তিন দিনব্যাপী ২৯তম জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতা ২০২৫ শেষ হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের মধ্য দিয়ে। রাজধানীর মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে গত ৯ থেকে ১১ মে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় ৮৭টি দলের প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেছেন।
প্রতিযোগিতায় মারামারি, রেফারিদের পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত, ফিক্সচারে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও আর্মি কারাতে দলের কোর্চ মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টুর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে এবারে ২৯তম জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতার স্বচ্ছতা নিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
রেফারি কমিশনে ‘নিজের লোক’
এবারের তিন দিনব্যাপী ২৯তম জাতীয় কারাতে প্রতিযোগীতায় ৭৩ জন রেফারি অংশ গ্রহণ করেছেন। এরমধ্যে রেফারি পরিচালনার জন্য ফেডারেশনের গঠিত ১৩ সদস্যের রেফারি কমিশনে ছয়জনই ছিল সাধারণ সম্পাদক সেন্টুর ব্যক্তিগত সংগঠন ‘সোতোকান কারাতে কিউকাই’-এর নির্বাহী কমিটির সদস্য। এতে রেফারি কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, সেন্টু তার দলের খেলোয়াড়দের বাড়তি সুবিধা দিতে রেফারি দিয়ে অনিয়মের বলয় গড়ে তুলেছেন।
বিচারকের পক্ষপাত, প্রমাণসহ অভিযোগ
প্রতিযোগিতা চলাকালীন দ্বিতীয় দিনে মাইনাস ৫০ কেজি ওজনের পুরুষ ইভেন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যকার একটি ম্যাচে সেনাবাহিনীর পরাজিত খেলোয়াড়কে জয়ী ঘোষণা করা হয়। পরে ভিডিও রিভিউ করে সিদ্ধান্তটি পাল্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনীর দলের রিভিউ চলাকালীন সময়ে নিয়ম ভঙ্গ করে তাদের কোচ ও কর্মকর্তারা রেফারিদের ঘিরে রাখেন এবং সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেন। এভাবে আরও অনেক ইভেন্টে রেফারিরা পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ করেন বিভিন্ন দলের কোচ ও খেলোয়াড়রা।
লাইসেন্সবিহীন ও অযোগ্য রেফারি দিয়ে খেলা পরিচালনা
কারাতে ফেডারেশনের নীতিমালা অনুযায়ী ‘জাজ-বি’ গ্রেডধারী রেফারিরা জাতীয় প্রতিযোগিতায় দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। অথচ এবারের আসরে বিপুল সংখ্যক জাজ-বি গ্রেডের রেফারি এবং এমনকি কিছু লাইসেন্সবিহীন রেফারিকেও দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়, যারা প্রধানত সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত সংগঠনের সদস্য।
অংশগ্রহণকারী দলের অভিযোগ
এবারের আসরে ব্যাপক অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনে বিভিন্ন দলের কোচ ও ম্যানেজাররা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড কারাতে দলের কোচ মো. নূর হোসেন লিখিত অভিযোগে জানান, প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী বিজিবির দুটি কাতা দল আলাদা গ্রুপে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও ফিক্সচারে দু্ই দলকে একই গ্রুপে রাখা হয়, যা স্পষ্টত বিশ্ব কিংবা বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের নিয়মবহির্ভূত।
অন্যদিকে বাংলাদেশ আনসার কারাতে দলের টিম ম্যানেজার সৈয়দ নুরুজ্জামান তার লিখিত অভিযোগে জানান, একটি ম্যাচে রেফারির পরিবর্তনের মৌখিক অনুরোধ জানালে রেফারি কমিশনের চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন তার সঙ্গে উগ্র ও অসম্মানজনক আচরণ করেন এবং হুমকি দেন। তিনি এই আচরণকে দেশের কারাতে অঙ্গনের জন্য মানহানিকর বলে উল্লেখ করেন।
প্রশ্ন ফাঁস ও গোপনে ফিক্সচার তৈরির অভিযোগ
প্রতিযোগিতার মাত্র এক দিন আগে রেফারি লাইসেন্সিং পরীক্ষার আয়োজন করে কারাতে ফেডারেশন। অভিযোগ রয়েছে পরীক্ষার আগেই পরিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছিল। তাছাড়া প্রতিদিন গভীর রাতে কোচদের অনুপস্থিতিতে গোপনে ফিক্সচার তৈরি করা হয়েছে। যেখানে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সেন্টার নিজস্ব দলের খেলোয়াড়দের জন্য সুবিধাজনক সময় ও প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করা হতো।
অভিযোগের পাহাড়, তদন্তের দাবি
২৯তম আসরকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত কারাতে ফেডারেশনের কাছে রেফারি দুর্নীতি, খেলা পরিচালনায় পক্ষপাত এবং মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টুর বিরুদ্ধে অন্তত ৩২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এরমধ্যে রেফারির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিছু অভিযোগ আসার ব্যাপারে শুনেছি। একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিকে তারা আমার কাছে লিখিত বক্তব্য চেয়েছে। যথাসময়ে ফেডারেশনকে লিখিত ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।’
অন্যদিকে সেন্টুর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে কারাতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতি বছর কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, এটা নতুন কিছু নয়। কারণ তারা নিজেরা ফেডারেশনে আসতে চায় কিন্তু যোগ্যতা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি একটি দলের কোচ হলেও খেলার সময় কোচ হিসাবে দায়িত্ব পালন করিনি। আমি পুরো প্রতিযোগিতা পরিচালনায় ছিলাম। একটি ইভেন্টের ফিক্সচারের সমস্যা হয়েছিল, সেটা সবার সামনে ঠিক করা হয়েছে। এখানে কোনও অনিয়ম করা হয়নি।’
তদন্তের সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কারাতে ফেডারেশন সভাপতির শাহজাদা আলম বলেন, ‘২৯তম জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতা ঘিরে একাধিক অভিযোগের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতা উপলক্ষে নানা অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এবং তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
রেফারিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে স্বীকার করে ফেডারেশন সভাপতি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে রেফারিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন ওঠে। এবারও কিছু অভিযোগ উঠেছে। আমরা চেয়েছিলাম রেফারিরা নিরপেক্ষ থাকবেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা খুব একটা পারা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে রেফারি এনে খেলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে খেলায় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে আরও কঠোর ও স্বচ্ছ নীতি গ্রহণ করা হবে, যাতে এ ধরনের বিতর্ক আর না ঘটে।’
কারাতে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জাতীয় পর্যায়ের এ ধরনের অনিয়ম শুধু খেলোয়াড়দের মনোবল ভাঙে না, বরং সরকারের ক্রীড়াঙ্গনে সুশাসনের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারা দাবি জানান, ২৯তম জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতার সব অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।