X
মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০২৫
২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঈদের ছুটি শেষে প্রশাসনে কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ

শফিকুল ইসলাম
০৯ জুন ২০২৫, ২৩:৫৯আপডেট : ০৯ জুন ২০২৫, ২৩:৫৯

‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলন স্থগিত করে ১০ দিনের জন্য ঈদের ছুটিতে গেছেন সরকারি কর্মচারীরা। তারা বলেছেন, ছুটি শেষে দাবি আদায়ে আবারও শুরু হবে আন্দোলন। তখন সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সব সরকারি অফিসে কর্মপরিবেশ, শৃঙ্খলা, চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখা, সবশেষে নাগরিকসেবা দেওয়া অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা বলছেন, বহুল আলোচিত সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি হলে বিভাগীয় মামলার পরিবর্তে শুধু একটি চিঠি দিয়ে সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত বা দণ্ড দেওয়া যাবে, কিছু স্বার্থবাদী কর্মকর্তার কাছে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত দাসে পরিণত হবেন, ক্ষমতার অপব্যবহার বেশি হবে, বিভিন্ন কারণে অপছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হবেন, চাকরি হারানোর সুযোগ তৈরি হবে, অপছন্দ হলে কর্মকর্তার রোষানলে পড়বেন, একজন অভিযোগকারী কর্মকর্তা নিজেই তদন্তকারী ও বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, ভয়ভীতির কারণে সরকারি কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। তাই ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিল করতে হবে।

সূত্র জানিয়েছে, সরকার দাবি না মানলে আগামী ১৪ জুন ঈদের ছুটি শেষে দীর্ঘ কর্মবিরতির মতো কঠিন কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা। তারা বলেছেন, দাবি না মানলে ঈদের ছুটি শেষে অফিস চালুর পর দীর্ঘ কর্মবিরতিতে যাবেন। এ কর্মসূচিতে দেশের অন্যসব সরকারি অফিসের কর্মচারীদেরও সম্পৃক্ত করা হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। একইসঙ্গে থমকে পড়তে পারে সব ধরনের নাগরিক-সেবা। প্রশাসনে শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড।

উল্লেখ্য, ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে গত ২৪ মে থেকে আন্দোলন করছেন  সচিবালয়ের কর্মচারীরা। চার ধরনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যাবে, এমন বিধান রেখে গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন হয়। এরপর ২৫ মে অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি এবং পরবর্তী সময়ে কর্মচারীদের দীর্ঘ কর্মবিরতিতে যাওয়ার আগাম ঘোষণা সরকার তথা প্রশাসনকে অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সুচিন্তিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ হাসানের জারি করা এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য নিতে পারবে। গঠিত কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব।’

জানা গেছে, সরকারি কর্মচারীরা অধ্যাদেশটিকে নিবর্তনমূলক ও কালো আইন হিসেবে অভিহিত করছেন। এটি বাতিল করার জন্য সচিবালয়ে বিক্ষোভ মিছিল, কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি ছাড়াও কয়েকজন উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, খাদ্য ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এবং তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন আন্দোলনকারী কর্মচারীরা।

কর্মচারীদের স্মারকলিপি পাওয়ার পর ৩ জুন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, এই অধ্যাদেশের ব্যাপারে তাদের (কর্মচারীদের) অনেক আপত্তি আছে। তাদের আপত্তিগুলো শোনার পূর্ণ মানসিকতা সরকারের রয়েছে। যত দূর জানি, এ বিষয়ে উপদেষ্টা পর্যায়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির দায়িত্ব হবে আপত্তিগুলো ভালো করে শোনা ও বিবেচনা পূর্বক সুপারিশ করার। এরপর কমিটি প্রস্তাব দেবে। অধ্যাদেশটি যেহেতু উপদেষ্টা পরিষদে পাস হয়েছে, তাই কমিটির সুপারিশও উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপিত হবে।

এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে— কিছু ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকা কখনও প্রত্যাশিত ব্যাপার হতে পারে না। ভালো করে শোনা ও বোঝার জন্যই কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এর আগে গত ১ জুন অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলেন কর্মচারীরা। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘অধ্যাদেশটি দেখেছি। উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজনের নজরে এই জিনিসটা এনেছি। এখানে কিছু প্রভিশন আছে, যেগুলো অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা আছে।’

জানা গেছে, আলোচিত অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের (আইনানুযায়ী সব সরকারি চাকরিজীবী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী) চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো, সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনও কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা অন্য যেকোনও সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে,  অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন, বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যেকোনও কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন, এবং যেকোনও সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।

এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।

অধ্যাদেশে আরও বলা হয়, অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তাকে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। যদিও আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন।

অধ্যাদেশটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম একটি লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম বলছে, এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে নারী সহকর্মীদের ভীত সন্ত্রস্ত পরিবেশে কাজ করতে হবে। কেউ কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণেও চাকরিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি কেউ কেউ ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের কারণেও কর্মকর্তার রোষানলে পড়তে পারেন, দেশ ও জাতির সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মচারীদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। কর্মচারীদের ন্যায্যতা-প্রাপ্যতার দাবিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দারুণভাবে বাধার সৃষ্টি করবে। ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবির গণমাধ্যমকে জানান, আমাদের দাবি না মানা হলে অফিস চালুর পর বড় পরিসরে আন্দোলনে যাব। বড় ধরনের কর্মবিরতি পালন করবো এবং সেই কর্মসূচিতে সারা দেশের সব অফিসের কর্মচারীদের সম্পৃক্ত করা হবে।

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
১২তম দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচিতে ‘তথ্য আপা’ কর্মীরা
এবার ৪৪ জন আমলাকে অপসারণের দাবিতে পোস্টার
প্রশাসনের আশ্বাসে উত্তরায় মালিকপক্ষের বাসার সামনে থেকে সরলেন টিএনজেড শ্রমিকরা
সর্বশেষ খবর
মঙ্গলবার হো‌টেল ল‌বি‌তেই বৈঠক কর‌বেন ড. ইউনূস
মঙ্গলবার হো‌টেল ল‌বি‌তেই বৈঠক কর‌বেন ড. ইউনূস
কী বার্তা আসছে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের প্রথম বৈঠক থেকে
কী বার্তা আসছে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের প্রথম বৈঠক থেকে
লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় নজরে বিরল খনিজ রফতানি
লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় নজরে বিরল খনিজ রফতানি
দেশে করোনার নতুন ধরন পাওয়া গেছে, আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ আইসিডিডিআরবির
দেশে করোনার নতুন ধরন পাওয়া গেছে, আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ আইসিডিডিআরবির
সর্বাধিক পঠিত
দেশে ফিরেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
দেশে ফিরেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
যুক্তরাজ্য-ভার‌ত বা‌ণিজ্য চু‌ক্তি, বাংলাদেশের হাতছাড়া সুযোগ ও ড. ইউনূসের সফর
যুক্তরাজ্য-ভার‌ত বা‌ণিজ্য চু‌ক্তি, বাংলাদেশের হাতছাড়া সুযোগ ও ড. ইউনূসের সফর
ড. ইউনূসের লন্ডন সফর নি‌য়ে সর্বশেষ যা জানা গেলো
ড. ইউনূসের লন্ডন সফর নি‌য়ে সর্বশেষ যা জানা গেলো
দুই বিড়ম্বনায় রাজধানীবাসী
দুই বিড়ম্বনায় রাজধানীবাসী
ফেরার পরও আবদুল হামিদকে গ্রেফতার না করা নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ফেরার পরও আবদুল হামিদকে গ্রেফতার না করা নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা