নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব, নতুন কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন বিষয় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জানানোর নিয়ম রয়েছে। দলগুলোর দেওয়া তথ্য ইসি তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু, গত একবছরে ইসির এসব রুটিন কাজে শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল গত ১২ মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদের কাযকরী বা নির্বাহী কমিটিতে সংশোধন বা পরিবর্তন এনে সে তথ্য ইসিকে সরবরাহ করেছে বলে দাবি করেছে। তবে ইসি এখনও তাদের ওয়েবসাইটে সেসব তথ্য হালনাগাদ করেনি। ইসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট দেখে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের ছোট এই ভুলে বিভ্রান্তির তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে এই বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে ও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ইসি উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে সঠিক ও আপডেট তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরা। কিছু রাজনৈতিক নেতা এটাকে ইসির খামখেয়ালিপনার চিত্র বলেও মনে করছেন।
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিল করে দলটির সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার স্থলে নতুন সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয় ড. রেজা কিবরিয়াকে। এই পরিবর্তনের এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও ইসি দলটির তথ্য হালনাগাদ করেনি। ইসি (http://www.ecs.gov.bd/page/politacal-party-new) ওয়েবসাইটে গণফোরামের বর্তমান সভাপতি ড. কামাল হোসেনের পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এখনও ছবিসহ উল্লেখ করা আছে মোস্তফা মহসিন মন্টুর নাম।
এ বিষয়ে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন হওয়ার পরেই নির্বাচন কমিশনকে সেটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। এরপর তারা কেন পরিবর্তন করে নাই আমরা বলতে পারবো না। আসলে নির্বাচন কমিশনের কোনও কিছু ঠিক নেই। সুতরাং তাদের কাছ থেকে সঠিক কিছু আশা কেন আপনারা করেন আমি জানি না।’
গণফেরামের মতো একই অবস্থা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত আরও কয়েকটি দলের। এসব দলগুলোর সাধারণ সম্পাদকের পদে পরিবর্তন হলেও ইসির ওয়েবসাইটে পূর্বের সাধারণ সম্পাদক নাম ও ছবি এখনও বহাল রয়েছে।
ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তরিকত ফেডারেশন থেকে দলটির মহাসচিব পদে থাকা এম এ আউয়ালকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু ইসির ওয়েবসাইটে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এখনও আউয়ালের নাম বহাল আছে। অবশ্য শুরু থেকেই তার ছবি ব্যবহার করতে পারেনি ইসি।
তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে দলের মহাসচিব পদ থেকে এম এ আউয়ালকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। নতুন করে মহাসচিব করা হয় সদস্য সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীকে। এই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনে লিখিত চিঠি দিয়েছি। তার কপি এখনও আমার কাছে আছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দলের মহাসচিব পরিবর্তন হলেও ইসি তা ঠিক করেনি। সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে আমাকে কয়েকজন ফোন করেন। এরপর আমি আবারও ইসিকে চিঠি দিয়েছি যে সঠিক নামটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। কিন্তু, তারা কেন এটা করে নাই আমি বলতে পারবো না। আমি মনে করি, সঠিক নাম অন্তর্ভুক্ত না করে কমিশন অন্যায় করেছে।
২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ব্যক্তিগত কারণে দেখিয়ে কল্যাণ পার্টির মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি নেন দলটির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান। একই বছরের ডিসেম্বরে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয় মো. নুরুল কবির ভুইয়াকে। তিনি এখনও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে এখনও দলটির মহাসচিব হিসেবে দেখানো হচ্ছে আমিনুরকে।
কল্যাণ পার্টির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলটির যুগ্ম মহাসচিব আমিন ভুঁইয়া রিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট আপডেটের দায়িত্বে যিনি আছেন তাকে ফোন করে দলের মহাসচিব পরিবর্তন ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বিষয়টি জানিয়ে ছিলাম। এরপর কেন পরিবর্তন হয়নি জানি না। তবে দলের মহাসচিব পরিবর্তনের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে জানানো হয়নি বলে স্বীকার করেন তিনি।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাঙন নতুন কিছু নয়। গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলে ভাঙনের ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত জেএসডি ও জাগপাতেও ভাঙন ধরে।
গত বছর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ভেঙে যায়। দলটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতনের নেতৃত্বে একটি অংশ বেরিয়ে এসে জেএসডি নামে আরেকটি দল গঠন করে। যদিও তাদের দলের এখনও সম্মেলন হয়নি। দলটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়া খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরাও জেএসডি নামে দল গঠন করেছি। কিন্তু, করোনার কারণে আমাদের দলের সম্মেলনে করা হয়নি। আমরা এই নামেই ইসির কাছে নিবন্ধন চাইবো।
অন্যদিকে, আ স ম রবের নেতৃত্বধীন অংশের সম্মেলন হয় গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর। সেই সম্মেলনে দলটির সভাপতি পদে পুনর্বহাল হন আ স ম আব্দুর রব। আর সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে অ্যাডভোকেট সানোয়ারকে। দলের সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তনের বিষয়টি লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনেও জানানো হয় জেএসডির পক্ষ থেকে। কিন্তু ইসির ওয়েবসাইটে এখনও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ রয়েছে আবদুল মালেক রতনের নাম।
জেএসডি সহ-সভাপতি তানিয়া রব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কাউন্সিলের পরে দলের সাধারণ সম্পাদক পদের পরিবর্তনসহ অন্যান্য বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। পরবর্তীতে ইসি থেকেও দলের গণতন্ত্রে কোনও পরিবর্তন এসেছে কিনা তা জানতেও আমাদেরকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন তারা ওয়েবসাইটে বিষয়টি পরিবর্তন করেনি তা বলতে পারবো না। তবে মনে হয় করোনাভাইরাসের কারণে এটি হতে দেরি হচ্ছে।
একইভাবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গত বছরের ৩০ জুন জাতীয় গণতান্ত্রিক পাটির (জাগপা) সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান। এরপর গত ৬ ডিসেম্বর দলটির সম্মেলনে পূর্ণাঙ্গ সভাপতি হন তাসমিয়া প্রধান আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন অধ্যাপক ইকবাল হোসেন। কিন্তু ইসির ওয়েবসাইটে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এখনও নাম আছে লুৎফরের নাম।
খন্দকার লুৎফর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি এখন তাসমিয়ার জাগপায় নেই। নতুন জাগপার সভাপতি আমি আর সাধারণ সম্পাদক শাহদাত। জাগপার নিবন্ধন আমাদের নামে দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছি। কমিশন থেকে পুনরায় আমাদেরকে আরেকটা চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেই চিঠির জবাব আমরা এখনও দিতে পারি নাই। পরিস্থিতি ঠিক হলে তার উত্তর দেবো।
তথ্য হালনাগাদ না করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব ফরহাদ আহম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুই একটা রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিষয় থাকতে পারে। আমরা বিষয়টি যাচাই করে দেখবো। যাদের তথ্য ওয়েবসাইটে হালনাগাদ নেই সেগুলো শিগগিরই হালনাগাদ করে দেওয়া হবে।