X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

আসামির প্রতি পুলিশের আচরণ কেমন হবে

জামাল উদ্দিন
০৯ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৫৯আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০১৭, ২০:৩৫




চোখ হারিয়েও ঢামেকে হাতকড়া পরা অবস্থায় চিকিৎসাধীন শাহজালাল আসামির প্রতি পুলিশের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ বহু পুরনো। আটক বা গ্রেফতারের পর বন্দিকে নির্যাতনেরও কথা শোনা যায়। অনেক সময়ই অভিযুক্তকে আটকের কথাও স্বীকার করে না বাহিনীটি। সম্প্রতি খুলনায় শাহজালাল নামের এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে এক লাখ টাকা না পেয়ে দু’চোখ উপড়ে ফেলার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে পুলিশ বলছে, ছিনতাইকারী হিসেবে ধরে জনতা গণপিটুনি দিয়ে শাহজালালের চোখ উপড়েছে। একেকটি ঘটনার পর পুলিশ নানা ব্যাখ্যা দিলেও তাদের বিরুদ্ধে হয়রানি, দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের অভিযোগ থেমে নেই।

আসামির প্রতি পুলিশের আচরণ কেমন হওয়া উচিত- এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ ও আইনজীবীরা বলছেন, আসামির প্রতি অবশ্যই সহনশীল আচরণ করতে হবে। মারধর তো করাই যাবে না, এমন কোনও আচরণও করা যাবে না, যেটা আসামির মনে ভীতি তৈরি করে।

পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামির প্রতি কী আচরণ হবে সেটা আইনেই নির্ধারিত আছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে বিস্তারিত নির্দেশনাও দেওয়া আছে। পুলিশের অন্যায় আচরণের প্রতিকারও আইনে বলা আছে। এছাড়া, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন আইনজীবীরা।

গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কিংবা ক্রসফায়ারে ৯০ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে র‌্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ১৩ জন, পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৪৬ জন, ডিবি পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে আট জন, র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে একজন, পুলিশের নির্যাতনে চার জন, পুলিশের গুলিতে ১২ জন, র‌্যাবের গুলিতে একজন, র‌্যাব ও পুলিশের গুলিতে একজন, বান্দরবানের লামায় সেনাবাহিনীর গুলিতে একজন, পুলিশ হেফাজতে অসুস্থ হয়ে একজন, গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে একজনের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়।’

শাহজালাল

চাহিদামতো টাকা না পাওয়ায় খুলনার খালিশপুর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে শাহজালাল নামে এক ব্যক্তির দুই চোখ তুলে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। গত ১৮ জুলাই রাতে এ ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিক্যালের ৩০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শাহজালাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর আমার ১০ মাসের মেয়ের জন্য দুধ কিনতে শ্বশুরবাড়ি থেকে দৌলতপুর যাচ্ছিলাম। বাসা থেকে একটু সামনে যেতেই তিনটি মোটরসাইকেলে করে আসা পুলিশ হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে আমাকে নিয়ে যায়। তারা বলে, তোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। এরপর থানায় নিয়ে আমাকে অনেক মারধর করা হয়। তখন পুলিশ বলে, “এক লাখ টাকা দে, তোকে ছেড়ে দেবো।” টাকা দিতে অপারগতা জানালে পুলিশ আমাকে খুলনার আড়াইশ’ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা বলে থানা থেকে গাড়িতে তুলে বাইরে নিয়ে যায়। তখন আমার স্ত্রী থানার বাইরে ছিলেন। জানতে চাইলে আমার স্ত্রীকে পুলিশ বলে, “চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।” কিন্তু হাসপাতালে না নিয়ে পুলিশ আমাকে খুলনার বিশ্বরোড এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে হাত-পা ও মুখ বেঁধে তারা আমার দুই চোখ উপড়ে ফেলে।’

হেফাজতে থাকা আসামির প্রতি পুলিশের আচরণ কী হওয়া উচিত জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি আইনেই নির্ধারিত করা আছে। সাধারণত, আসামির প্রতি কোনও আক্রমণাত্মক আচরণ করা যাবে না। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও পুলিশকে যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে গত বছর (২০১৬ সালের মে মাসে) একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এক্ষেত্রে আসামিকে কোনও ভয়ভীতি ও মিথ্যা প্ররোচনা না দিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। মারধর করাই যাবে না। এগুলো আইন। ১৬৪ ধারায় আদালত যেভাবে জবানবন্দি গ্রহণ করেন, সেভাবেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। হেফাজতে নিয়ে আসামিকে মারধর করা ৩৩০ ধারায় অপরাধযোগ্য।’

হাসপাতালের বেডে শাহজালালের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মেডিক্যালে যাকে ভর্তি করানো হবে তাকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা যাবে না। তিনি তখন রোগী হিসেবে গণ্য হবেন। তখন হ্যান্ডকাফ পরানোর কোনও সুযোগই নেই।’ বরগুনার আলোচিত সাবেক ইউএনও গাজী তারিক সালমনের কারাগারে পাঠানোর বিষয়ে অ্যাডভোকেট আমিনুল বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে পুলিশ কাজ করেছে। আদালত যদি তাকে জেলে পাঠায় তাহলে পুলিশ তার নিরাপত্তার স্বার্থে যেটুকু করার প্রয়োজন সেটা করবে। তখন তিনি স্বাভাবিক আসামি হিসেবে গণ্য হবেন।’

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও পুলিশের অন্যায় আচরণ থেকে মানুষ রেহাই পাচ্ছে না। এর প্রতিকার কী জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আইনের প্রয়োগ করতে হবে। দোষী পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এছাড়া প্রতিকারের আর কোনও উপায় দেখছি না।’

আসামির প্রতি পুলিশের আচরণ কী হওয়া উচিত জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘অবশ্যই সহনশীল বা আইনগতভাবে যতটুকু সম্ভব সতর্কতার সঙ্গে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। পুলিশ সেভাবেই জিজ্ঞাসাবাদ করে দাবি করে তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে যতটুকু তথ্য প্রয়োজন, সেটাই পুলিশ নিয়ে থাকে। আইনগতভাবে কিছু গাইডলাইন আছে। যেমন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়ে আইন আছে। একইসঙ্গে ৩৩৭ ধারায় বলা আছে আসামিকে ৩৬ স্কয়ার ফিটের কক্ষের মধ্যে রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। থানার হাজতখানায় একজনকে যদি ৩৬ স্কয়ার ফিট দেওয়া হয়, তাহলে কয়জনকে রাখতে পারবো। তারপর আসামিকে আমাদের হেফাজতে খাবার দিতে গেলে তিন বেলা খাবারের জন্য বরাদ্দ আছে মাত্র ১০ টাকা। কিন্তু ১০ টাকায় তো কাউকে তিন বেলা খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। আইনের সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার কিছুটা হলেও তফাত আছে।’

হাসপাতালের বেডে শাহজালালের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আইনে বলা আছে আমি হ্যান্ডকাফ এমনকি ডান্ডাবেড়িও লাগাতে পারবো। তবে সেটা কাকে পড়াবো, কাকে পড়াবো না, এটা নিয়মিত প্রশিক্ষণের বিষয়। যারা তার সঙ্গে আছে সেটা তাদের বিবেচনারও বিষয় থাকে। পাহারায় থাকা পুলিশের সামর্থ্যের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। এটা আসলে কেস টু কেস বিবেচনায় নিতে হবে। তবে হ্যান্ডকাফ যদি আপনার হাতে থাকে, তখন আপনি যদি পলায়নও করেন, তাহলে কিন্তু বোঝা যাবে যে আপনি কোনও না কোনও মামলার সঙ্গে জড়িত। পালিয়ে যাওয়ার পর হ্যান্ডকাফসহ অনেক ব্যক্তিকে আমরা গ্রেফতারও করেছি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হ্যান্ডকাফটা যে সব সময়ের জন্য খারাপ তাও নয়।’

পুলিশের অন্যায় আচরণের প্রতিকার কী জানতে চাইলে ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশের কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিভাগীয় মামলা ছাড়াও অনেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। এর উদাহরণ অনেক। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’

/জেইউ/এএম/আপ-এসএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা