রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় রয়েছে চাকচিক্যময় রেস্টুরেন্ট। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তরুণদের কাছে রেস্টুরেন্টগুলো ভোজ ও সময় কাটানোর প্রধান জায়গা হয়ে উঠেছে। আগতদের আকৃষ্ট করতে রেস্টুরেন্ট মালিকরাও গুরুত্ব দিচ্ছেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনে। তবে অন্দরসজ্জা সুন্দর করলেও নিরাপত্তার জায়গায় ফাঁক রয়েই যাচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বেশিরভাগ মালিকেরই মাথাব্যথা নেই।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। এ ঘটনায় নতুন করে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে সব মহল। প্রশ্ন উঠছে, চাকচিক্যময় এসব রেস্টুরেন্ট আসলে কতটা নিরাপদ?
শনিবার (২ মার্চ) রাজধানীর মিরপুর এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, সাজসজ্জায় মনোযোগী মালিকরা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যথেষ্ট উদাসীন। সামান্য কিছু রেস্টুরেন্ট মালিক নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেন। কথা বললে সবাই জানান অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখেছেন, কিন্তু এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ ফায়ার এক্সটিংগুইশারও (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র) সাজিয়ে রাখতে দেখা গেছে অনেক রেস্টুরেন্টে।
মিরপুর ১ নম্বর কো-অপারেটিভ মার্কেট শাখার প্রিন্স হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. বিল্লাল হোসেন মিজি বলেন, ‘আমাদের এখানে আগুন নেভানোর সব ব্যবস্থা আছে। সব ওপরে রাখা হয়েছে। আমরা সিলিন্ডার ব্যবহার করি না। গ্যাসের লাইনে চুলা জ্বালাই। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে নিচ থেকেই বন্ধ করে দেওয়া যায়। আমাদের মেইন প্রিন্স (গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট) থেকে দুদিন পর পর এসে এসব চেক করে যায়।’
বিল্লাল হোসেন মিজি এমন দাবি করলেও রেস্টুরেন্টটির একতলা দোতলা ঘুরে কোনও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
মিরপুর ১ নম্বরের নিউ ক্যাফে ধানসিঁড়ি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টের নিচতলায় বাংলা খাবার, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় চাইনিজসহ অন্যান্য খাবার পাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা হয়েছে, তবে মেয়াদ শেষ হয়েছে চার বছর আগে, ২০২০ সালে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কোনও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই।
এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. তামিম বলেন, ‘আমাদের সেন্ট্রালি আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে আগুন নেভানোর সিলিন্ডার (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) সব ফ্লোরে আছে।’
এগুলোর মেয়াদ আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি জানি না।’
মিরপুর ১০ নম্বরের সুলতান ডাইনসের ম্যানেজার মো. মহসিন বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে আমরা আগে থেকেই সতর্ক। আমাদের সব শাখায় অনেক মানুষের যাওয়া-আসা। সবার নিরাপত্তার কথা ভেবেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখি। বেইলি রোডের ঘটনার পর এতে আরও জোর দিয়েছি।’
তাদের একটি ফ্লোর থেকে অপর ফ্লোরে ঢোকার দরজায় কয়েকটি গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো সাময়িকভাবে রাখা হয়েছে, সরিয়ে ফেলা হবে।’
সন্ধ্যায় মিরপুর ১২ নম্বরের সফুরা টাওয়ারে গিয়ে দেখা যায়, এর ৯টি ফ্লোরই খাবারের দোকানের দখলে। ১০টির বেশি নামিদামি খাবারের দোকান রয়েছে এই ভবনে। ভবনটিতে দুটি লিফট রয়েছে। একটি সর্বোচ্চ চার জন, আরেকটি সর্বোচ্চ পাঁচ জন বহনে সক্ষম। সরু সিঁড়ি রয়েছে দুটি, পাশাপাশি দুজন নামতে পারবেন। ভবনটির প্রতি তলায় একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ঝুলানো আছে। এই ভবনের সব রেস্টুরেন্ট ছিল পরিপূর্ণ।
এখানে একটি রেস্টুরেন্টে এসেছেন ফয়সাল আহমেদ। বলেন, ‘এত বড় বিল্ডিংয়ে মাত্র দুটি ছোট লিফট। সিঁড়িও অনেক সরু। দুর্ঘটনা ঘটলে নামার উপায় নেই। এখানে যত মানুষের আনাগোনা থাকে, সেই তুলনায় সিঁড়ি ও লিফট খুবই ছোট।’
মিরপুর ১ নম্বরের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. আবু হানিফ বেইলি রোডের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘খুবই মর্মান্তিক ঘটনা সেখানে ঘটেছে। আমাদের দুই জন মারা গেছেন। অগ্নিনিরাপত্তার জন্য আমাদের আটটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার আছে। ১১ মাস পর পর এগুলো আপডেট করা হয়।’
মিরপুর ২ নম্বরের পিৎজা বার্গের ম্যানেজার বসির উদ্দিন আহমেদ সজিব বলেন, ‘যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে সেখানেই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রেখেছি। রান্নাঘর ও ওভেনের পাশে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রেখেছি। এগুলো নতুন আনা হয়েছে।’
মিরপুর ১ নম্বরের বার্গারোলোজি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বলেন, ‘আমাদের রান্নাঘরে ৩টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার আছে।’ তবে সেখানে গিয়ে কোনও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দেখা যায়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মিডিয়া সেলের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর মো. আনোয়ারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে ফায়ার সার্ভিস পরিদর্শন করে। কোনও ভবনে যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকে, প্রাথমিকভাবে সেখানে কী কী ফায়ার সিকিউরিটির অভাব রয়েছে, সেটি নোটিশ করা হয়। পরে সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা দেখা হয় সরেজমিন। এসব বিষয়ে স্থানীয় ফায়ার স্টেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সবসময় তদারকি করেন।’
তিনি বলেন, ‘নোটিশ করার পরও না মানলে পুনরায় সতর্ক করা হয়। তারপরও অনেকে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে চান না।’
ছবি: প্রতিবেদক