ব্রিটেনে বসবাসরত বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ বাঙালি প্রবাসী কোরবানি দেন দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে। সেদেশেই বিভিন্ন চ্যারেটি সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়ে কোরবানি সম্পন্ন করে থাকেন। অথচ একসময় প্রবাসীরা দেশেই কোরবানি দিতেন। কিন্তু গত দেড় দশকে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকায় কোরবানি দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সপরিবারে বিদেশে সেটেল প্রবাসীরা বিদেশেই কোরবানি দিচ্ছেন।
তবে ইসলামি চিন্তকদের অনেককে বলছেন, প্রবাসে কোরবানি দিলে দুস্থদের অংশের কোরবানির মাংস বিতরণ নিয়ে সংশয়ের সুযোগ রয়ে যায়।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসীদের একটি বড় অংশের কোরবানির টাকা যাচ্ছে বিভিন্ন চ্যারেটি সংস্থার মাধ্যমে। ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে সরাসরি চ্যারেটি সংস্থাগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা দিয়ে কোরবানির দায়িত্ব সম্পন্ন করছেন অনেকে।
যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি কমিউনিটির সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মানি ট্রান্সফার ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান শিবলু বলেন, বর্তমান সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে দেশে কোরবানি দেওয়ার ব্যাপারে সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশে বহু মানুষ কোরবানির সময়েই পেটভরে একবেলা গোস্ত দিতে ভাত খাবার আশায় থাকেন। দুস্থ মানু্ষেরা বছরে একবারই মাংসের আশায় থাকেন। ব্রিটেনের কমিউনিটি টিভি চ্যানেল এমনকি বাংলাদেশি কমিউনিটি টিভি চ্যানেলগুলো ও অনেক চ্যারেটিগুলোও বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে সোমালিয়া ইথিওপিয়ার মতো আফ্রিকার দেশগুলোতে কোরবানি দেওয়ার প্রচারণা চালাচ্ছে। এতে করে ক্রমেই প্রবাসীদের বিশেষ করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মে এসে বাংলাদেশে কোরবানি দেওয়ার হার দ্রত কমে আসছে। এতে করে দেশে নিজ নিজ এলাকার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এ ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান প্রবাসী আব্দুল মুমিন চৌধুরী বলেন, চ্যারেটির মাধ্যমে না দিয়ে দেশের নিজ এলাকা, গ্রামের মানুষের স্বজনদের হক আদায়ের কথা আমাদের চিন্তা করা উচিত।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের দারুস সুন্নাহ অ্যাকাডেমি ও মসজিদের খতিব মুফতি তাজুল ইসলাম বলেন, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিদের মধ্যে দেশে কোরবানি দেয়ার প্রবণতা কমেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের নতুন প্রজন্মের একটি বিশাল অংশ চ্যারেটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোরবানি দিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। কোরবাণির ফজিলত হচ্ছে নিজে আদায় করার মধ্যে। চ্যারেটি প্রতিষ্টাষ্ঠানের মাধ্যমে কোরবানি আদায়ে কোনও বাধা নাই। কোরবানি আদায় হওয়া ও কোরবানি নিজ হাতে দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। শুধু চ্যারেটির মাধ্যমে দিতে থাকলে নতুন প্রজন্মের কাছে কোরবানির গুরুত্বের শিক্ষা পৌঁছাবে না।
কিন্তু নিজ দেশে নিজ এলাকার নিজ গ্রামের নিজের স্বজনদের হক রয়েছে। একসময় যুক্তরাজ্যে কোরবানি সহজে দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় দেশে দিতেন প্রবাসীরা। এখন যেহেতু সুযোগ রয়েছে তাই এখানেও কিছু কোরবানি দিলে সন্তানদের কোরবানির তাৎপর্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে পরিচিত ও অবহিত করার সুযোগ থাকে।
দেশে প্রবাসীদের কোরবানি কমছে কেন?
কমিউনিটির বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ লন্ডনে কোরবানির অর্ডার নেন— এমন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠঅনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলাদেশি প্রবাসীরা নিয়মিতভাবে কোরবানির জন্য বাংলাদেশে তাদের পরিবারের কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন, যাতে তাদের আত্মীয়স্বজন এবং স্থানীয় সবাই কোরবানির মাংস পায়। বিশেষ করে প্রবাসীবহুল বৃহত্তর সিলেটে এ চর্চা কেবল একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাই পূরণ করে না, বরং কোরবানি তাদের গ্রামের, স্বজনদের প্রতি তাদের অবিচল সংযোগ এবং সমর্থনের এক শক্তিশালী যোগসূত্র। প্রবাসীদের কোরবানি বাংলাদেশের স্থানীয় পশুসম্পদ অর্থনীতিতেও একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। ২০২৪ সালে দেশে ১০ মিলিয়নরও বেশি পশু কোরবানি করা হয়।
তবে, কমিউনিটি নেতা এবং বাজার পর্যবেক্ষকদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণগুলো একটি লক্ষণীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা বাংলাদেশে প্রবাসীদের কোরবানির হ্রাসের বিষয়টি তুলে ধরে।
যদিও দেশীয় চ্যারিটি কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এই প্রক্রিয়াটিকে সহজ করার জন্য আবির্ভূত হয়েছে, তবে স্বচ্ছতা ও সময়মতো কোরবানি ও মাংস বিলি নিয়ে উদ্বেগ থেকে অনেকেই বিদেশেই দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করাকে সহজ মনে করেন।
সাংবাদিক মাহবুবুল করীম সুয়েদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রবাসীরা দেশে কোরবানি দিচ্ছেন। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে এটি প্রচলিত রীতি। এখন দেশে গিয়ে বা অর্থ পাঠিয়ে কোরবানি দেওয়ার প্রবণতা কমার পেছনে আন্তর্জাতিক দাতব্য অনুদানের সহজলভ্যতার বাইরেও অন্য কারণ আছে। বিদেশে বাংলাদেশি মিডিয়াগুলোর বেশিরভাগের এসব দাতব্য সংস্থার ভালেঅ রেটের বিজ্ঞাপন পাবার আশায় দিনরাত প্রচার করে। এই প্রবণতা নতুন প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আন্তর্জাতিক ইসলামিক দাতব্য সংস্থা এবং সাহায্য সংস্থাগুলেঅও প্রবাসীদের জন্য তহবিল দান করে— তাদের কোরবানির বাধ্যবাধকতা পূরণের প্রক্রিয়াটিকে সহজ করেছে।
এছাড়া, কিছু প্রবাসীর মধ্যে পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অগ্রাধিকারের মনোভাবও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশে কোরবানি দেওয়ার বড় কারণ।