রাজধানীর কাকরাইল, মিন্টো রোড, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, অফিসার্স ক্লাব এলাকা ও সচিবালয় ঘিরে একের পর এক গণজমায়েত, মিছিল ও বিক্ষোভ ঠেকাতে বারবার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণ দেখিয়ে গত ১০ মাসে মোট পাঁচবার এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সংস্থাটি। প্রতিবারই বলা হচ্ছে—‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে’। প্রশ্ন উঠছে—বারবার একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন কেন হচ্ছে?
সর্বশেষ ৪ জুন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী সই করা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৯ জুন থেকে কাকরাইল, সচিবালয় ও আশপাশের এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল ও গণজমায়েত নিষিদ্ধ। তবে আগের চারবারের মতো এবারও জানানো হয়েছে, নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’।
এর আগে ২০২৪ সালের ২৬ আগস্ট ও ৩০ আগস্ট এবং ২০২৫ সালের ১৩ মার্চ ও ১০ মে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। প্রতিবারই বলা হয়, এটি ‘স্থায়ীভাবে কার্যকর’ থাকবে, অথচ আবারও নতুন করে একই গণবিজ্ঞপ্তি জারি করতে হচ্ছে ডিএমপিকে। তাহলে কি আগের নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর ছিল না?
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থেমে নেই কর্মসূচি
নিষেধাজ্ঞা জারি থাকা অবস্থায়ও সচিবালয় ও যমুনা বাসভবন কেন্দ্রিক এলাকায় রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনগুলোর কর্মসূচি চলছেই। চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সরকারি কর্মচারীরা সচিবালয়ের ভেতরে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারি কর্মচারী অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে।
অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের পর থেকেই প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’র সামনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে। সর্বপ্রথম ২০২৪ সালের ১৭ আগস্ট আউটসোর্সিং কর্মীরা চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে যমুনার সামনে অবস্থান নেন। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে পোশাক শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিরোধী দলের নেতাকর্মী, নাগরিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পক্ষ এই এলাকাকে আন্দোলনের জন্য বেছে নিচ্ছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়। ২০ মে বকেয়া বেতনের দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা কাকরাইল মোড় অবরোধ করেন। ২১ ও ২২ মে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে তাঁর সমর্থকেরা যমুনার সামনে অবস্থান নেন। একই সময়ে ছাত্রদল এবং ঢাবি শিক্ষার্থীরা ছাত্র সাম্য হত্যার প্রতিবাদে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় অবরোধ করে।
এর আগে ১৪-১৫ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্থায়ী ক্যাম্পাস দাবিতে, ৮-৯ মে বিভিন্ন সংগঠন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে এবং ১ জুন ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের কর্মীরা দাবি বাস্তবায়নে যমুনা অভিমুখে কর্মসূচি পালন করেন।
সচিবালয় কেন্দ্রিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট ‘বাংলাদেশ সচিবালয় বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী সংগঠনের’ ব্যানারে। এরপর থেকে আনসার-ভিডিপি সদস্য, চাকরিচ্যুত পুলিশ ও বিডিআর সদস্য, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এই এলাকায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য: ‘যমুনায় না গেলে কেউ শোনে না’
পোশাক শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় শ্রম ভবনের সামনে বহুদিন আন্দোলন করেও কোনও সাড়া মেলেনি। কিন্তু যমুনার সামনে যাওয়ার পরই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে উদ্যোগ আসে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিমুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বারবার গিয়েও সাড়া পাইনি। যমুনার সামনে গেলে তবেই সরকার নড়েচড়ে বসে।’
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের এক সমর্থক রিয়াজ হোসেনের ভাষ্য, ‘বিদায়ী সরকার দেখিয়ে গেছে—সরকারপ্রধানের অনুমোদন ছাড়া কিছু হয় না। এখনকার সরকারও সেই ধারাতেই চলছে। তাদের নিজস্ব কোনও সিদ্ধান্ত বা নীতি নেই বলেই একই নিষেধাজ্ঞা বারবার দিতে হচ্ছে, আর আমাদের আন্দোলনও যমুনা-সচিবালয় ঘিরেই হচ্ছে।’
নিষেধাজ্ঞা, কিন্তু প্রয়োগ কতটা?
যমুনা ও সচিবালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন দমনে কোথাও কোথাও পুলিশ হস্তক্ষেপ করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। কোথাও সমাবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে, অন্যত্র নির্বিঘ্নে কর্মসূচি চলছে—এতে প্রশ্ন উঠেছে: ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা কি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ?
অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। পুলিশকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কৌশলগতভাবে সমাধানের পথে যেতে হবে। তবেই সংঘাত কমবে, আইন কার্যকর হবে।’
ডিএমপির ব্যাখ্যা
ডিএমপির মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘যমুনা ও সচিবালয় এলাকা অত্যন্ত সংবেদনশীল। এখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। সাধারণত এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ৩০ দিন হলেও প্রয়োজনে আবারও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই যত কম বলপ্রয়োগে আইন প্রয়োগ সম্ভব হয়। কখনও কৌশলগত কারণে নমনীয় অবস্থান নেওয়া হয়। তবে আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’
বারবার নিষেধাজ্ঞা, কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ
বিশ্লেষকদের মতে, এক এলাকায় বারবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তা বাস্তবে প্রয়োগ না করা প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেয়। তারা বলছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে যমুনা-সচিবালয় এলাকা নিরাপত্তা বলয়ে রাখা যৌক্তিক হলেও কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা এবং সমতা নিশ্চিত না হলে এই নিষেধাজ্ঞা কেবল কৌশলগত ‘বিজ্ঞপ্তি রাজনীতির’ অংশ হয়ে দাঁড়াবে।
তাদের মতে, একবার নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা কার্যকর থাকলেই যথেষ্ট, বারবার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই—যদি বাস্তবেই তা কার্যকর হয়।