X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাইসেন্স না নিয়েও ফি বাবদ খরচ দেখিয়েছে হাঙ্গামা

হিটলার এ. হালিম
০৫ আগস্ট ২০১৭, ০৩:২৩আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০১৭, ০৩:২৩

হাঙ্গামা বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশে দেশে কনটেন্ট সেবা তথা ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের (ভ্যাস) লাইসেন্স এখনও চালুই হয়নি। তবে মোবাইলফোনভিত্তিক ভারতীয় কনটেন্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হাঙ্গামা (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে লাইসেন্স ফি বাবদ খরচ দেখিয়েছে। এছাড়া নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে নিট মুনাফার চেয়ে ‘বেশি’ লভ্যাংশ বিদেশে পাঠানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে, লাইসেন্স না নিলেও হাঙ্গামা বাংলাদেশ অফিস অব দ্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের নিবন্ধিত কোম্পানি। যার নিবন্ধন নম্বর সি-৮৬৪৮৪। প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত হয়েছে ২০১৩ সালে।

প্রসঙ্গত, মাত্র দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ থেকে দুই বছরে প্রায় ১৩ কোটি টাকা মুনাফা করে ভারতীয় কোম্পানি হাঙ্গামা। এই টাকা কোম্পানিটির মূলধনের প্রায় ৩২০ গুণ। এ বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড’ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে জানতে চেয়ে বিটিআরসিতে চিঠি দেয়। হাঙ্গামা’র বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ, দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ২০১৫ সালে ৬ কোটি ৭৪ লাখ ৮১ হাজার ২৫০ এবং ২০১৪ সালে ৬ কোটি ৭ লাখ ৩৩ হাজার ১২৫ টাকা লভ্যাংশ বাবদ ভারতে পাঠায়।

হাঙ্গামার আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি নিট মুনাফা করেছে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫২ টাকা কিন্তু লভ্যাংশর জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ বিষয়ে একজন আইনজীবী বলেন, ‘কোনও কোম্পানিই মুনাফার অতিরিক্ত লভ্যাংশ বিদেশে পাঠাতে পারে না।’ 

অন্যদিকে ভ্যাস লাইসেন্স না নিলেও ওই আর্থিক বছরে লাইসেন্স ফি বাবদ ১ লাখ ৮ হাজার ৫শ’ টাকা খরচের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে হাঙ্গামা বাংলাদেশের স্থায়ী স্থাপনা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত জুলাই মাসে সরেজমিনে হাঙ্গামার অফিসে গেলে দেখা যায়, অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের অফিসের সঙ্গে (শেয়ার করে) একটি কক্ষেই হাঙ্গামার অফিস চলছে। অথচ নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে অফিস ভাড়া বাবদ ৫ লাখ ৭৬ হাজার ১২০ টাকা পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও নোটে বলা হয়েছে এই ভাড়া ২ বছরের।

এদিকে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, হাঙ্গামা আয়ের উৎস দেশের মোবাইলফোন অপারেটররা। যদিও প্রায় সব মোবাইলফোন অপারেটররা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, হামঙ্গার সঙ্গে তাদের কোনও চুক্তি নেই। রাজস্ব ভাগাভাগির ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের গ্রাহকরা হাঙ্গামার কটেন্ট ব্যবহার করতে পারেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া হাঙ্গামার নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীতে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে হাঙ্গামার সার্ভিস রেভিনিউয়ের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৭২ লাখ ২৬ হাজার ৬৩৯ টাকা। এর মধ্যে বাংলালিংকের কাছ থেকে হাঙ্গামার আয় ছিল ৭৪ লাখ ৪৮ হাজার ২০৮ টাকা, গ্রামীণফোনের কাছ থেকে ২ কোটি ২২ লাখ ৫৮ হাজার ১০৬ টাকা, ইবি সলিউশনের কাছ থেকে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৮৯ হাজার ২৯২ টাকা, মোবিজোন টেলিকমিউকেশন্সের কাছ থেকে ১৩ লাখ ২৫ হাজার ৮২৩ টাকা, রবির কাছ থেকে ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৫৩ টাকা, অন মোবাইলের কাছ থেকে ৩ কোটি ৬০ লাখ ১৫ হাজার ১২৬ টাকা এবং এয়ারটেলের কাছ থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৩১ টাকা। অপারেটিং কস্ট ও ট্যাক্স দেওয়ার পরে হাঙ্গামা নিট মুনাফা করে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬২ টাকা।

দেশের কলসেন্টারগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কলসেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) মহাসচিব তৌহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি বাংলাদেশে হাঙ্গামার কোনও সার্ভার নেই, এমনকি প্রযুক্তিগত কোনও অবকাঠামোও নেই। ওরা এ দেশে বসে ভারতের (ভারতীয় অফিস) সার্ভার থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে।’

তিনি বলেন, ‘এদেশ থেকে যখন কোনও মোবাইল গ্রাহক তার ফোনের মাধ্যমে হাঙ্গামার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন একটি আইপির (ইন্টারনেট প্রটোকল) সঙ্গে আরেকটি আইপিও যুক্ত হয়। কিন্তু এভাবে আইপি যুক্ত হওয়া বৈধ নয়। এটা এক ধরনের অবৈধ ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি)।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভ্যাস গাইডলাইন এবং লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে এভাবে কোনও প্রতিষ্ঠান কাজ চালাতে পারতো না। এ দেশের কোনও একটি শর্টকোড তাদের থাকলে এ অভিযোগে তাদের খুব একটা পড়তে হতো না কিন্তু যেভাবে হচ্ছে তা ভয়াবহ। কিভাবে এটা হচ্ছে তা কি দেখার কেউ নেই?’

জানা গেছে, হাঙ্গামা বিটিআরসির কাছে শর্টকোড চেয়ে আবেদন করেছে। এরই মধ্যে শর্টকোডের বিপরীতে ব্যাংকে টাকাও জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি শর্টকোড দেওয়ার বিষয়টিও ভালোভাবে তদন্ত করে দেখবে।

এদিকে মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইবি) মহাসচিব এসকে সাহেদ আলী পাপ্পু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা উচ্চ আদালতে মোবাইলফোনে রিংটোন, ওলেকাম টিউন হিসেবে হিন্দি গান বাজানোর বিরুদ্ধে রিট করেছিলাম। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই মোবাইলে রিংটোন, ওয়েলকাম টিউন ও সব ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস হিসেবে হিন্দি গান, ভারতীয় বাংলা গান ও উপমহাদেশের যেকোনও সিনেমার গান ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি রুলও জারি করেন। সম্প্রতি হাঙ্গামা (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড উচ্চ আদালতের আদেশ ও রুলের পক্ষভূক্ত হতে আবেদন করে। গত ২ আগস্ট বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠানটির পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন মঞ্জুরের আদেশ দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য খারাপ হলো। হাঙ্গামা এখন চাইছে আমাদের বাংলা গানের পাশাপাশি তাদের হিন্দি গান মোবাইলে রিংটোন, ওয়েলকাম টিউন হিসেবে বাজাতে। সঠিক নীতিমালা (ভ্যাস গাইডলাইন) প্রণয়ন করা না হলে এই কনটেন্ট শিল্প আমাদের দেশে দাঁড়াতেই পারবে না।’

উল্লেখ্য, ভ্যাস গাইডলাইনের খসড়া তৈরি করেও তা চূড়ান্ত করার আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে বাতিল করা হয়। সে সময় মূলত ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ মোবাইলফোন অপারেটরগুলোর দাবি মেনে নিয়ে চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ‘ভ্যাস লাইসেন্সিং গাইডলাইন-২০১২’ বাতিল করে। যদিও সে সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের মার্কেট ও ভ্যালু চেইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আইপিআরসহ সব পক্ষের অধিকার ও প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করে সব পক্ষের প্রাপ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, নতুন প্রযুক্তির প্রচলন, কর্মসংস্থান এবং দেশীয় পেশাদারদের সক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি বিবেচনায় এনে করণীয় নির্ধারণ করা যেতে পারে। এসব বিষয় পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেয়। সে সময় মোবাইল অপারেটরগুলোর রাজস্ব আয়ের ৩০ শতাংশ আসত ভ্যাস থেকে।

বিটিআরসির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আবারও কমিশনে ভ্যাস গাইডলাইন নিয়ে কথা হচ্ছে। কেন এবং কী কারণে সে সময় ভ্যাস গাইডলাইন চূড়ান্ত হয়নি তারও খোঁজ খবর করা শুরু হয়েছে। শিগগিরই কোনও কমিশন বৈঠকে ভ্যাস গাইডলাইন নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

/এইচএএইচ/এসএনএইচ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী