X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাসে করে মীমের কলেজে যাওয়া নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন মা-বাবা

আমানুর রহমান রনি
৩০ জুলাই ২০১৮, ০৪:০০আপডেট : ৩০ জুলাই ২০১৮, ১০:২২

দিয়া খানম মীম

তুলনামূলক ভালো বলে বাসা থেকে দূরে হওয়ার পরও শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজটিতে ভর্তি হতে মায়ের কাছে আবদার করেছিলেন দিয়া খানম মীম (১৭)। প্রতিদিন বাসে করে কলেজে যেতে হবে ভেবে তাকে প্রথমে সেখানে ভর্তি করতেই চাননি তার মা-বাবা। পরে মেয়ের আগ্রহের দিকটা ভেবে তাকে এ কলেজে ভর্তি করেন তারা। তবে প্রতিদিন বাসে করে মেয়ের কলেজে যাওয়া নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন তারা।

রবিবার (২৯ জুলাই) দুপুর পৌনে ১টার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বেপরোয়া গতির বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। এর মধ্যে একজন দিয়া খানম মীম। তিনি ওই কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন মা রোক্সানা বেগম, আর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে।

দক্ষিণ মহাখালীর জামে মসজিদ গলির জি.পি.ক-৭৫ নম্বর বাড়ির নিচতলার দু’টি কক্ষে ভাড়া থাকেন রোক্সানা বেগম ও জাহাঙ্গীর হোসেন দম্পতি। তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড়মেয়ে রিয়া খানম (১৮), মেজো মেয়ে দিয়া খানম মীম (১৭) এবং ছোট ছেলে রিয়াদ। জাহাঙ্গীর হোসেন পেশায় গাড়িচালক। তাদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর ভান্ডারিয়ার জুনিয়া গ্রামের তালুকদার বাড়ি। মহাখালীতে দীর্ঘদিন ধরে তারা ভাড়া থাকেন। দক্ষিণ মহাখালীতে তাদের আরও স্বজনরা থাকেন।

রবিবার বিকালে দক্ষিণ মহাখালীর বাসাটিতে গিয়ে দেখা যায়, রোক্সানা বেগম সামনের কক্ষের খাটে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান ফিরলে প্রতিবেশী নারী ও স্বজনরা তাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন; স্বান্তনা দিচ্ছেন মীমের সহপাঠীরাও। কিন্তু জ্ঞান ফিরলেই মীম মীম বলে ডাকার চেষ্টা করছেন রোক্সানা বেগম, যদিও তার গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হচ্ছে না। তার এ অবস্থা দেখে কাঁদছেন মীমের সহপাঠীরাও।

জ্ঞান ফিরলে রোক্সানা বেগম বিড় বিড় করে বলেন, ‘মেয়ের বাসে করে কলেজে যাওয়া নিয়ে প্রতিদিনই আতঙ্ক থাকতো মনে। সেই ভয়ই যে সত্য হয়ে যাবে, কে জানতো!’

তিনি বলেন, ‘আমি নিজে সকাল সাড়ে ৬টায় মহাখালী থেকে বাসে তুলে দিয়ে এসেছি আমার মেয়েকে। যাওয়ার সময় সে বলেছে, আম্মু আমার পৌনে ১টায় ছুটি হবে, আমি দ্রুত বাসায় চলে আসবো।’ ওই সময় মেয়েকে সাবধানে যাওয়ার কথা বলেন বলে জানান রোক্সানা বেগম। এটাই ছিল মীমের সঙ্গে তার শেষ কথা।

তিনি আরও জানান, প্রতিদিনের মতো আজও মেয়ের টিফিন তৈরি করে দেন তিনি। তবে মেয়ে তা খেয়েছিল কিনা সেটা আর জানা হয়নি তার।

মীমের খালা নাজমা বেগম বলেন, ‘আমরা প্রথমে সড়ক দুর্ঘটনার কথা শুনছি, তবে এর শিকার যে আমাদের মীম হয়েছে তা বুঝতে পারিনি। পরে আমরা খবর পেয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে চলে যাই। এরপর সেখানে গিয়ে মীমের লাশ দেখতে পাই।’

তিনি বলেন, ‘মেয়ের লাশ দেখে বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। পরে তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন তিনি সুস্থ।’

নাজমা বলেন, ‘মীম খুব শান্ত ছিল। সবাই ওকে পছন্দ করতো। ঘরে বসে নিজে নিজে গান-বাজনা করতো। লেখাপড়াতেও ভালো ছিল।’

বড়বোনের সহপাঠীদের সঙ্গেও মীমের ছিল সখ্যতা। পিঠাপিঠি হওয়ায় বড় বোনের টিঅ্যান্ডটি মহিলা কলেজেও যেতেন মীম। বোনের সহপাঠীরা সবাই মীমকে চেনেন। তাদের এক জন আঞ্জুমান। তিনি বলেন, ‘আমরা কলেজের তিন তলা থেকে দেখেছি, কলেজের শিক্ষার্থীরা গাড়িচালককে আটক করে কলেজের ভেতরে নিয়ে আসে। এরপর শুনতে পারি, বাসের চাপায় মীম নিহত হয়েছে।’

আঞ্জুমান বলেন, ‘কুর্মিটোলার সামনে দিয়ে রাস্তায় ফুটপাত নেই। কলেজ থেকে বের হয়ে অথবা জিয়া কলোনি দিয়ে এসে ফ্লাইওভারের মুখ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় না। ফুটপাত নেই। শিক্ষার্থীরা ওখান থেকে ফুটওভার ব্রিজের দিকেও যায়, কিন্তু সেজন্য কোনও পথ নেই। বাসগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে বলে লাইন ধরেও বাসে ওঠা যায় না। একটির সামনে এসে আরেকটি দাঁড়ায়। রবিবার দু’টি বাসের এমন প্রতিযোগিতায় নিহত হন রমিজ উদ্দিনের দুই শিক্ষার্থী।’

মীম রমিজ উদ্দিন কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার রোল নম্বর ২৮৫৫। মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ থেকে ভালো রেজাল্ট করার পর তিনি রমিজ উদ্দিনে ভর্তি হন।

রেজাউল করিম রাজু

সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে রমিজ উদ্দিনে ভর্তি হন রাজু

একই ঘটনায় কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রেজাউল করিম রাজুও নিহত হন। তিনিও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা নেই। সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্টে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। খালাতো ভাইয়ের বাড়িতে থেকে তিনি লেখাপড়া করছিলেন।

ঘটনার পর কর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ছুটে আসেন রাজুর খালাতো ভাই মেহজাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অনেক স্বপ্নবাজ ছিল ছোট্ট এই ছেলেটি। লেখাপড়াতেও ভালো ছিল। সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন আর তার পূরণ হলো না।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করার পর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক।’

রবিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে হোটেল রেডিসনের সামনে রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এসময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১১৯২৯৭) বেশ কয়েকজনকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন রাজু ও মীম।

এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে কলেজের শিক্ষার্থী। তারা জাবালে নূর পরিবহনের ওই বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং শতাধিকের বেশি বাস ভাঙচুর করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

রাজুর খালাতো ভাই মেহজাব উদ্দিন বলেন, ‘রাজু যখন ক্লাস ফাইভে, তখন ওর বাবা মারা যায়। পরে আমরা আমাদের ঢাকার আশকোনা বাজারের পাশের বাড়িতে নিয়ে আসি তাকে। এখানে থেকেই সে লেখাপড়া করছিল। এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে রাজু জিপিএ-৪.৫ পেয়ে কলেজে ভর্তি হয়।’

রাজু ভালো গান গাইতেন বলে জানান তার সহপাঠীরা। তার ইউটিউবে একটি চ্যানেলও রয়েছে।

আরও পড়ুন–

বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত, প্রতিবাদে গাড়িতে আগুন-ভাঙচুর

চালকের প্রতিযোগিতার কারণেই বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত

 

 

/এমএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড