X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জেলা দল নির্বাচনে ঘুষের অভিযোগ, তদন্ত করবে বিসিবি

রবিউল ইসলাম
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:২৩আপডেট : ১২ মে ২০২৪, ১৯:১৫

বাগেরহাটে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মনোনীত কোচ আবু তাহেরের বিরুদ্ধে এক ক্রিকেটারের কাছে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ওই কিশোরের দাবি, ৩০ হাজার টাকা ঘুষ না দেওয়ায় অনুশীলনে ভালো করা সত্ত্বেও অনূর্ধ্ব-১৬ বাগেরহাট জেলা দলের হয়ে তিনটি ম্যাচে খেলার সুযোগ পায়নি সে। জেলা ক্রিকেটে দুর্নীতির অভিযোগটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। বোর্ড কর্তাদের ভাষ্য, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ওই কোচকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হবে।

বাগেরহাটের ওই ক্রিকেটার জানায়, ২০১৮ সালে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিল সে। কিন্তু ক্রিকেট অনুশীলনে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে খরচ হবে শুনে বিমর্ষ মনে বাগেরহাটে ফিরে যায়। তবে দমে যায়নি। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ঠিকই মনে পুষে রেখেছে। একদিন বাবার পকেট থেকে ৮ হাজার টাকা নিয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যায় এই কিশোর। সেখানে নানার কাছে গিয়ে ভর্তি হয় পোর্ট সিটি ক্রিকেট একাডেমিতে। বাবার কাছ থেকে চুরি করা টাকার একটি অংশ দিয়ে কেনে ক্রিকেট সরঞ্জাম। চট্টগ্রামে দারুণ খেললেও জন্মসূত্রে খুলনা বিভাগের হওয়ায় সেখানে থিতু হতে পারেনি। অগত্যা বাগেরহাটে এসে সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল সে।

চলতি মাসে অনূর্ধ্ব-১৬ বিভাগীয় পর্যায়ের দল চূড়ান্ত হবে। এর অংশ হিসেবে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নড়াইলে তিনটি ম্যাচ খেলতে যাবে বাগেরহাটের সেরা ১৫ ক্রিকেটার। এগুলোতে ভালো পারফরম্যান্স দেখানো ক্রিকেটাররা খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ের ক্যাম্পে সুযোগ পাবে। তাদের মধ্য থেকে ১৫ জন চূড়ান্তভাবে জায়গা করে নেবে খুলনা বিভাগ দলে।

এর আগে বাগেরহাটে বাছাই করা ৩৫ জন ক্রিকেটারকে নিয়ে দুটি ম্যাচ আয়োজন করা হয়। এগুলোতে একটি অর্ধশতকসহ ৫৭ রান করেও ১৫ জনের ক্যাম্প থেকে বাদ পড়েছে ওই কিশোর। তার অভিযোগ, ঘুষ না দেওয়ায় জায়গা পায়নি সে।

কিশোর এই ক্রিকেটার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছে, ‘এ ধরনের ঘটনা কেবল আমার সঙ্গেই ঘটেছে তা কিন্তু নয়, অনেক ক্রিকেটারই এমন দুর্নীতির শিকার। কিন্তু তারা ক্যারিয়ার বাঁচাতে মুখ বুঝে সব সহ্য করেছেন। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাই মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছি। বাবা-মাকে বুঝিয়ে শেষবারের মতো ক্রিকেটার হওয়ার সুযোগ চেয়েছিলাম। কিন্তু দুর্নীতিবাজ কোচ তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।’

এরপরই ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেছে এই ব্যাটার, “দুই ম্যাচ থেকে নড়াইলে খেলার জন্য দল গঠনে সেরা ১৫ জনকে বেছে নেওয়ার কথা ছিল। আমাকে বলে দেওয়া হয়, ভালো খেললে আমার সুযোগ থাকবে। অনুশীলনে আমার পারফরম্যান্স খুব ভালো ছিল। এরপর দুই ম্যাচের প্রথমটিতে হাফ সেঞ্চুরি এবং দ্বিতীয় ম্যাচে ৭ রান করি। প্রথম ম্যাচে ৯৩ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ি। অর্ধশতক হাঁকানোর পর তাহের স্যার আমাকে ডেকে বলেন, ‘তুই তো ভালো করলি, ৩০ হাজার টাকা ম্যানেজ কর, জেলা দলে সুযোগ করে দেবো।’ তখন তার সঙ্গে মোস্তফা স্যারও ছিলেন। আমি ভেবেছি, তারা মজা করে বলেছেন। তাই হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, আপনারা কি মজা করছেন? আপনারা তো জানেন আমি পরিবারের সাপোর্ট পাই না। এরপর আর স্যারদের কথাটা নিয়ে সেভাবে ভাবিনি। সতীর্থদের আশা ছিল, আমি অনায়াসেই ১৫ জনের ক্যাম্পে সুযোগ পেয়ে যাবো।”

দ্বিতীয় ম্যাচে নামার পর ওই ক্রিকেটার ভিন্ন কিছু আঁচ করতে পারে। তার অভিযোগ, ‘দ্বিতীয় ম্যাচে একটি চারে ৭ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরি। যদিও রান আউটটি নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। কারণ আমার পা ক্রিজের ভেতর থাকার পরও উইকেট কিপার লং থ্রোতে আমার স্ট্যাম্প ভাঙার পর আম্পায়ার আউট দেন। ম্যাচ শেষে উইকেট কিপার ছেলেটা আমাকে এসে বলে– সরি ভাই ওইটা আউট ছিল না।”

এরপরই দুর্নীতির সাক্ষী হতে হয়েছে বলে অভিযোগ বাগেরহাটের এই ক্রিকেটারের, ‘যখন নড়াইলে যাওয়ার জন্য ১৫ জনের নাম ঘোষণা করা হলো তখন দেখি সত্যিই আমি নেই। তখনই বুঝতে পেরেছি, কোচকে টাকা দিতে পারিনি বলেই আমাকে রাখা হয়নি। দুটি ম্যাচে ৫ রান করেছে একটা ছেলে, সে দলে আছে। দুই ম্যাচে হয়তো ১৫ রান করেছে, সেও জায়গা পেয়েছে। কিন্তু আমি প্রথম ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করার পরও নেই। অথচ পরিবার থেকে আর্থিক ও মানসিকভাবে কোনও সাপোর্ট পাইনি। আমার চ্যালেঞ্জ ছিল, যেভাবেই হোক রান করে দলে সুযোগ করে নেবো। কারণ এটাই আমার শেষ সুযোগ ছিল। পরিবারকে অনেক অনুরোধ করে বলেছিলাম, তোমরা একটা বছর আমার পেছনে টাকা খরচ করো। এরপর আমিই আমার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবো। কিন্তু কোচেরা আমাকে বাদ দিয়ে দিলো।’

যদিও কোচ আবু তাহের এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করেছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি যে বিষয় জানি না এবং যে কাজটা করিনি সেটা নিয়ে কী বলবো? এই ছেলের সঙ্গে আমার কোনও ধরনের কথাই হয়নি। যার কোনও প্রমাণ কিংবা ভিত্তি নেই, আপনারা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন! আমার তো ক্ষতি হবে না। বরং আমাকে কিছু লোক চিনলো, আমার সম্পর্কে জানলো! বাগেরহাটের সোয়া দুই লাখ লোক আমাকে এক নামে চেনে। আমার পকেটের টাকায় অনেক ক্রিকেটারের পড়ালেখা চলে। যে ছেলে এই অভিযোগ করেছে, সে তো বাগেরহাটে খেলেইনি। সে চট্টগ্রামেই বেশি ক্রিকেট খেলেছে। তার পারফরম্যান্স সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। এলবিডব্লিউ নেই এমন একটা অনুশীলন ম্যাচে সে হাফসেঞ্চুরির দাবি করলো, অথচ আমাদের স্কোরশিট অনুযায়ী সে ৩৫ রান করেছে।’

নিজেকে নির্দোষ উল্লেখ করে আবু তাহেরের দাবি, ‘বাগেরহাটে ৯টি উপজেলা আছে, কোথাও আমার সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ কেউ করতে পারবে না। ২১ বছর ধরে ক্রিকেট খেলি আমি। মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে শুরু করেছিলাম। আমার হাতে পেসার রুবেল হোসেন তৈরি হয়েছে। মেহেদি হাসান মিরাজ যখন অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছে, আমি তখন কোচ। দীর্ঘদিন ধরে আমি কোচিংয়ে। আমি কীভাবে এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারি?’

স্কোরশিট দেখতে চাইলে আবু তাহের তাতে অস্বীকৃতি জানান, ‘আপনাকে কীভাবে অনুশীলন ম্যাচের স্কোরশিট দেবো? অনুশীলন ম্যাচের স্কোরশিট অফিসিয়াল ম্যাচের কোনও স্কোরশিট নয়। অনুশীলন ম্যাচের স্কোর সাদা কাগজে লেখা হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে সেটি বোর্ডকে দিয়েছি। ছেলেটা যা করেছে তাতে আমার জেলা এতক্ষণে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতো। কিন্তু বোর্ড যেহেতু আমাকে ডেকেছে, বোর্ডকেই উত্তর দেবো।’

জেলা দলের জন্য ক্রিকেটার নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে আবু তাহেরের যুক্তি, ‘একটা স্কোয়াডে সাধারণত তিন জন পেসার, ছয় জন ব্যাটার, তিন জন স্পিনার, দুই জন উইকেট কিপার রাখা হয়। আমি ৩৫ জনের মধ্য থেকে সেরাদের নেবো? নাকি সাধারণ একজনকে দলে টেনে জেলাকে হারানোর বন্দোবস্ত করবো? আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কর্তৃক নিয়োগকৃত বাগেরহাট জেলার কোচ। আমি কিন্তু জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যনিবাহী সদস্য। এখানে জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব কমিটি আছে। তারাই মূল দল নির্বাচন করে। এখানে আমার দায়টা কী সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’

জানা যায়, স্থানীয় কোচ আবু তাহেরের পাশাপাশি অভিযোগকারী কিশোর ক্রিকেটারকে ডেকেছে বিসিবি। তারা দুই পক্ষের কথা শুনতে চায়। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হবে বলে জানালেন বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ সুজন, ‘এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। তদন্তের পরই নির্দিষ্টভাবে বলা যাবে। আমরা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। দুই পক্ষের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনতে হবে আমাদের। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে।’

তদন্তে স্থানীয় কোচের দুর্নীতির প্রমাণ পেলে তাকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হবে বলে জানালেন সুজন, ‘কিছু প্রমাণ হলে শাস্তি তো অবশ্যই পেতে হবে। তার কোচিং ক্যারিয়ারই থাকবে না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে। টাকার বিনিময়ে দলে জায়গা করে দেওয়ার কথা বললে সেই দায় তো কোনও কোচ এড়াতে পারবে না। অবশ্যই আমরা এ অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করবো।’

বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা তো আমার বিভাগের ইস্যু নয়। তবুও আমার বিশ্বাস, এ ধরনের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে হবে। সত্যিকার অর্থে যদি কোচদের নামে এমন কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে বিসিবি বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না। এমন ব্যাপারে বিসিবি বরাবরই শক্ত।’

বাগেরহাটের ওই ক্রিকেটারের অভিযোগ কতটা সত্যি তা তদন্ত সাপেক্ষে বোঝা যাবে। তবে এমন ঘটনা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কখনোই প্রত্যাশিত নয়। সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য, জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ের ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রতিভাবান কেউ দুর্নীতির শিকার হলে ভবিষ্যতের সাকিব-তামিম খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হবে।

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
‘ভেবেছিলাম দেশের সমস্যা ক্ষণস্থায়ী, এখন আরও বেড়েছে’
এতিমখানার অনুদানের টাকা দিতেও ঘুষ গ্রহণ: দুদকের অভিযান
সাবেক এমপি পাপুলের শ্যালিকা ও দুই কর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
সর্বশেষ খবর
মধুসূদন দত্তের বাড়িতে এসে দর্শনার্থীরা করেন প্রশ্ন, শিক্ষার্থীরা তোলে সেলফি
মধুসূদন দত্তের বাড়িতে এসে দর্শনার্থীরা করেন প্রশ্ন, শিক্ষার্থীরা তোলে সেলফি
মাঠে গরু আনতে গিয়ে বজ্রাঘাতে বাবার মৃত্যু, ছেলে আহত
মাঠে গরু আনতে গিয়ে বজ্রাঘাতে বাবার মৃত্যু, ছেলে আহত
অপরিপক্ব ফলে সয়লাব রাজধানীর বাজার, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
অপরিপক্ব ফলে সয়লাব রাজধানীর বাজার, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
কিরগিজে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ভালো আছে
কিরগিজে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ভালো আছে
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি