বিচার, মর্যাদা, সংস্কারের দাবিতে স্মরণে ও কান্নায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধারা। শুক্রবার (৪ জুলাই) গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে গণসংহতি আন্দোলনের মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে আয়োজিত এই সম্মিলন থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও হামলার বিচারের দাবি জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে যাত্রাবাড়ী এলাকার শহীদ মইনুলের স্ত্রী মায়মুনা ইসলাম অভিযোগ করেন, একজন শহীদের স্ত্রী হয়েও তিনি হত্যা মামলার আসামি হয়ে ঘুরছেন। তিনি একজন শিক্ষার্থী ও পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
শহীদ মাসুদ রানার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা অভিযোগ করেন, আমাদের এক বছর কেউ মনে রাখেনি, আজ এক বছর পর মনে পড়লো। শহীদ পরিবার এখনও স্বীকৃতি পায়নি। এখনও বিচার হয়নি।
আহত জুলাইযোদ্ধা নাহিদ হাসান বলেন, আমি যে বেঁচে আছি, এটা বোনাস। শহীদ হলে নাম নিশানা মুছে যেতো।
শহীদ সানির মা রহিমা বেগম বলেন, আমরা এমন একটা বাংলাদেশ চাই, যেখানে আর কেউ হাসিনার মতো হতে পারবে না। আমরা হাসিনার আমলের মতো শহীদ বা আহতদের চৌদ্দগোষ্ঠীর চাকরি চাই না। হাসিনা পালিয়ে গেছে, কারণ ওখানে তার জায়গা আছে। এই দেশ ছাড়া আমাদের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।
শহীদ মীর মুগ্ধর বাবা মীর মুস্তাফিজ বলেন, জাতির স্বার্থে এক থাকুন। যত মতভেদ থাকুক, দেশের সংস্কারের জন্য একমত থাকুন। নির্বাচনের আগেই যেসব সংস্কার সম্ভব—সেগুলো করুন। আগামী নির্বাচনে উচ্চকক্ষ পিআর পদ্ধতি হলে ভালো হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাভিন মুরশিদ বলেন, শহীদ পরিবার বিচার চাইতে গেলে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা এখনও হয়নি। এগুলো দুঃখজনক।
শহীদ মনির হোসেনের স্ত্রী রেহানা বেগম বলেন, এক বছর হয়ে গেল আজও আমার স্বামীর লাশ পাইনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, শ্রমজীবী মানুষেরা উপেক্ষিত হয়েছেন বারবার, আমরা নতুন বাংলাদেশে এই উপেক্ষা আর দেখতে চাই না। ২৬ জন শ্রমিক শাহাদাতবরণ করেছেন।
দৃকের প্রতিষ্ঠাতা শহীদুল আলম বলেন, যারা এখন সরকারে রয়েছে কেউ বুক পাতেনি, কেউ গুলি খায়নি। যারা বুক পেতেছে, তাদের সম্মান নিশ্চিত না করলে ইতিহাসে তারা বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
সম্মিলনের সভাপতির বক্তব্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ২০২৪ সালে এ দেশের মানুষ বুক চিতিয়ে এক মরণপণ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন। আমরা শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, যে কৃতজ্ঞতা অবশ্যই আমাদের রাজনীতিতে প্রতিফলিত হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও আমাদের দল এই রক্তের ঋণ মনে রাখবে। এ দেশের রাজনীতিতে যদি এই রক্তের সঙ্গে বেইমানি শুরু হয়, আমরা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো। আসছে ৫ আগস্টের আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা ব্যাখ্যা চাই, কেন এতদিনেও শহীদের মর্যাদা নিশ্চিত করা হলো না। আমরা স্পষ্টভাবে জানতে চাই, কতদিনের মধ্যে ও কীভাবে শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হবে, সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে এবং তাদের জীবনের দায়িত্ব নেওয়া হবে।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ৫ আগস্টের আগেই আমরা ন্যায়বিচারের যথাযথ দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই। দেশের অর্থনীতির পুনর্গঠন, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও তাদের জীবনের সংকটের সমাধান করতে হবে। অভ্যুত্থানের সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে জনগণের সব সংকট মোচনের জন্য সর্বোচ্চ দায়িত্ব নেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। আমাদের ঐক্যবদ্ধতাই সংস্কার নিশ্চিত করতে পারবে। আগামী নির্বাচনে ভোট হবে সংস্কারকে প্রতিষ্ঠিত করার হাতিয়ার। ৫ আগস্ট আমাদের অর্জিত বিজয়কে সুরক্ষিত করার জন্য জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি দরকার।
তিনি বলেন, আহতরা যখন বারবার বলছেন, আর্তনাদ করছেন, তখন সরকারের কাছে এ বিষয়ে যথেষ্ট ব্যাখ্যা চাই। কবে শহীদের তালিকা পাবো। একজন আহতও যেন বিনা চিকিৎসায় না থাকেন। যারা আহত, তাদের দায়িত্ব নিতে সরকারকে, পুনর্বাসন শব্দ শুনতে চাই না।
জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের সম্মিলন, অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষা ও বর্তমান পরিস্থিতি শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে সাকি বলেন, একজন শহীদের স্ত্রী বলেছেন তার নামেই মামলা করা হয়েছে। শহীদের পরিবারের বাকি জীবনের দায়িত্ব নিতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে।
গণসংহতির এই নেতা বলেন, আমরা আপনাদের ওপর আস্থা হারাইনি। কিন্তু আহতদের চিকিৎসা, শহীদ পরিবারের কর্মসংস্থান, অর্থনীতি পুনর্গঠন প্রাধান্য পাবে।
জনগণ এই অভ্যুত্থান থেকে কী পেলো, সে হিসাবও সরকারকে করার আহ্বান জানান জোনায়েদ সাকি।
সম্মিলনে আরও বক্তব্য রাখেন শহীদ জুলফিকার শাকিলের মা আয়েশা বিবি, শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুইয়া, শিক্ষক হাসান আশরাফ, শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বাবা মাহবুবুর রহমান, নির্মাতা আকরাম খান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা উমামা ফাতেমা, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, আইনজীবী হুমায়রা নূর, শহীদ ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন, শহীদ মইনুলের স্ত্রী মায়মুনা ইসলাম, শহীদ রমিজ উদ্দিনের বাবা একেএম রকিবুল ইসলাম, জুলাইযোদ্ধা আল আমিন, জুলাইযোদ্ধা মাওলানা শফিকুর রহমানসহ শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত যোদ্ধারা।