তুলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে গেলে বিকাল চারটার দিকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় তার পড়ে যাওয়ার কারণ স্পষ্ট নয়। দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা নাকি অন্য কিছু— কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহসহ শিক্ষার্থী‑শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তবু তদন্তে কোনও কুলকিনারা মিলছে না।
ঘটনার দিন দুপুরে ধ্রুবব্রত তার বাবা বানি ব্রতদাস চঞ্চলকে নিয়ে কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার টেস্টের রেজাল্ট আনতে যান। তবে বাবা বানি ব্রতদাসসহ অন্য অভিভাবকরা কলেজের গেটের বাইরে ছিলেন। ঘটনা সম্পর্কে বানি ব্রতদাস চঞ্চল বলেন, হঠাৎ দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে কলেজের অন্য শিক্ষার্থীরা ধ্রুবব্রতকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাইরে বের করে নিয়ে আসে। পরে আরেক অভিভাবকের গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত বলে জানান। আমি তখন কিছু বুঝতে পারিনি। ওইদিন রাতেই তার দাহ সম্পন্ন করা হয়। তখন আমরা কোনও অভিযোগ করিনি। তবে এখন আমাদের মধ্যে নানান প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে।
ছেলের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনও ঘটনা রয়েছে— অভিযোগ তুলে বানি ব্রতদাস চঞ্চল বলেন, আমরা জানতে চাই, আমাদের সন্তানের সঙ্গে কী হয়েছে। আমরা বিভিন্ন জনের মাধ্যমে জানতে পারি, কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই ভবনের ওপরে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে। তবে কারা নিয়ে গেছে, তার সঙ্গে কী হয়েছে— তা আর জানতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে সবসময় কলেজে পড়াশোনায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এ জন্য অনেক শিক্ষার্থী তাকে ইর্ষা করতো। সেদিন কলেজের নিচতলায় তাদের পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ করেছে হয়। তার সঙ্গে কোনও স্মার্ট ফোন ছিল না। তাহলে কেন সে ওই ভবনের ওপরে গিয়েছিল? সে কী আসলে পড়ে গিয়েছে নাকি তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে— এমন নানান প্রশ্ন আমাদের মধ্যে ঘুরছে। আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর চাই। আমরা জানতে চাই- আমাদের সন্তানের সঙ্গে সেদিন কী ঘটেছে?
পুলিশ বলছে, সেদিন শিক্ষার্থী ধ্রুবব্রত দাস নিহতের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও অভিযোগ না করায় পুলিশ একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে। শিক্ষার্থী ধ্রুবব্রত দাসের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সালেহ শাহিন। তিনি বলেন, ধ্রুবব্রত ভবনের তৃতীয় তলা থেকে নিচে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পায়। এতে তার মৃত্যু হয়েছে। মাথার বাম পাশে আঘাত পেয়েছে, বাম কান, বাম হাত, বাম চোয়ালে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
রবিবার (১৮ মে) বিকালে নটর ডেম কলেজ প্রাঙ্গণে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কলেজের ফাদার টিম ভবনটি উত্তর-পূর্বকোণে এল আকৃতির। ভবনের উপরে উঠা-নামার তিনটি সিঁড়ি ও দুটি গেট রয়েছে। তবে ভবনের দুই গেটে দুটি ও দ্বিতীয় তলায় কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। তবে দ্বিতীয় তলায় একটি ক্যামেরা ছাড়া সবগুলোই অচল। সেদিন (১২ মে) দুপুর সোয়া তিনটার দিকে ভবনের নিচতলায় রেজাল্ট কার্ড বিতরণের কার্যক্রম চলছিল। অন্য তলায় কোনও ক্লাস না চলায় কলেজের পরিচ্ছন্নকর্মীরা পরিষ্কারের কাজ করছিল। ধ্রুব তিনটা ২১ মিনিটে ভবনের উত্তর পাশের তৃতীয়তলা থেকে নিচে পড়ে যায়। ওই সময় ভবনের উত্তর পাশের দ্বিতীয়তলায় পরিষ্কারের কাজ করছিলেন কাজল দাশ, তিনিই প্রথম ধ্রুবকে নিচে পড়ে যেতে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠেন।
কাজল দাশ বলেন, সেদিন ভবনের নিচতলায় কিছু শিক্ষার্থী ছিল। এছাড়া অন্য কোনও তলায় কেউ ছিল না। আমি দ্বিতীয়তলা পরিষ্কারের কাজ করছিলাম। অন্যদিকে আমাদের আরেক স্টাফ পাঁচতলা পরিষ্কার করে সেই ফ্লোর তালা দিয়ে চারতলার বারান্দা পরিষ্কারের কাজ করছিলেন। তখন চারতলায় কেউ ছিল না। যার ফলে আমাদের ধারণা ধ্রুব তৃতীয়তলা থেকে পড়ে গেছে। কাজল আরও বলেন, তখন তৃতীয় তলায় আরও কিছু শিক্ষার্থী ছিল। তবে ধ্রুব পড়ে যাওয়ার পর সাবই এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করে ধ্রুবর দিকে চলে যায়। যার ফলে আরও কোন কোন শিক্ষার্থী ছিল— তা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ডা. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, ঘটনার সময়ে আমি কলেজ প্রাঙ্গণেই ছিলাম। হঠাৎ কিছু শিক্ষার্থী জানালো ধ্রুব ভবন থেকে পড়ে গেছে। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এসে বিভিন্ন কিছু বিশ্লেষণ করেছে। তাদের কাছে এটি দুর্ঘটনা বলে মনে হয়েছে। অধ্যক্ষ বলেন, ওই ভবনে আমাদের একটি সিসিটিভি ক্যামেরা সক্রিয় রয়েছে। সেই ক্যামেরায় ঘটনা সম্পর্কে তেমন কিছু দেখা যায়নি।
দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় এখনও তদন্ত চলছে জানিয়ে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবা উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনা দুটি দুর্ঘটনা বলে মনে হয়েছে। একটি আত্মহত্যা, অন্যটি ভবন থেকে পড়ে মৃত্যু। তবে এর পেছনে অন্যকোনও ঘটনা রয়েছে কিনা— তা তদন্তের পর জানা যাবে। এ দুটি ঘটনায় এখনও তদন্ত চলছে।
নিহত ধ্রুবব্রত দাসের বাবা বানি ব্রতদাস চঞ্চল পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার দুই ছেলের মধ্যে ধ্রুব বড়। ছোট ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পড়েন। তাদের গ্রামেরবাড়ি গাইবান্ধার সদর উপজেলার মধ্যপাড়া গ্রামে। পরিবার নিয়ে ঢাকায় গোপীবাগ এলাকায় থাকেন।
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাতের আত্মহত্যা নিয়ে নানান প্রশ্ন!
গত ১২ মে ধ্রুবর মৃত্যুর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর উত্তর কমলাপুরের জসিম উদ্দিন রোডে একটি ভাড়া ফ্লাটে নটর ডেমের আরেক শিক্ষার্থী আরাফাতের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পরে সন্ধ্যায় অন্য রুমমেটরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রুমটি ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় দরজা ভেঙে তাকে বের করতে হয়। সহপাঠীরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে মানসিক চাপে ছিলেন আরাফাত, তবে ঘটনার প্রকৃত কারণ জানাতে পারেননি কেউ।
এ ঘটনায় নিহত আরাফাতের বাবা আবদুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, আমি পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে থাকি। সেদিন বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে তার এক রুমমেট রিমন আমাকে ফোন করে জানান, আরাফাত দরজা খুলছে না। তাকে অনেক ডাকাডাকি করেও কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তখন বিষয়টি আমার কাছে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। আমি রিমনকে বলেছি, তুমি বাড়ির ম্যানেজারের কাছে যাও। তার (ম্যানেজার) কাছে এক্সট্রা চাবি আছে, তাকে সঙ্গে নিয়ে রুম খুলো। পরে সন্ধ্যায় তারা আমাকে জানিয়েছে আরাফাত গলায় ফাঁস দিয়েছে। আমি তখন দ্রুত ঢাকায় এসে রাত দুইটার দিকে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে আমার ছেলের লাশ দেখতে পাই। পরে তার মরদেহ নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি ভৈরবের কালিকা প্রসাদে নিয়ে দাফন করি।
আরাফাতের আত্মহত্যার বিষয়ে মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মহায়মেনুল ইসলাম বলেন, আরাফাতের রুম ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। রুমের দরজা ভেঙ্গে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে তার রুমমেটরা। তার হাতের লেখা কিছু চিরকুট পাওয়া গেছে। সেগুলোতে কিছুটা প্রেমঘটিত বিষয় রয়েছে। ফলে এটি আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। তবে বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
ছেলের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনও ঘটনা রয়েছে অভিযোগ তোলেন আবদুল্লাহ-আল-মামুন। তিনি বলেন, আমার ছেলের কিছুটা শারীরিক অসুস্থতা ছিল। তার মৃত্যুর আগেরদিন আমি ঢাকায় গিয়ে তাকে ডাক্তার দেখিয়েছি। পরদিন সোমবার বিকালে তার ডাক্তারের কাছে ফলোআপে যাওয়ার কথা ছিল। মামুন বলেন, সেদিন (১২ মে) আরাফাত দুপুরে কলেজ থেকে বাসায় ফেরে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। পরে বিকালে তার মা বাসায় ফেরার পর আবারও পরিবারের সবার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে আরাফাতের সঙ্গে আমাদের শেষ কথা হয়। তখন আরাফাত বললো, আমি একটু রেস্ট নিয়ে বিকালে ডাক্তারের কাছে যাবো। এরপর শুনি সে আত্মহত্যা করেছে। এটা কোনোভাবেই হতে পারে না।
নানান প্রশ্ন তুলে মামুন বলেন, পুলিশ যেসব চিরকুট পেয়েছে- সেসব আমার ছেলের হাতের লেখা না। তাছাড়া আমার ছেলের রুমের দরজা সবসময় বন্ধ থাকে। তার রুমমেটরা কখনও তার রুমে নক করে না। সেদিন কেন তার রুমমেটরা দরজা বন্ধ দেখে এত টেনশনে পড়েছে? এছাড়াও আরাফাত লম্বায় পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি। অথচ তার খাট থেকে ফ্যানের দূরত্ব প্রায় পৌনে পাঁচফিট। একটা মানুষ যখন আত্মহত্যা করে, গলায় ফাঁস নেয় তখন সে জীবন বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করে। তার হাত-পা অনেক নাড়াচাড়া করে। অথচ আরাফাতের খাটের সঙ্গে লাগানো কাপড় রাখার আলনার কিছু হয়নি। বিছানা, কাপড় সবকিছুই পরিপাটি ছিল। এটা কীভাবে সম্ভব!
বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, যখন ছেলে মারা যায়, তখন এত কিছু ভাবিনি। ছেলের শোকে কাতর ছিলাম। এখন ছেলের মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলাতে পারছি না। আমার ছেলে কীভাবে মারা গেছে, সে কি আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে— আমরা জানতে চাই। আমরা চাই, পুলিশ যাতে আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করে বের করে।
নিহত আরাফাতের বাবা মামুন ও মা ইশরাত জাহান চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত আছেন। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে আরাফাত বড় ছেলে। ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ভৈরবের কালিকা প্রসাদ।
এ দুটি ঘটনায় নটর ডেম কলেজ কর্তৃপক্ষ শোক প্রকাশ করে বলেছে, “দু’টি মর্মান্তিক মৃত্যুর পেছনের সত্য উদঘাটনে প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছি এবং নিহতদের পরিবারের পাশে আছি।”
দুই তরুণের আকস্মিক বিদায়ে সহপাঠী‑শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে শোক‑স্তব্ধতা নেমে এসেছে — আর প্রশ্ন রয়ে গেছে, ধ্রুব ও আরাফাতের সাথে সত্যিই কী ঘটেছিল? রহস্যের জট খুলতে সংশ্লিষ্ট সবাই এখন অপেক্ষায়।