X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অনেক ভাবনার এক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কেয়ারটিউটরস

হিটলার এ. হালিম
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:১৫আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:৪৭

মাসুদ পারভেজ রাজু ক্যারিয়ারের শুরুতে চাকরি করলেও উদ্যোক্তা হওয়ার নেশা শেষ পর্যন্ত তাকে চাকরিতে রাখতে পারেনি। তিনি একটা সমস্যার সমাধান ভাবতে গিয়ে তৈরি ফেলেন কেয়ারটিউটরস। এটি টিউশনভিত্তিক সব ধরনের সমস্যার সমাধান দেয়। তার এই স্টার্টআপভিত্তিক উদ্যোগের নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও টিউশন প্রত্যাশীরা। কেয়ারটিউটরস গড়ে তোলার গল্পটা মাসুদ পারভেজ রাজুর মুখে শোনা যাক।

প্রশ্ন: উদ্যোক্তা হলেন কেন?

মাসুদ পারভেজ রাজু: খুব ছোটবেলা অর্থাৎ স্কুলজীবন থেকেই আমার মধ্যে নেতৃত্বের একটা ধাঁচ ছিল। স্কুল অথবা এলাকার বন্ধুবান্ধবদের যেকোনও কাজের নেতৃত্বটা কেমন করে জানি আমার কাছে চলে আসতো। এই নেতৃত্বটা যে আমি নিজে থেকেই নিয়ে নিতাম তা নয়; বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তা আমার কাছে চলে আসতো এবং যদিও বা তাতে সবার থেকে সব কিছুতে আমার বেশি দায়িত্ব নিতে হতো, তাও আমি তা উপভোগ করতাম। আবার সেইসঙ্গে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের সক্ষমতা এবং দুর্বলতা নিয়েও ভাবতাম। সব মিলিয়ে আমি মনে করতাম, এই নেতৃত্বের বিষয়টা অবশ্যই একটি শক্তিশালী গুণ। আর আমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবারের পরিচিতজনদের মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী ছিল, আমি তাদের বিভিন্ন সময় খেয়াল করতাম আর তখন থেকেই এই ব্যবসা ব্যাপারটা আমাকে টানতো এবং আমি ব্যবসা সম্পর্কিত বড়দের কথাতে আগ্রহ পেতাম। তাই তখন থেকেই মনে হচ্ছিল বড় হয়ে নেতৃত্ব এবং ব্যবসা সম্পর্কিত কিছু করবো। আর এখান থেকে আমার নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারটা মাথায় কাজ করে। 

প্রশ্ন: উদ্যোক্তা হলেন কীভাবে?

মাসুদ পারভেজ রাজু: আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যেহেতু ব্যবসা করারই পরিকল্পনা, তাই পড়াশোনার ডিপার্টমেন্ট হিসেবে নিয়েছিলাম বিবিএ-কে এবং মনে মনে চিন্তা করে রেখেছিলাম, যদি ছাত্র অবস্থা থেকে কিছু শুরু করতে পারি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা পর্যন্ত ব্যবসা ভালো পর্যায়ে এলে তখন পুরো সময় দিতে কাজ পারবো। প্রচলিত ব্যবসাগুলো আমাকে টানতো না, মনে হতো এমন কিছু করি যা আগে কেউ করেনি। তারপর ২০১২ সালে আমার উদ্যোক্তা জীবনের শুরু হয়। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে আমি একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে যোগদান করি। সেই কোম্পানিতে চাকরির অভিজ্ঞতা আমার এই ব্যবসাকে দাঁড় করাতে অনেক কাজে লেগেছে। চাকরির পাশাপাশি অফিসের পরে সন্ধ্যার সময়টা ২০১৪-১৫ সাল এই দুই বছর নিজের ব্যবসার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। একসময় মনে হলো আমার চাকরির বদলে ব্যবসাতেই পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া উচিত। যে সময় আমি চাকরি ছাড়ি ওই সময় চাকরির টাকা ছাড়া পরের মাস কি করে ঢাকাতে আমার খরচ চলবে তার নিশ্চয়তা ছিল না। বিষয়টি ক্যারিয়ারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে জেনেও নিজের এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে মাঠে নেমে পড়লাম।

প্রশ্ন: উদ্যোক্তা হতে কেয়ারটিউটরসের মতো ব্যতিক্রম প্রজেক্ট কেন বেছে নিলেন?

মাসুদ পারভেজ রাজু: এর পেছনে একটা ছোট ঘটনা রয়েছে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় বললো, সে টিউশনি করে এবং ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রকে পড়ায়। সে অবশ্য ইংরেজিতে ভালো কথা বলতে পারতো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম টিউশনিটা সে কীভাবে পেয়েছে। জানালো এক এজেন্টের মাধ্যমে পেয়েছে এবং তাকে বলতে শিখিয়ে দিয়েছে যে সে ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে। তাকে বললাম, তুমি বাংলা মাধ্যমের হয়ে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র হিসেবে নিজে পরিচয় দিচ্ছ, এটা তো অনৈতিক কাজ হচ্ছে। সে বললো, কিছু করার নেই। এজেন্ট এভাবেই শিখিয়ে দিয়েছে। তখন আমার মাথায় এটা নিয়ে একটা ভাবনা এলো। দেখলাম, এভাবে অনেক অভিভাবকই প্রতারিত হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় বা বিভাগীয় শহরগুলোতে অন্য শহর বা গ্রাম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের উপার্জনের একমাত্র ভরসাই হলো টিউশন করানো। কেউ যখন নতুন কোনও শহরে যায় সেখানে তার তেমন কোনও পরিচিত থাকে না। তাই টিউশনি খুঁজে পাওয়াটা তার জন্য অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তাই অভিভাবকরা যেন প্রতারণার শিকার না হন, আবার টিউশন প্রত্যাশী যেন সহজে একটি টিউশনি পায়, এই উভয় দিকের সমাধানের জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা করি। আর এখান থেকেই কেয়ারটিউটরসের শুরু।

প্রশ্ন: শুরুটা কেমন ছিল?

মাসুদ পারভেজ রাজু: ২০১২ সালে আমার এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। শুরুতে আমার এক বন্ধুসহ দুজন মিলে মাত্র ১৮ হাজার টাকা, একটি পুরোনো ভাঙা ল্যাপটপ আর একটি কম দামি বাটন ফোন নিয়ে আমাদের কাজ শুরু করি। বাসার একটি রুমকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতাম। সেটাকে আসলে ফর্মাল কোনও অফিস বলা চলে না। দিনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করতাম এবং বিকাল থেকে আমরা কেয়ারটিউটরস নিয়ে কাজ করতাম। এরপর ২০১৪ সালে প্রথম অফিস নিই। তখন প্রযুক্তিনির্ভর সেবাগুলো সবার কাছে এতটা জনপ্রিয় ছিল না। বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে গিয়ে আমরা নিজেরাই লিফলেট বিতরণ করতাম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কেটিং করতাম। আমার ব্যবসার মূল পুঁজি ছিল সততা। শুরু থেকেই আমি আমাদের সেবাগ্রহীতাদের আস্থা অর্জন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকি। 

প্রশ্ন: মাঝের পথ কতোটা কঠিন ছিল?

মাসুদ পারভেজ রাজু: কোনও অর্জনই সহজে হয় না। কেয়ারটিউটরসের যাত্রা শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যেই আমার বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার ফলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবার কিছুটা ধাক্কা খায়। তারপরও নিজের স্বপ্ন নিয়ে হাল না ছেড়ে আরও ভালোভাবে কাজ করতে থাকি। ২০১৫ সালের শেষের দিকে চাকরির পাশাপাশি যখন প্রতিষ্ঠান চালাই, তখন যারা আমার সঙ্গে ছিল তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে চাকরি ছেড়ে দিই। তারা কথা দিয়েছিল এই ব্যবসার সঙ্গে তারা থাকবে। কিন্তু চাকরি ছাড়ার কয়েক মাসের মধ্যে তারাও তাদের অন্য পরিকল্পনার কারণে কোম্পানি ছেড়ে দেয়। তখন যেন আমি গভীর সমুদ্রে একা পড়ে গেলাম। এর মাঝে অফিসের এক কর্মী টাকা চুরি করে। এর দায় সম্পূর্ণ আমাকে দেওয়া হয়। বলা হয় আমার অযোগ্যতার কারণে এমনটা হয়েছে। তখন আমার নতুন একটি উপলব্ধি হয়। মনে হয়, সব কিছুই তো হারিয়ে ফেলেছি। তাই নতুন করে আর হারানোর কিছু নেই, বরং এখন আমার পাওয়ার সময়। ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিই। নতুন উদ্যমে আবারও কাজ শুরু করি এবং রাত দিন কাজ করে কোম্পানিকে ২০১৯ নাগাদ মোটামুটি একটা পর্যায়ে নিয়ে আসি।  

এরপর আরেকটি ধাক্কা আসে করোনার সময় ২০২০ সালে। তখন সবেমাত্র কোম্পানিকে একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। লকডাউনে যেন সবকিছু স্থবির হয়ে গেলো। কেউ বের হতে পারছে না। সব টিউশনি বন্ধ। তবে আমি চেষ্টা করেছি আমার কর্মীদের যতটা সম্ভব ধরে রাখতে এবং অনলাইন টিউশন চালু করি। তাতে ওই সময় কিছু সাড়া পাই আমরা। যেহেতু ওই সময় লম্বা সময়ের জন্য বাসায় ছিলাম, উদ্যোক্তা জীবনে ওই সময় পর্যন্ত কি কি ভুল করেছি সব কিছু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলাম এবং সামনে কি কি করলে ওই একই ভুল হবে না তার সমাধানও খুঁজতে থাকলাম। করোনার পরে আবারও যেন শূন্য থেকে শুরু করার মতো অবস্থা হলো, এবার পরিশ্রম আরও বাড়িয়ে দিলাম এবং পূর্বের ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি না করার চেষ্টা করলাম। তবে এখন আশার কথা হলো, আবারও আমাদের প্রতিষ্ঠান উঠে দাঁড়াতে পেরেছে।

প্রশ্ন: বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের পরিধি কেমন?

মাসুদ পারভেজ রাজু: বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানটিতে মোট কর্মী রয়েছে ৪০ জন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই প্রায় ৪-৫ বছর ধরে আমার সঙ্গে কাজ করছেন। বিভিন্ন বিষয়ে টিউটর  মিলিয়ে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এখন পর্যন্ত মোট টিউটর তিন লাখের ওপরে যুক্ত হয়েছেন। আর ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবক মিলিয়ে রয়েছে মোট এক লাখের ওপরে। প্রতিষ্ঠানটি এখন শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক নয়, প্রতিটি বিভাগে এখন আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। সেইসঙ্গে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্য প্রাচ্যেও আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবক রয়েছেন।

প্রশ্ন: টেকসই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে কোন বিষয়টি মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন?

মাসুদ পারভেজ রাজু: মূলত সততা, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়। আমার মনে হয় এগুলোই এই প্রতিষ্ঠানকে একটি টেকসই এবং সফল অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আমাদের মূল ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর এই প্ল্যাটফর্মের ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরা। অর্গানিক মার্কেটিংই আমাদের প্রতিষ্ঠানটির মূল মার্কেটিং। এটাই সততার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। একদম শুরু থেকেই আমি এই বিষয়টিকে খুব কঠিনভাবে ধরে রেখেছি। আর আমার ব্যবসা শুরুর একটি উদ্দেশ্যই ছিল অভিভাবক এবং টিউটরদের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচানো।.

প্রশ্ন: নতুন কারিকুলাম নিয়ে কেয়ারটিউটরসের পরিকল্পনা কী?

মাসুদ পারভেজ রাজু: নতুন কারিকুলামে মুখস্থনির্ভর পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে ব্যবহারিক-নির্ভর করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগোপযোগী এবং ভালো পদক্ষেপ। এটি নিয়ে আমরাও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি নতুন এই শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে। এজন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টির ওপরে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আমরা শুরু করেছি। এজন্য আমাদের অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে হলেও পুরো বিষয়টিকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

 

/এইচএএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইট-পাথরের নগরীতে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে
ইট-পাথরের নগরীতে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে
তাইওয়ানের কাছাকাছি আবারও সামরিক কার্যকলাপ চালালো চীন
তাইওয়ানের কাছাকাছি আবারও সামরিক কার্যকলাপ চালালো চীন
বাগেরহাটে ট্রাকচাপায় দুই ভাইসহ ৩ ভ্যানযাত্রী নিহত
বাগেরহাটে ট্রাকচাপায় দুই ভাইসহ ৩ ভ্যানযাত্রী নিহত
শিল্পীদের সমস্যাগুলো সংসদে চিহ্নিত করতে চাই: ফেরদৌস
শিল্পীদের সমস্যাগুলো সংসদে চিহ্নিত করতে চাই: ফেরদৌস
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!