X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একাদশ সংসদে প্রতিটি আইন পাস হয়েছে ৩২ মিনিটে: টিআইবি

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:৩৭আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:৪০

টিআইবি একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ৯ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। ভারতের ১৭তম লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশে উত্থাপনসহ প্রতিটি বিল পাস করতে গড়ে প্রায় ৩২ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে। অপরদিকে ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায় প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লাগে গড়ে ১৮৬ মিনিট।

বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলদেশ-টিআইবি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ২০১৯ সালের সংসদ (প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন) কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এক ওয়েবিনারে গবেষণা প্রতিবেদন ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রকাশ করে টিআইবি।

টিআইবি বলছে, অধিকাংশ সংসদীয় কমিটিতে বিলের ওপর আলোচনায় ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। বিলের ওপর সংশোধনী এবং যাচাই-বাছাই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য বিরোধী সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়েছে। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল ৬৭ শতাংশ, অন্যান্য বিরোধী সদস্য ১৭ শতাংশ, সরকারি দল ১৬ শতাংশ (বিল উত্থাপনকারী মন্ত্রীরা) সময় ব্যয় করেছেন।

একাদশ সংসদে ৬১ শতাংশ এমপি ব্যবসায়ী

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের হলফনামায় উল্লিখিত প্রধান পেশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সর্বোচ্চ শতকরা ৬১ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী, আইনজীবী প্রায় ১৩ শতাংশ, রাজনীতিক মাত্র ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পেশার সদস্য রয়েছেন ২১ শতাংশ।

অন্যান্য পেশার মধ্যে শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিনী, পরামর্শক ইত্যাদি পেশা উল্লেখযোগ্য।

আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের শতকরা ৫৯ শতাংশ এবং জাতীয় পার্টির শতকরা ৫৬ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। অন্যদিকে ভারতের ১৭তম লোকসভায় সংসদ সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিক ৩৯%, ব্যবসায়ী, ২৩%,  আইনজীবী ৪% এবং অন্যান্য পেশার সদস্য রয়েছেন ৩৮%।

টিআইবি বিগত কয়েকটি সংসদের সদস্যদের প্রধান পেশা বিশ্লেষণ করে বলছে, প্রথম সংসদে আইনজীবীদের শতকরা হার ৩১ শতাংশ ছিল, যা ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে একাদশ সংসদে ১৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের শতকরা হার প্রথম সংসদে ১৮ শতাংশ ছিল, যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে একাদশ সংসদে ৬১ শতাংশে পৌঁছেছে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা দূরীভূত

দেশে শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা রদবদলের সম্ভানা দূরীভূত হয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের পর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, ‘অষ্টম ও নবম সংসদে সমস্যার মূল যে জায়গা ‘সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি’ অগ্রহণযোগ্য ছিল। সেটি বন্ধ হয়েছে চড়া দামে। এত বেশি চড়া দামে যে, মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনের সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা রদবদলের সম্ভানা দূরীভূত হয়েছে। তারই প্রভাব আমরা দেখতে পারছি জাতীয় সংসদের মধ্যে। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ সংসদে একদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে একচ্ছত্র ক্ষমতার সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। সংসদের মৌলিক দায়িত্ব আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহিতা এবং জনপ্রতিনিধিত্ব— এই তিনটি ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা আমরা দেখতে পারছি না।’

এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিরোধী দল থাকলে সংসদ বর্জন করে, সেই সংস্কৃতি আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। বর্জন বন্ধ হয়েছে। কারণ, কার্যকর বিরোধী দল বলতে যা বুঝায়, সেটি আমাদের কাছে নেই। এবারে সংসদে যাদের প্রধান বিরোধী দল বলা হয়েছে বা উপস্থাপন করা হয়েছে, তারা কিন্তু বিরোধী দলে বসবেন— সেই প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচন  করেন নাই। তারা ক্ষমতাসীন জোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের বসানো হয়েছে বা বসেছেন এমন একটি ভূমিকায়, যেটার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। বাস্তবে প্রধান বিরোধী দল বলতে যা বুঝায় সেটি কিন্তু অনুপস্থিত।’

প্রতিবেদনটিতে টিআইবি পর্যবেক্ষণে বলেছে, প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে বিশেষত আইন প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা আরও জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল নিয়ম রক্ষার প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে।

তিনি বলেন, ‘সংসদীয় কার্যক্রমে আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আইন প্রণয়নের আলোচনায় সংসদ সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, অনাগ্রহ ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল।’

কোরাম সংকটে ক্ষতি ২২ কোটি টাকা

২০১৯ সালের পাঁচটি অধিবেশনে মোট ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট কোরাম সংকট ছিল বলে জানিয়েছে টিআইবি। যা ৫টি অধিবেশনের প্রকৃত মোট ব্যয়িত সময়ের ১৭.৩ শতাংশ। পাঁচটি অধিবেশনে প্রতি কার্যদিবসে গড় কোরাম সংকট ছিল ১৯ মিনিট। প্রথম হতে পঞ্চম অধিবেশন পর্যন্ত কোরাম সংকটে ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য ২২ কোটি ২৮ লক্ষ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিবেশন পরিচালনার প্রতি মিনিটের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য থেকে বাস্তব অর্থমূল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ, জাতীয় সংসদের অনুন্নয়ন ব্যয় ও বিদ্যুৎ বিল ছাড়াও সংসদ পরিচালনায় আরও কিছু সেবা খাত রয়েছে, যার ব্যয় এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি এবং সর্বশেষ অর্থবছরের বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহ করতে না পারায় উক্ত বছরের হালনাগাদ তথ্যও এখানে সন্নিবেশ করা যায়নি।

অন্যদিকে ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৪ জন সদস্য (৪%) বিলের ওপর নোটিস দিয়ে আলোচনা করেছেন। যাদের মধ্যে আট জন সদস্য বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। বাকি সদস্যদের ভূমিকা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

টিআইবি বলছে, পাস হওয়া বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর মধ্যে বাক্য পুনর্গঠন, ধারা ও উপধারার পুনর্বিন্যাস এবং সমার্থক শব্দাবলী ও বিরাম চিহ্ন সংযোজন-বিয়োজন প্রাধান্য পেয়েছে।

বিল পাসের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে সরকারি দল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

অসংসদীয় ভাষা বন্ধে স্পিকার নীরব

সংসদ নিয়ে ওই প্রতিবেদনে টিআইবি বলছে, সংসদ অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের যথাযথ আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, সংসদে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শব্দের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। অধিবেশন চলাকালীন সদস্যদের বিচ্ছিন্নভাবে চলাফেরা, কোনও সদস্যের বক্তব্য চলাকালীন তার নিকটবর্তী আসনের সদস্যদেরকে নিজ আসনে বসে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন এবং সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের অমনোযোগিতা লক্ষ্য করা গেছে।

কোনও কোনও ক্ষেত্রে সদস্যদের বক্তব্যে অসংসদীয় ভাষা (কটূক্তি) ব্যবহার বন্ধে স্পিকার নীরব ছিলেন।

এসব সদস্যদেরকে তাদেরকে সতর্ক করা বা শব্দ এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে তার কার্যকর ভূমিকা পালনে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া অধিবেশন চলাকালীন গ্যালারিতে শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতি ছিল।

সংরক্ষিত নারী আসনের একজন সরকার দলীয় সদস্যের পাবলিক পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বনএবং একজন  বিরোধী সদস্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে তা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে বিক্রি করলেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি।

সংসদকে ‘কার্যকর’ করতে টিআইবি বেশকিছু সুপারিশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাস্তবিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে।

২. সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে, যেখানে স্বীয় দলের বিরুদ্ধে অনাস্থার ভোট এবং বাজেট ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে সদস্যদের নিজ বিবেচনা অনুযায়ী ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে।

৩. সংসদ সদস্যদের জন্য আচরণ আইন প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সংসদ সদস্যদের সংসদের ভেতরে এবং বাইরের আচরণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসারে নির্দেশনা থাকবে।

৪. সংসদীয় কার্যক্রম এমন হবে যেখানে সরকারি দলের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হবে।

 

/ইএইচএস/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা