X
শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২

জামায়াতের রাজনীতি বন্ধের দাবি বহুদিনের

বাহাউদ্দিন ইমরান
৩০ জুলাই ২০২৪, ০২:০৫আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০২:০৫

রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের প্রসঙ্গটি বহু পুরনো। বিষয়টি গড়িয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত। তবে গত ২৯ জুলাই একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবশেষে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। ফলে দলটির নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে উঠে এসেছে নতুন করে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার

২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ৫৫টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। সেসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল ১৬৯ জন। যার মধ্যে রায় হওয়ার আগে মারা যান ১৮ জন। তাদের মধ্যে রায় হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় কারাগারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় ১৬ জনের। আর রায় হওয়ার আগে পলাতক অবস্থায় মারা যান ২ জন। মোট সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ১৪৯ জন। শিশু বয়স বিবেচনায় খালাস পায় এক আসামি।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামির সংখ্যা ১২ জন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ১০৬ জন। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ২৫ জন। সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৬ জন এবং খালাস পান একজন।

বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া এই আসামিদের অধিকাংশই জামায়াত ইসলামীর নেতাকর্মী।

জনমুখে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে দলটি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৯৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের হাতে ছাত্রনেতা রিমু হত্যাকাণ্ডের পরের দিন সংসদে এনিয়ে আলোচনা হয়। তখন সংসদে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি এবং বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মিলিতভাবে বলেছিল, এদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করার কোনও অধিকার নেই। কিন্তু দুই দিন আলোচনার পরও সেটা কার্যকর হয়নি। কারণ সরকার বলেছিল এই প্রস্তাব আসতে হবে বিরোধী দলের দিক থেকে। আর বিরোধী দল বললো এই প্রস্তাব আসতে হবে সরকারের দিক থেকে।

এছাড়াও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও রাশেদা কে চৌধুরী, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ, বিএমএ’র সাবেক সভাপতি ডা. রশীদ-ই মাহবুব, মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহিদুল বারী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. সেলু বাসিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন কনা, সমাজকর্মী এম এ সামাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য রঞ্জিত কুমার সাহা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, উঠোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি অলক দাশগুপ্ত, আনন্দন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ক এ কে আজাদ, খেলাঘরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জহির, শিক্ষক নেতা অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সবুজ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) সভাপতি গৌতম শীল প্রমুখ জামায়াতকে নিষিদ্ধ চেয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। পাশাপাশি তারা দল হিসেবেও জামায়াতের বিচার দাবি করেছেন।

আপিল খারিজ, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের রায় বহাল

২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ রিট দায়ের করেন। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আরজি জানান। 

সে রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

রুল জারির পর একই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দু'বার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুবার জামায়াত তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়। 

পরে ২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হলে যেকোনও দিন মামলার রায় দেবেন বলে জানিয়ে অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ। পরে জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ‘অবৈধ’ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ। 

সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।

২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল (লিভ টু আপিল) আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এর ফলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের রায় বহাল থেকে যায়। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে এই রায় দেন।

দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের সংশোধিত আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদে

একাত্তরে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিচারের পর দাবি ওঠে দল হিসেবে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের বিচার করার। কিন্তু সে বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন হয়ে ওঠে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনের সংশোধন।

২০১৪ সাল থেকে দীর্ঘসময় ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দল হিসেবে জামায়াত ইসলামীর বিচার ঝুলিয়ে রাখার বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ২০২৩ সালের ৬ মে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আপনাদের (সাংবাদিকদের) এটা মনে হওয়াটাও তো আমাদের (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার) জন্য দুঃখের। কারণ এই সরকারই কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করেছে এবং তারা কিন্তু জামায়াতের হোতা ছিল, প্রতিষ্ঠাতা ছিল। সেই ক্ষেত্রে আপনারা যদি মনে করেন আমরা উদ্দোগী (বিচারে) নই, তাহলে সেটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। 

তাহলে বিচার ঝুলে থাকার পেছনে কারণ কী হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, আপনারা জানেন রাজনৈতিক দল হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জামায়াতের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট যথেষ্ট নয়। এই আইনটি সংশোধন করা দরকার এবং এবং সেই সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। আমি এতটুকুই বলবো। আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন।

পরে আইনের খসড়াটির বর্তমান অবস্থান জানতে চাওয়া হলে আনিসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আইনের সংশোধনীর খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদে চলে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘জামায়াতের বিচার করতে সংশোধিত ট্রাইব্যুনালস আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় সংগঠন হিসেবে দোষী প্রমাণিত হলে সে সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইনটির বেশ কিছু ধারায় ‘ব্যক্তি’ শব্দের পর ‘অথবা সংগঠন’, ‘দায়’ শব্দের পর ‘অথবা সাংগঠনিক দায়’, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ শব্দের পর ‘অথবা সংগঠন’ যুক্ত করারও উদ্যোগ নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।     

/এফএস/
সম্পর্কিত
পর্নোগ্রাফি প্রচারের অভিযোগে ২ নারী কারাগারে
জামায়াত নেতার ‘কলিজা ছিঁড়ে ফেলার’ হুমকি দেওয়া বিএনপি নেতাকে শোকজ
জবি শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা: প্রেমিক কারাগারে
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশ সব বকেয়া পরিশোধ করবে, আশাবাদী আদানি পাওয়ার
বাংলাদেশ সব বকেয়া পরিশোধ করবে, আশাবাদী আদানি পাওয়ার
গরুর হাট না বসানোর দাবিতে রাস্তায় আফতাবনগরবাসী
গরুর হাট না বসানোর দাবিতে রাস্তায় আফতাবনগরবাসী
আ.লীগ নিষিদ্ধে জনগণ যদি-কিন্তু শুনতে চায় না: হাসনাত আব্দুল্লাহ
আ.লীগ নিষিদ্ধে জনগণ যদি-কিন্তু শুনতে চায় না: হাসনাত আব্দুল্লাহ
আ.লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে: সারজিস আলম
আ.লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে: সারজিস আলম
সর্বাধিক পঠিত
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয় আটক
এনবিআরের বিভক্তিতে সুফল মিলবে?
এনবিআরের বিভক্তিতে সুফল মিলবে?
রবিবার দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া
রবিবার দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া