X
মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

কওমি শিক্ষার্থীদের আলিয়ায় পরীক্ষা, কীভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা?

বেলায়েত হুসাইন
২৫ আগস্ট ২০২৩, ১৪:৫৫আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১৫:৪৫

কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান দিয়ে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে একটি আইন পাস হয়। এরপর গড়িয়ে গেলো অনেক সময় কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে যেসব মৌলিক কারণে কওমি সংশ্লিষ্টরা স্বীকৃতি গ্রহণ করেছিলেন, কার্যত সেগুলোর কোনোটিই এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। বিশেষত কওমি মাদ্রাসার যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চান এবং যাদের সরকারি নির্দিষ্ট পদগুলোতে চাকরির যোগ্যতা ও ইচ্ছা আছে কিন্তু সনদের কার্যকারিতা না থাকার কারণে ওই চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে তারা বেশ হতাশ।

ফলে এখনও বিদেশে পড়তে যেতে এবং ধর্মীয় বিষয়েও আরও নানা সুবিধা নিতে কিছু কওমি শিক্ষার্থী আলিয়া ও স্কুলে পরীক্ষা দিচ্ছেন এবং সার্টিফিকেট অর্জন করছেন। কিন্তু বহু আগে থেকেই কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা মনে করেন- তাদের একজন শিক্ষার্থী যখন কওমিতে পড়ার পাশাপাশি আলিয়াতেও পরীক্ষা দেন, তখন তার মধ্যে আমল-আখলাকের ত্রুটি দেখা দেয় এবং একইসঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানে পড়ার কারণে কোনোটিতেই আশানুরূপ যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না।

কিন্তু এখন আধুনিক যুগ, প্রতিযোগিতার যুগ। কওমির পাশাপাশি আলিয়া কিংবা স্কুলে পড়ার উদ্দেশ্য যে শুধু সার্টিফিকেট অর্জন, তা মনে করেন না অনেকে; বরং তাদের দাবি— কিছু শিক্ষার্থী সবক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে দু’টি সিলেবাসেরই শিক্ষা লাভ করতে চান এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতেও আলিয়া কিংবা স্কুলে পড়ার উপযুক্ততা আছে।

এমন পরিস্থিতিতে কওমি শিক্ষার্থীদের আলিয়ায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারটিকে কওমি আলেমরা কীভাবে দেখছেন- সে বিষয়ে জানতে কথা বলেছি দেশের অন্যতম একটি প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা রাজধানীর জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়ার মুহাদ্দিস ও দেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী ম্যাগাজিন মাসিক মদিনার সহকারী সম্পাদক মাওলানা খালেদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানান, কওমি মাদ্রাসার কিছু নির্বাচিত শিক্ষার্থীকে আলিয়া কিংবা স্কুলে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, তবে গণহারে নয়। কারণ, কওমি মাদ্রাসায় যাদেরকে পড়াশোনা করতে দেওয়া হয়, তাদের এবং তাদের অভিভাবকদের মূল উদ্দেশ্য থাকে শরঈ ও দ্বীনি ইলম অর্জন করে একজন যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে তোলা। সেক্ষেত্রে যাদের মেধা ও যোগ্যতা আছে, অভিভাবকও সচেতন এবং আলিয়ায় পরীক্ষা দিলে তাদের কওমি শিক্ষারও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই, শুধু তারাই কোনও শিক্ষক ও মুরব্বির তত্ত্বাবধানে আলিয়া বা স্কুলের পড়াশোনা করতে পারেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই ওইসব শিক্ষার্থীর নিজেদের মধ্যে কওমির স্বকীয়তা বজায় রাখা আবশ্যক। 

তরুণ প্রতিভাবান আলেম মাওলানা খালেদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা দেখি- আমাদের দেশের মানুষেরা আলেমদেরকে দুই ভাগে ভাগ করেন- ‘আলিয়ার আলেম ও কওমির আলেম। তবে ইলমি ক্ষেত্রে সাধারণ শ্রেণির মানুষের কাছে কওমি আলেমদের প্রভাবটাই বেশি। সাধারণ মানুষ মনে করেন- শরঈ ইলমে কওমি আলেমদের দক্ষতা ও গভীরতা বেশি। আর বাস্তবতাটাও এর ব্যতিক্রম নয়। এজন্য কিছু আলেম এমন থাকা দরকার, যারা শুধু শরঈ ইলম নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন।’ তবে তিনি মনে করেন- কিন্তু কেউ যদি আন্তর্জাতিকভাবে দাওয়াতি কাজ করতে চান, তাহলে এর সুবিধার্থে তিনি কওমির পাশাপাশি আলিয়া ও স্কুলেও পড়াশোনা করতে পারেন। কারণ, বাস্তবতা হচ্ছে- সাধারণত শুধু কওমির পড়াশোনা দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে খেদমত করাটা কঠিন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষার্থীকে নির্বাচিত হতে হবে এবং তার মধ্যে উপরোল্লিখিত শর্তগুলোও পাওয়া যেতে হবে।

অনেক সময় দেখা যায়- কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাবর্ষের মাঝপথে আলিয়া ও স্কুলের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, এক্ষেত্রে কওমি শিক্ষার্থীকে কি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অনুমতি দেওয়া উচিৎ- এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা খালেদুজ্জামান বলেন, ‘একথা আমি আগেই বলেছি যে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত কিছু ছাত্রকে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে; গণহারে নয়। যদি এমনটি করা হয়- আশা করি, তাহলে এতে ওই ছাত্র, মাদ্রাসা ও উম্মাহর উপকার হতে পারে। তবে এটি সম্পূর্ণ ওই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা। এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত।’

মাওলানা খালেদুজ্জামানের মতো প্রায় কাছাকাছি অভিমত মাওলানা এনামুল করীম ইমামেরও। তিনি রাজধানীর প্রসিদ্ধ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা দারুর রাশাদের মুহাদ্দিস। তিনি বলেন, ‘আমি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আলিয়ার কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণ করাকে বৈধ এবং প্রয়োজনীয় মনে করি। কারণ, প্রচুর মেধা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কওমি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সেক্টরে সেবা দিতে পারে না। আবার কওমি মাদ্রাসাগুলোর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এজন্য তারা নিজস্ব অঙ্গনে শিক্ষার্থীদের জেনারেল বিষয়েও পাঠদান করতে পারে না।’

তবে মাওলানা এনামুল করীম মনে করেন, ‘এসব কিছু হতে হবে কোনও দায়িত্বশীল শিক্ষকের অধীনে। এক্ষেত্রে শিক্ষকের দায়িত্ব হলো— মেধা ও আগ্রহ বিবেচনা করে শিক্ষার্থীকে তিনি প্রস্তুত করবেন। আর শিক্ষার্থী তার উপদেষ্টার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। এ দু’টোর সমন্বয় হলে ভালো কিছু আশা করা যায়। না হলে মিশন ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অতীত অভিজ্ঞতা অন্তত তাই-ই বলে।’

দেশের অন্যতম প্রাচীন একটি মাদ্রাসা রাজধানীর জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ। এখানকার সাবেক সহকারী শিক্ষাসচিব ও বর্তমান সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা ফয়জুল্লাহ কাসেমী। তার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। তিনি কওমির পাশাপাশি আলিয়া কিংবা স্কুলে পড়াশোনার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থীর নিয়তের ওপর ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘এক্ষেত্রে যদি উম্মাহর কাছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা অনুযায়ী সঠিক দ্বীন পৌঁছে দেওয়ার নিয়ত থাকে, তাহলে এতে আমার কাছে কোনও সমস্যা মনে হয় না। যেহেতু আমাদের কওমি সনদ দিয়ে সব ক্ষেত্রে আশানুরূপ কাজের সুবিধা পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে আমি কোনও সমস্যা মনে করি না। আর যদি শিক্ষার্থীর ভিন্ন কোনও নিয়ত থাকে- মানে সে ভাবে যে আলিয়ায় পরীক্ষা দিলে তার রিজিকের সুবিধা হবে ইত্যাদি, তাহলে তার আলিয়ায় পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘোর আপত্তি আমার।’

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাবর্ষের মাঝপথে আলিয়া ও স্কুলের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, এক্ষেত্রে কওমি শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অনুমতি দেওয়া উচিত কিনা- জানতে চাইলে মাওলানা ফয়জুল্লাহ কাসেমীও মাওলানা খালেদুজ্জামানের মতো অভিমত ব্যক্ত করে বললেন, ‘এটি সম্পূর্ণ ওই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা।’

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা

/এসটিএস/এমএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান চরমোনাই পীরের
ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান চরমোনাই পীরের
মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা মেয়রের পদত্যাগ, হবেন স্বতন্ত্র প্রার্থী
মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা মেয়রের পদত্যাগ, হবেন স্বতন্ত্র প্রার্থী
ব্যাংকে নিরীক্ষার যোগ্য ৩১ ফার্মের তালিকা প্রকাশ
ব্যাংকে নিরীক্ষার যোগ্য ৩১ ফার্মের তালিকা প্রকাশ
২৮ অক্টোবরের পর ‘নিখোঁজ’ বিএনপি নেতারা সামনে আসছেন
২৮ অক্টোবরের পর ‘নিখোঁজ’ বিএনপি নেতারা সামনে আসছেন
সর্বাধিক পঠিত
মেথি খেলে মিলবে যে ৮ উপকারিতা
মেথি খেলে মিলবে যে ৮ উপকারিতা
মনোনয়ন পেয়েছেন সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী
মনোনয়ন পেয়েছেন সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী
ভারতের হারে ‘উল্লাস’: চঞ্চলে উত্তেজনা, মোশাররফে স্বস্তি!
ভারতের হারে ‘উল্লাস’: চঞ্চলে উত্তেজনা, মোশাররফে স্বস্তি!
বদলে যাচ্ছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সূচি, কমবে ভ্রমণসময়
বদলে যাচ্ছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সূচি, কমবে ভ্রমণসময়
ডিসেম্বরেই মতিঝিল পর্যন্ত পুরোদমে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা
ডিসেম্বরেই মতিঝিল পর্যন্ত পুরোদমে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা