সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব গ্রহণের পর মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন অপসারণে বেশ সক্রিয় হন। তিনি ঘোষণা দেন—এমন সব গাড়ি সড়ক থেকে সরিয়ে নিতে মালিকদের ছয় মাস সময় দেওয়া হবে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সেই সময়সীমা পার হলেও রাজধানীসহ সারা দেশের সড়কে এখনও হাজার হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ বাস ও ট্রাক অনায়াসে চলাচল করছে।
বিভিন্ন জরিপ অনুসারে, দেশে বর্তমানে ৭৫ হাজারের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ বাস ও ট্রাক রাস্তায় চলছে, যার বেশিরভাগ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সার্ভারে নিবন্ধিত নয়। আর এসব পরিবহন সড়ক দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এসব পুরনো, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন শুধু জননিরাপত্তা নয়, পরিবেশ দূষণেরও বড় উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিআরটিএ’র দেওয়া তথ্যমতে, শুধু ঢাকা মহানগর ও জেলার মধ্যেই ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস ও মিনিবাস রয়েছে ১০ হাজার ৫৫৬টি। পাশাপাশি ২৫ বছরের বেশি পুরনো পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৮৩টি। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও আরও প্রায় ৫০ হাজারের মতো পুরনো বাস ও ট্রাক নিয়মিত চলাচল করছে।
এদিকে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসাবে শহরতলিতে প্রায় ৫ হাজার বাস এবং কেবল ঢাকা শহরে আড়াই হাজার বাস চলাচল করে। অথচ গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল রাজধানীর অন্তত ১০ লাখ মানুষের জন্য এই সংখ্যা মোটেই যথেষ্ট নয় বলে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা মত দেন।
২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পুরনো মোটরযান অপসারণ’ শীর্ষক একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরনো ট্রাককে মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে তা অপসারণ করতে হবে।
সভায় পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ছয় মাসের মধ্যে এসব যানবাহনের চলাচল বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি প্রস্তাব করেন, নতুন গাড়ি কেনার জন্য পরিবহন মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।
কিন্তু সেই সময়সীমা শেষ হলেও বাস্তবে বড় ধরনের কোনও অভিযান শুরু হয়নি। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানান, আসন্ন ঈদুল আজহায় যাত্রীদের দুর্ভোগ এড়াতে অভিযান সীমিত রাখা হয়েছে। ঈদের পরে বড় পরিসরে কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো যান সরাতে হলে বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক পদ্ধতিতে ফিটনেস চেক করতে হবে। অন্যথায় জনদুর্ভোগ যেমন বাড়বে, ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়ে ফিটনেসবিহীন যান সড়কে চলবে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরাও চাই, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন পরিবহন সড়ক থেকে উঠে যাক। তবে বাস্তবতা হচ্ছে পুরনো বাস কম, বরং বেশি সংখ্যক মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রাক সড়কে রয়েছে।’
রাজধানীতে গণপরিবহনের সংকট দূর করতে সরকারি সহায়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এমনিতেই গণপরিবহনের সংখ্যা কম। তার ওপর যদি কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে গড়পড়তায় বাস অপসারণ করা হয়, তাহলে সংকট আরও বাড়বে। সরকার থেকে বলা হয়েছিল—বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তা দেওয়া হবে, কিন্তু এখনও সেরকম কোনও সার্কুলার আমরা পাই নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে বাস মালিকদের বলে রেখেছি—যারা পুরনো বাস উঠিয়ে নতুন বাস নামাতে চান, তারা যেন আমাদের মাধ্যমে আবেদন করেন। এছাড়া ট্রাক মালিকদেরও আমরা বলেছি—সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চালিয়ে নতুন গাড়ি নামায়। কিন্তু তার জন্য তো আমাদের আগে ঋণ ছাড় দিতে হবে।’
বিকল্প ব্যবস্থা দাঁড় না করিয়ে কোনও উদ্যোগই কাজে আসবে না বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের গণপরিবহন খাতের মূল সমস্যা কোনও প্রযুক্তিগত নয়, বরং এটি একটি গভীর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অনিয়মের চিত্র।’
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সরকার এ পর্যন্ত বারবার মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন বাস তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকরা সরকারকে আর গুরুত্ব দেন না। ফলে শুধু নির্দেশনা দিয়ে নয়—বাস্তব বিকল্প, পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এই উদ্যোগ সফল হবে না।’
ড. হাদিউজ্জামান স্পষ্ট করে বলেন, ‘ঢাকার পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অন্তত চার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে সরকারি মালিকানাধীন গণপরিবহন কোম্পানি গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে যেসব বাস অচল বা অনুপযোগী—সেগুলো কিনে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। এরপর, সাধারণ মালিকদের অংশীদার করে নতুন বাস চালাতে হবে। তবেই রাজনৈতিক প্রভাব, চাঁদাবাজি ও মালিকানাভিত্তিক সড়ক রাজনীতি বন্ধ হতে পারে।’