সময়ের পরিক্রমায় এসেছে নতুন বছর। চোখ বন্ধ করলেই স্মৃতিতে ভেসে উঠে পুরাতন বছরের নানা ঘটনাপ্রবাহ। উঠে আসে সফলতা ও ব্যর্থতা। তেমনিভাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নানা সফলতা ও কিছু ব্যর্থতার ঘটনা ঘটেছে। এই খাতের উন্নয়নে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, দেশব্যাপী ইন্টারনেট সপ্তাহ আয়োজন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল পলিসি, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মতো যেমন অনেক অর্জন রয়েছে, তেমনিভাবে সাময়িকভাবে ইন্টারনেটসহ সামাজিক মাধ্যম বন্ধের মতো অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতাও রয়েছে।
নানা সফলতায় ২০১৫
একাধিক সম্মেলন আয়োজন: গত বছরের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অন্তত ৪টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন, প্রদর্শনী কিংবা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। ফ্রেব্রুয়ারিতে আইসিটি বিভাগ ও আমাদের বেসিসের আয়োজনে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও প্রদর্শনী ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০১৫’, মে মাসে আইসিটি ডিভিশন, বেসিস, টেলিনর একসেঞ্চার যৌথভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রথম আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন ‘ডিজিটাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট’, সেপ্টেম্বরে বেসিস, আইসিটি ডিভিশন ও গ্রামীণফোন মিলে দেশের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট উৎসব- ‘বাংলাদেশ ইন্টারনেট উইক ২০১৫’, ডিসেম্বরে আইসিটি ডিভিশন ও বাক্য মিলে ‘বিপিও সামিট’ -এর আয়োজন করা হয়। এগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরা, দেশে সফটওয়্যার ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি, এক কোটিরও বেশি মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে। সবগুলো আয়োজনেই বেসিসসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যান্য সংগঠনগুলো যৌথভাবে কাজ করেছে। এ চারটি আয়োজন দেখলেই মনে হয় বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির পরবর্তী গন্তব্যস্থল হতে বেশি দেরি নেই!
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: বাংলাদেশ যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে কিংবা এই খাতের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে তার স্বীকৃতি স্বরূপ গতবছর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। প্রথমত, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখায় আন্তর্জাতিক সংগঠন এশিয়া প্যাসিফিক আইসিটি অ্যালায়েন্সের (অ্যাপিকটা) সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বেসিস। গত ২৩ থেকে ২৫ মার্চ সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত অ্যাপিকটার ৪৮তম কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বেসিস এই সদস্যপদ পায়। অ্যাপিকটার সদস্যপদ পেতে হলে নিজ নিজ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে কাজ করা নিবন্ধিত আইসিটি সংগঠন ও স্থানীয়ভাবে অ্যাপিকটা অ্যাওয়ার্ড আয়োজনের সক্ষমতাসহ ৬টি যোগ্যতা পূরণ করতে হয়। বেসিস -এর সবক’টি শর্তই পূরণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, গত মে মাসে দ্বিতীয়বারের মতো ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (ডাব্লিউএসআইএস) পুরস্কার লাভ করেছে বাংলাদেশ। ‘একসেস টু ইনফরমেশন অ্যান্ড নলেজ’ ক্যাটাগরিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ উদ্যোগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এই সাফল্য। এই তথ্য বাতায়ন তৈরিতে এটুআই, বিসিসির পাশাপাশি বেসিসও সরাসরি জড়িত ছিলো। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে যে বড় অর্জন এসেছে সেটি হলো আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) কাছ থেকে ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ পান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দফতরে আইটিইউ মহাসচিব হুাওলিন ঝাও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন।
স্থানীয় বাজার উন্নয়ন: গতবছর তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্থানীয় বাজার উন্নয়নে সরকারের আইসিটি বিভাগ, বেসিসসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। এরমধ্যে সর্বপ্রথমেই আসে হাইটেক পার্কের উদ্বোধন। হাইটেক পার্কের মূল অবকাঠামো উদ্বোধন করার মাধ্যমে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য আগামী ১০ বছর আয়কর সুবিধা, ১২ রকমের প্রণোদনা প্রদানসহ টিআর ফোর ডেটা সেন্টার (পৃথিবীর মধ্যে ৫ম বৃহত্তম ডাটা সেন্টার) সহ অন্যান্য সুবিধা নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১৫ অক্টোবর এই হাইটেক পার্কের মূল অবকাঠামো উদ্বোধন করেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এছাড়া দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে গত ১৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে রাজধানীর কাওরান বাজারের জনতা টাওয়ারে অবস্থিত সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। অনুষ্ঠানে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে বরাদ্দ পাওয়া প্রথম ৪টি কোম্পানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া দেশীয় কোম্পানি একসেস টু ফান্ড তৈরিতে দুটি বড় উদ্যোগ নেয় বেসিস। প্রথমত, বেসিস ও আইডিএলসি যৌথভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণসুবিধা দেওয়ার জন্য ‘আইডিএলসি উদ্ভাবন’ নামে একটি বিশেষ প্যাকেজ চালু করেছে। দেশীয় কোম্পানির কাছ থেকে সফটওয়্যার কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ও দেওয়ার সুবিধা রাখা হয় এই উদ্যোগে। দ্বিতীয়ত, আউটসোর্সিং পেশায় জড়িত ব্যক্তি ও কোম্পানির আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুবিধার্তে বেসিস ও স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে ‘এসসিবি ইআরকিউ অ্যাকাউন্ট’ সুবিধা চালু করা হয়।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে তাদের কাজের স্বীকৃতি, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আনাসহ মানোন্নয়ন ও বিভিন্ন সুবিধা দিতে গতবছর বেশ কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রথমত, জনতা টেকনোলজি পার্কের চতুর্থ তলায় অবস্থিত স্টার্টআপ ইনকিউবেটরে যাতে সঠিক স্টার্টআপগুলো জায়গা বরাদ্দ পায় সে উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করা হয়। আইসিটি বিভাগ, বেসিস, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ও বিসিসি এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে। এর মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, তাদের মানোন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ আনা, স্বল্প ভাড়ায় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির জন্য জায়গা বরাদ্দসহ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয়ত, প্রতিবারের মতো এবারও স্বীকৃতি দেওয়া হয় দেশে আউটসোর্সিংয়ে সেরা প্রায় ১০০ আউটসোর্সিং প্রফেশনালস ও প্রতিষ্ঠানকে। বেসিস -এর উদ্যোগে পঞ্চমবারের মতো সেরাদের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২ নভেম্বর আইডিইবি মিলনায়তনে আউটসোর্সিংয়ে দেশসেরাদের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’ শীর্ষক অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের অনুপ্রাণিত করতে এবং ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মকে আরও অধিকহারে ব্যক্তি পর্যায়ে অথবা আইটি উদ্যোক্তা হিসেবে অনলাইন আউটসোর্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেসিসের এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। তৃতীয়ত, দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের সিলিকন ভ্যালিসহ গ্লোবাল টেকনোলজি ইনোভেশন এবং কোম্পানিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রসারিত করার একটা প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার জন্য আয়োজন করা হয় ‘সিডস্টারস ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিযোগিতা। বিজয়ীদেরকে এই প্ল্যাটফর্মে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে যাতে পরবর্তী গুগল, ফেসবুক বের করে নিয়ে আসা যায় তার চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশে প্রথমবারের মতো এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বেসিস এবং সিডস্টারস ওয়ার্ল্ড। চতুর্থত, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যাকাথন ইন্টারন্যাশনাল স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০১৫। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বিশ্বব্যাপী এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করে থাকে। দেশে এ প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিলো বেসিস। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পর্বে সেরা হয় ঢাকার আইইউবি কোয়ার্কস ও চট্টগ্রামের টি-স্কয়ার দল। প্রতিযোগিতায় রানার্স-আপ হয়েছিলো যান্ত্রিক ক্লিন ওয়াটার ও কম্বো কোডার দল। বিজয়ী এই ৪টি দলই নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আবেদন করতে পারবে।
দক্ষ জনবল তৈরি: তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে গতবছর বেশ কয়েকটি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে ও চলমান রয়েছে। প্রথমত, বেসিসের উদ্যোগে আগামী ৩ বছরে বিনামূল্যে ২৩ হাজার দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চালু হয় স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি) প্রকল্প, যা এখনও চলমান রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এসইআইপি প্রকল্পের অধীনে জনশক্তি তৈরিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এবছর চট্টগ্রামসহ দেশের প্রতিটি বিভাগে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু হবে। পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগেই বিআইটিএমের কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গাইডলাইন ও ইন্ডাস্ট্রি উপযোগি করে গড়ে তুলতে গঠন করা হয়েছে বেসিস স্টুডেন্টস ফোরাম। দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ফোরামের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সম্মেলনের পাশাপাশি শতাধিক ক্যারিয়ার সেমিনার আয়োজন করেছে বেসিস স্টুডেন্টস ফোরাম।
পলিসি উন্নয়ন: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে বেসিস নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমত, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি আনতে বেসিস ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইক্যুইটি সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া আইটি কোম্পানি যাতে আইপিওতে অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য স্মল-ক্যাপস পলিসি তৈরিতে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, বেসিসের অনুরোধে সরকার এ খাতের ট্যাক্স রহিতকরণ আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতে ভ্যাট আরোপ হলেও বেসিসের অনুরোধে ভ্যাট তুলে নেওয়া হয়। তৃতীয়ত, আইসিটি কোম্পানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ ফান্ড প্রাপ্তি সহজ করতে বেসিস বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দেয়। এছাড়া সফটওয়্যার আমদানিতে ই-ডেলিভারি এসআরও জারি, পাবলিক প্রোকিউরমেন্ট পলিসিতে দেশীয় কোম্পানির অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনা প্রদান, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট পলিসি (২০১৫-২০১৮) তৈরি, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, হাই-টেক পার্ক ও এসটিপি পলিসি তৈরিতেও ভূমিকা রাখে বেসিস।
কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং: বিদেশে বাংলাদেশের কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং, বিদেশি বিনিয়োগ আনা ও বিদেশে বাংলাদেশি কোম্পানির ব্যবসায় প্রসারে গতবছর বেসিসের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড, উগান্ডা, হাঙ্গেরি, ব্রাজিল, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ডেনমার্ক, কাতার, ইউকে, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশে আন্তর্জাতিক বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) বৈঠকসহ টাই সিলিকন ভ্যালি কনফারেন্স, সিবিট জার্মানি, সিবিট অস্ট্রেলিয়া, দুবাইতে জাইটেক্স টেকনোলজি উইক, ভারতে জিইএস, নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স ও জাপান আইটি উইকে অংশ নেয় বেসিসের সদস্য কোম্পানিরা।
ভিডিও কনফারেন্স সুবিধায় সবগুলো চেম্বার: দেশের ৬৪ জেলা চেম্বারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স নেটওয়ার্কিং চালু করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ই-কমার্স ওয়েবসাইট বাগডুম ডটকম -এর পৃষ্ঠপোষকতায় গত আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভিডিও কনফারেন্স নেটওয়ার্কিং চালু করা হয়। প্রতিদিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলাগুলোর সমস্যা, শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ ও তাদের প্রস্তুতি বিষয়ে সরাসরি জানার জন্যই এই সুবিধা চালু করা হয়।
ব্যর্থতার ২০১৫
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ: বছরের শেষের দিকে দুটি ঘটনা এই খাতের সবচেয়ে বড় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। একটি ইন্টারনেট বন্ধ, অপরটি বেশকিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া। ১৮ নভেম্বর দেশে প্রায় এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট ইন্টারনেট সরবরাহও বন্ধ ছিল। যা তথ্যপ্রযুক্তি খাত তথা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষার মতো ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। অথচ প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় -এর অনুমতি ছাড়া দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া মোটেই সমীচীন নয়। আশাকরি আগামীতে এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটবে না। ২২ দিন বন্ধ থাকার পর ১০ ডিসেম্বর জনপ্রিয় এই মাধ্যমগুলো খুলে দেওয়া হয়। ফেসবুক বন্ধের ঘটনার রেশ তখনো কাটেনি। এমন সময় ১৩ ডিসেম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয় খুদে ব্লগ লেখার জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম টুইটার, ইন্টারনেটে কথা বলা ও মেসেজিং অ্যাপ ইমো এবং ভয়েস, ভিডিও কল ও ম্যাসেজিংয়ের জনপ্রিয় মাধ্যম স্কাইপ। এদিন আমি সজীব ওয়াজেদের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলি। তিনি এগুলো সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি তাৎক্ষনিকভাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে ফোন করে সব খুলে দেওয়ার জন্য বলেন। ফলে বন্ধ করে দেওয়া সব সেবা চালু করা হয়। আইসিটি খাত থেকে আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি হলো আগামীতে যাতে নিরাপত্তা অজুহাতে এসব সেবা বন্ধ না করে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিকল্প নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।
ইন্টারনেটের দামের বৈষম্য: বছরের শুরু থেকে আলোচিত ছিল দেশে ইন্টারনেটের দাম কমানোর প্রসঙ্গটি। গত বছর আবারও ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম কমানো হয় কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম কমানোর বিষয়টি সামনে এলেও বছর শেষে ইন্টারনেটের দাম সেই আগের অবস্থানেই রয়ে যায়। ইন্টারনেটের দাম কমানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নিতে বললেও সে প্রক্রিয়ারও কোনও দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এছাড়া ইন্টারনেট গতির নাজুক অবস্থা। সরকার ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ফাইবার অপটিক সংযোগ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও সেটি এখনও দৃশ্যত বাস্তবায়ন হয়নি। সাধারণ গ্রাহকের বাড়ি পর্যন্ত এই সুবিধা না দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন অনেকটাই স্থবির হয়ে যাবে।
মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ: সফটওয়্যার পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ও পেটেন্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের তরুণ ডেভেলপাররা কিংবা বেসিসের হাজারও সদস্য কোম্পানি নানা রকম অ্যাপ্লিকেশন, সফটওয়্যার তৈরি করছে। কিন্তু মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ বা কপিরাইট আইনের জোরালো প্রয়োগ না থাকার কারণে দেখা যাচ্ছে কিছুদিন পরেই সেটির সোর্সকোড চুরি করে আরেকটি অ্যাপ্লিকেশন, সফটওয়্যার তৈরি করছে। ফলে মূল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে, তারা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। দেশের সফটওয়্যার খাতের উন্নয়নে মেধাস্বত্ব আইন সংরক্ষণ করা জরুরি। বেসিসের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দাবি জানানো হলেও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে গতবছরে সংশ্লিষ্ঠদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। আশাকরি এ বছর সরকার ও সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে জোর গুরুত্ব দেবে। এছাড়া জনগণকে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ও কপিরাইট বিষয়ে সচেতন করে তোলা হোক এবং কঠোরভাবে পাইরেসি দমনের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তির পরবর্তী গন্তব্যস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারের সঙ্গে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রি সবারই সদিচ্ছা রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে গতবছর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে অনেক ভালো কাজ হয়েছে। আশাকরি এবছর এই ধারাবাহিকতা আরও গতিশীল হবে। আমরা আশা করতেই পারি যে, কাঙ্ক্ষিত সময়ের আগেই পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হবে তথ্যপ্রযুক্তিকে সমৃদ্ধ ও উন্নত এক নাম ডিজিটাল বাংলাদেশ।
লেখক: সভাপতি, বেসিস ও জেনারেল পার্টনার, ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটাল
/এইচএএইচ/