X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাটক-ফাটক নয়: টিভি নাটক

মহিউদ্দীন আহমেদ
২২ আগস্ট ২০১৬, ১৮:৪৯আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৬, ১৮:৫২

মহিউদ্দিন আহমেদটিভি নাটক। ঝালমুড়ি। কুড়মুড়ে। মুচমুচে। খোশগল্প করতে করতে উপভোগযোগ্য। দুই একটা মুড়ি কিংবা সংলাপ কিংবা দৃশ্য টুপ করে খসে পড়লে ক্ষতি নেই। কাহিনীর পুরোটা না দেখলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। এমনকি অন্য চ্যানেলে চলে গেলে কারও কাছে কোনও জবাবদিহিও করতে হবে না।
এইসব ছাইপাশ, মুড়ি-মুড়কিতে পেট ভরে না। ইহা মস্তিষ্কের উর্বরাশক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে না। ইহা ফোলা-ফাঁপা। বস্তাপচা, ভাঁড়ামিপূর্ণ, ফাও প্যাচাল, বিজ্ঞাপনে ঠাসা ইত্যাদি ইত্যাদি। ইহা ‘নাটক-ফাটক’।
জ্বি হ্যাঁ, ‘নাটক-ফাটক’!
আমরা টিভি নাটককে ‘নাটক-ফাটক’ বলতেই অভ্যস্ত। কে বা কারা এই চমৎকার নামটি দিয়েছিল এবং কবে থেকে এই নাম প্রচলিত জানা মুশকিল। তবে ‘ফ’ বর্ণের অনুপ্রাস দৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, নামদাতা বা দাতাগোষ্ঠী কবিতা লেখার কলকব্জা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত ছিলেন।
হয়তো তাদের মতে- গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সঙ্গীত কিংবা চিত্রকলার সঙ্গে টিভি নাটকের কোনও সম্পর্ক নেই। ইহা জাত-পাত-শেকড়হীন। ইহা কারও পাতে দেওয়ার অযোগ্য। ইহা মঙ্গল গ্রহ থেকে আগত। 
তবে চলতে-ফিরতে, চায়ের আড্ডায় প্রায়ই শোনা যায়, বিটিভির আমলে টিভি নাটক প্রচণ্ড প্রতাপশালী ছিল। দুর্দান্ত ছিল কাহিনী, সংলাপ ও অভিনয়। তখনকার সাপ্তাহিক কিংবা ধারাবাহিকগুলো চুম্বকের মতো দর্শক টানতে সক্ষম ছিল।

অর্থাৎ ওই সময় ইহা ছিল শিল্প। কারণ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন জ্ঞানী-গুণী-বিদগ্ধজন। কিন্তু এখন? এখন জড়িত সব ‘ফটকাবাজ’রা। আর যা সৃষ্টি হচ্ছে তা শিল্প বিবর্জিত। তাই ‘নাটক-ফাটক’!    

এটা অনেকটা গল্পের সেই বৃদ্ধার মতো, একদা যে যৌবনবতী ছিল, যার সৌন্দর্য ছিল রমণীয়! ভ্রমরকূল সদা গান গাইতো তাকে ঘিরে। কিন্তু কালক্রমে এখন সে জরাজীর্ণ, ক্লিষে, পানসে, মনোযোগহীন।  

প্রিয় পাঠক। এই কথাগুলো আপনারা শুনতে পান কিনা জানি না। আপনারা নিজেরা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন কিনা, তাও জানি না। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমরা কিছু ‘ফটকাবাজ’  ‘নাটক-ফাটক’ করে সংসার চালাই বলে আমরা হয়তো কথাগুলো একটু বেশিই শুনি। মন্দ লাগে না!

মন্দ না লাগার কারণ ব্যাখ্যা করি।

১৯৮০ সালে যার জন্ম, সে এখন মধ্য বয়স্ক। এই যে ৩৬ বছরের বিশাল সময়, এরমধ্যে দুনিয়ার সবকিছু বদলে গেছে। কিন্তু টিভি নাটক যেন পুরনো প্রেমিকা। সে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে প্রেমিকপ্রবর হেঁটে যাবে। অকস্মাৎ চার চোখের মিলনে ফুটে উঠবে অমিয়-ফাল্গুধারা। এমনকি আফটার হার্ট অ্যাটাক, হাসপাতালের নরম বিছানায় শুয়েও নিষ্পলক দৃষ্টিতে বৃদ্ধ প্রেমিকপ্রবরটি এরকম একটি দৃশ্য দেখতে চাইবে। কিন্তু চাওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তির সংমিশ্রণ নাও থাকতে পারে প্রিয় কলিকালের বিদগ্ধ মহোদয়গণ!

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিভি নাটক তার ধরন-ধারণ ও স্টাইল বদলেছে। একমাত্র বিনোদন মাধ্যম বিটিভির স্বর্ণ যুগ বিটিভির জীবদ্দশাতেই শেষ হয়েছে।

এখন শুরু হয়েছে নিরীক্ষাধর্মী নাটক। তরুণেরা মুক্তমনে নানারকম সৃজনশীল চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে চাইছেন এই ফর্মের মাধ্যমে। কেউ কেউ একে দেখছেন সিনেমার বিকল্প হিসেবে। কিংবা কোনও ছোটগল্পকার টিভির জন্য একটি গল্প লিখছেন। ফলে অনেক সময় চা-বিস্কুট বা আলাপ-সালাপের মাঝখানে টিভি নাটক থেকে রস নেওয়া কিঞ্চিৎ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলেই পুরোটা বোঝা যায় না। সঙ্গে কিঞ্চিৎ চিন্তা যোগ করে নিতে হয়। মস্তিষ্কের কায়িক পরিশ্রম লাগে। তথাকথিত টিভি নাটকের স্বর্ণ যুগের সঙ্গে বর্তমান সময়ের মূল পার্থক্য ঠিক এই জায়গাটায়। ধারণা করতে ভালো লাগে এ-কারণেই ‘নাটক-ফাটক’ নামকরণ করা হলো কি-না! যেমন আঙুর খেতে না পেরে শিয়াল বলেছিল, উহা বড়ো টক!

আরও একটা সন্দেহ আছে। সেটাও বলা যাক।   

যারা সমাজের স্কলার হিসেবে পরিচিত তাদের একটা অংশ, যেমন নাড়িকাটা ডাক্তার, ঘুষখোর ইঞ্জিনিয়ার, চাপাবাজ ব্যারিস্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জ্ঞানপাপী অধ্যাপক’, নাকউঁচা ও উন্নাসিক সাহিত্যিক-- এরা কিন্তু ভেতরে ভেতরে টিভি নাটকের প্রতি দারুণ আগ্রহী। কেউ কেউ মোহান্ধ। তাদের অদম্য বাসনা, ছুটির দিনে একটি নাটক লিখে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করে ফেলবেন। কিন্তু টিভি নাটক লেখার কৌশল জানেন না। তাই এরা নাট্যকারদের পেছন পেছন ঘোরেন এই আশায়, যাতে একটি স্ক্রিপ্ট দেখে নেওয়া যায়। এতকিছুর পর হয়তো তারা একটি হাঁটুভাঙা নাটক দাঁড় করাতে সক্ষম হন। কিন্তু আলোর মুখ দেখার আগেই উহা মৃত্যুবরণ করে। ফলে তারাও শেষে বলতে বাধ্য হন- আঙুর ফল টক।

আর এইখানে এসে প্রমাণ হয় যে, চাইলেই যেমন একটি কবিতা বা উপন্যাস লেখা সম্ভব নয় তেমনি টেলিভিশন নাটকও কবিতা বা উপন্যাসের মতো একটি শাখা শিল্প। এইখানে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সবচাইতে বড়ো আর্কাইভ হলো মানুষের মন।

বিজ্ঞানীদের মতে, একজন সুস্থ মানুষ ৯০ বছর আগের কোনও স্মৃতি রোমন্থন করতে পারেন। তার প্রমাণ পাই যখন জীবনানন্দ দাশের কবিতা একবার পড়ার পরে বহুকাল মনে আস্তানা গেড়ে থাকতে পারার শক্তিমত্তা দেখে। কিংবা বাল্যপ্রেম কতটা জীবন্ত আর অনুপ্রেরণা হয়েই না আমাদের মগজে বাসা বেঁধে থাকে।

তাই এ কথা বলা যায় যে, মনে ও মননে যদি জায়গা করে নিতে পারে টিভি নাটকের কোনও মহৎ ইমেজ তবে তা অন্যান্য শিল্পের চেয়ে অধিকতর প্রাণবন্ত হয়েই বেঁচে থাকতে পারে।

টিভি নাটক ঝালমুড়ি, কুড়মুড়ে, মুচমুচে, খোশগল্প করতে করতে উপভোগযোগ্য- এইসব মন্তব্য ও মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সময় এসেছে টিভি নাটককে শিল্পের মর্যাদা দেওয়ার।

প্রিয় পাঠক। আপনারা হয়তো একটি প্রশ্ন করার জন্য মুখিয়ে আছেন। কেন টিভি নাটকের এই দৈন্য-দশা?

এই প্রশ্নের উত্তর অনেক বড়ো। অতি সংক্ষেপে বললে, স্থিতিহীন ও খামখেয়ালি রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় গভীর চিন্তার কোনও জায়গা নেই। শিল্প-সংস্কৃতি যেহেতু গভীর চিন্তা দাবি করে এবং তা পায় না ফলে শুধু টিভি নাটক নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখারও একই অবস্থা। উপরন্তু যতদিন দেশের সৃজনশীল মানুষ পুরস্কার বা স্বীকৃতির নেশায় রাজনীতির নামে নিজেদের বিক্রি করে বেড়াবেন এবং নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকবেন ততদিন এই দৈন্য-দশার অমানিশা থেকে মুক্তি নেই সাহিত্যের। 

লেখক: গল্পকার ও নাট্যকার

   

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা