X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

একাকিত্বের কারণে অস্বাভাবিক আচরণ করছে শিশুরা!

জাকিয়া আহমেদ
১৭ এপ্রিল ২০১৬, ০৮:৩০আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৬, ১১:৩৫

শিশুরা যখন একাকী

সম্প্রতি শিশুদেরও দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক  আচরণ করতে। প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো তারাও হিংস্র আচরণ করছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাকিত্বের কারণেই শিশুদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী বাবা-মায়ের অমনোযোগিতা, সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে না পারা এবং চারদেয়ালের মধ্যে বন্দিজীবন। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিগগিরই এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে শিশুদের অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।

একাকিত্বের শিকার সাত বছর বয়সী শিশু সুমাইদা। আরিফ-শম্পার দম্পতির এক মাত্র সন্তান সে। বাবা ব্যবসায়িক কারণে প্রায়ই মালায়শিয়া থাকেন। মা দেশেই ব্যসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকেন। স্কুল শেষে বাসায় ফিরে কম্পিউটার গেমস খেলে সময় কাটে তার। সম্প্রতি তার আচরণ  মারমুখী হয়ে উঠেছে বলে চিন্তিত মা শম্পা। সুমাইদা কাউকেই সহ্য করতে পারে না। অন্য শিশুদের মারধর করে। রাগ হলেই ঘরের সবকিছু ভাঙচুর করে বলেও জানান শম্পা।

একটি নামি স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র রনি (ছদ্মনাম)। তার বাবা-মা দুজনই কর্মজীবী। স্কুল শেষে প্রায় বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফেরে রনি। বাবা-মা প্রথমদিকে বিষয়টিকে ভালোভাবে নিলেও ধীরে-ধীরে তারা বুঝতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে রনি বাসায় বসে মাদক নিচ্ছে দিনের পর দিন। স্কুল থেকে আসতে শুরু করে রনির নামে নানা ধরনের অভিযোগ।

আট বছরের শিশু সাদমান। তার মা চয়নিকা জানান, সাদমান সারাদিন বাসায় একা থেকে টিভি দেখে। তার পছন্দ করে যেকোনও মারামারির অনুষ্ঠান। বিশেষ করে রেসলিং। ঠিকমতো খায় না, নিজের কোনও জিনিসের প্রতি খেয়াল নেই। চয়নিকা জানান, একা থেকে রেসলিং দেখে-দেখে ছেলেটার পরিবর্তন তিনি নিজেও টের পাচ্ছেন। বাসায় থাকা গৃহকর্মীকে ইচ্ছে হলেই চড়-থাপ্পড় দেয়। মুখে ঘুষি দেয়। এমনকি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গৃহকর্মীর ওপর—যেমনটা সে রেসলিংয়ে দেখে।  এমনকি সে নিজেও দেয়ালে ঘুষি দিতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে কয়েকবার। এরপরও এই আচরণের কোনও পরিবর্তন নেই।

আরও পড়তে পারেন: রমজান উপলক্ষে পুনর্গঠন করা হচ্ছে সরকারি বাজার মনিটরিং কমিটি

আর শিশুরা কেন এসব আচরণ করছে—জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা জানালেন, একক পরিবারে থাকা শিশুদের একাকিত্বই এসবের মূল কারণ।

সম্প্রতি পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) শিশুদের ওপর একটি জরিপ করে। সেই জরিপে থেকে জানা গেছে,  দেশের ৮ শতাংশ শিশু-কিশোর একাকিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠছে এবং তারা একা থাকতে পছন্দ করে। এর সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ। শিশু-কিশোরদের এই একাকিত্ব তাদের নানা অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলেও মন্তব্য তাদের।

এদিকে, শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের এ একাকিত্বের জন্য দায়ী পরিবেশ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। শিশু-কিশোরদের এ থেকে বের করে আনতে হলে সমন্বিতভাবে সবার কাজ করতে হবে। নয়তো আগামী প্রজন্মের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হবে।

আরও পড়তে পারেন: হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তাকে মতিনের চ্যালেঞ্জ!

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশুকিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশুকিশোরদের বেশিরভাগ মানসিক সমস্যাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে হয়। খুব অল্প সংখ্যকই হয় জিনগত প্রভাবে। অ্যাগ্রেসিভ আচরণ, বিষণ্নতা, চঞ্চলতার জন্য পরিবারের ধরন, সামাজিক পরিবেশ বেশি দায়ী থাকে। তবে এ ধরনের সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা যায় বলেও জানান ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এ জন্য দরকার শিশুবান্ধব পরিবেশ। প্যারেন্টিং স্টাইল (বাবা-মার ধরন) হতে হবে খুব ভালো। শিশুকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে, স্বনির্ভরশীলতা শেখাতে হবে। তার ওপর কোনও ধরনের  লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।  

আরও পড়তে পারেন: রাজশাহীতে ভারত সরকারের শিক্ষাবৃত্তি পেলো ৭৮ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, জিপিএ ফাইভ পেতে হবে, ডাক্তার হতে হবে, গান-নাচ শিখতে হবে—বাবা মায়ের এমন চাহিদায় শিশু একা হয়ে পড়ে। মানসিক চাপের কারণে শিশু স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। স্কুল-কলেজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিশু বিকাশের যথেষ্ট ভুমিকা রাখে না এবং বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড। স্কুলগুলো বিজ্ঞাপনে তাদের কতজন শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, সেগুলো দিয়ে অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করে। শিক্ষার পরিবেশ, খেলার পরিবেশ, খেলার মাঠ, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ রয়েছে কিনা, সেটা গুরুত্বসহ নেওয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, সামাজিক ক্ষেত্রেও দেখা যায়, শিশুদের নেগ্লেক্ট (অবহেলা) করা হয়, তাদের সামনে বড়রা এমন সব কথা বলেন, কাজ করেন, যেগুলো তাদের প্রভাবিত করে। তাই শিশুদের সামনে যদি কোনও অনৈতিকতার চর্চা করি, তাহলে তার ভেতরেও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। ফলে পরিবার, সমাজ ও তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি শিশুবান্ধব হয় এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিচালনা করা যায়, তাহলে শিশুদের অনেক মানসিক সমস্যা প্রতিরোধ করা যাবে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরিফা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশুর জীবনে আর্লি এক্সপেরিয়ান্স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাবা-মায়ের সঙ্গে অ্যাটাচমেন্ট-খুব জরুরি। সন্তানের প্রয়োজনটাকে তার জায়গা থেকে দেখতে হবে, বুঝতে হবে। একক পরিবার ক্ষতি করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বেশি ভাইবোন থাকলে শেয়ারিং করতে শেখে, অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিতে শেখে, সে একাকিত্বে ভোগে না। কিন্তু একা থাকায় শিশুর কনফিডেন্স তৈরি হয় না, মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে না।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশুদের এখন সার্টিফিকেটের জন্য পড়ানো হচ্ছে। তাদের খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। খেলার মাঠ নেই, শিশুর সব কাজ বাবা-মা বা অন্য কেউ করে দিচ্ছেন। শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য পারিবারিক, এলাকাভিত্তিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু  হচ্ছে না। শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ সমাজে অনুপস্থিত। শিশুকে নিজের কাজ নিজেকে করতে দিতে হবে। বাইরে খেলতে যেতে দিতে হবে, সারাদিন কেবল বাসা আর স্কুলের ভেতরে বন্দি করে না রাখলেই শিশু একাকিত্বে ভুগবে না।

/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কূটনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে চীন-জার্মানির কৌশলগত সংলাপ
কূটনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে চীন-জার্মানির কৌশলগত সংলাপ
বাংলাদেশি ২০ পাসপোর্টসহ ভারতীয় ট্রাকচালক আটক
বাংলাদেশি ২০ পাসপোর্টসহ ভারতীয় ট্রাকচালক আটক
করবিন-সুলতানার দল কি ব্রিটিশ রাজনী‌তি‌তে ভূমিকা রাখ‌তে পার‌বে?
করবিন-সুলতানার দল কি ব্রিটিশ রাজনী‌তি‌তে ভূমিকা রাখ‌তে পার‌বে?
সারা দেশে আগামী কয়েকদিন বাড়তে পারে বৃষ্টির প্রবণতা
সারা দেশে আগামী কয়েকদিন বাড়তে পারে বৃষ্টির প্রবণতা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল