X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাজমহল ও বুটা সিং

আহসান কবির
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৫২আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৫২

ভালোবাসা নাকি এক ধরনের নিষিদ্ধ নেশা। আবার কারও কারও মতে, ভালোবাসা সবচেয়ে পবিত্র অভ্যাস! তাহলে আপনি কোনদিকে যাবেন? নিজের লেখা ভেঙে এটুকু বলাই যায়– রবীন্দ্রনাথও সন্দিহান ছিলেন এ ব্যাপারে। দ্বিধাহীন জানতে চেয়েছেন– ‘সখি ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলই যাতনাময়?’ গানেও এই দ্বিধা আছে। বিখ্যাত গায়ক মান্না দে যখন হৃদয় উজাড় করে বলেন– ‘হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে/ প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রেম আসে’, তখন সুবীর নন্দী অভিমান করে গেয়ে ওঠেন– ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি/পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই!’

দুই তিন দশক আগেও ভালোবাসার কিছু কমন চল বা উদাহরণ ছিল। এসএমএস, এমএমএস বা ভিডিও কলের যুগে এখন এসবের কতটা আছে সেটা গবেষণার ব্যাপার। প্রেমের প্রথম চল ছিল ‘ইটা’। পাড়ার বড় ভাইরা অনেক কষ্ট করে একটা পরিষ্কার বা চকচকে ইট জোগাড় করতেন। এরপর যে মেয়েকে ভালো লাগে তার বাড়ির সামনে গিয়ে সেই মেয়ে ও বন্ধুদের সাক্ষী রেখে ‘ইটা’ দিয়ে আসতেন। এই ‘ইটা’ ছিল প্রেমের প্রথম প্রস্তাবকারীর স্মারক। কখনও কখনও একই মেয়ের জন্য অনেক ‘ইটা’ পড়তো। প্রয়াত আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন যেমন লিখেছিলেন– ‘তোমাকে বলতে গেছি ভীরু পায়ে- আই লাভ ইউ/ সেখানেও কিউ!’

ইটার পর ছিল ‘চিঠি’। চিঠি ছিল সেই যুগের অন্যতম এক সৃষ্টিশীল শিল্প। প্রেমের চিঠি ছিল কবি বা লেখক হওয়ার প্রথম ধাপ। যে চিঠি প্রেম আনতো সেটা প্রেমিককে বানাতো কবি আর ছ্যাঁকা বা বিচ্ছেদ হলে প্রেমিক হতে পারতো দার্শনিক। যাদের হাতের লেখা ভালো তাদের খুব দাম ছিল তখন, দাম ছিল যারা কবিতার লাইন চুরি করে চিঠি লিখতে পারতো তাদের। গায়ক আইয়ুব বাচ্চু কোনও একসময় গেয়েছিলেন– ‘ময়না/এখনও আমার জন্য রাত্রি জাগে না/কবিতার লাইন চুরি করে চিঠি লিখে না’!

সরকারিভাবে যারা চিঠির সবচেয়ে বড় সমঝদার সেই জিপিও (জেনারেল পোস্ট অফিস)-এর অফিসগুলোতে লেখা থাকতো– ‘চিঠি লিখুন। ইহা স্থায়ী’! এখন আর কেউ চিঠি লেখে না! সময় এখন এসএমএস, এমএমএস, মেসেঞ্জার, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের। প্রেমের চিঠি নিয়ে সারা পৃথিবীতে অনেক গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, কবিতা বা গান আছে। ‘বাঁধন হারা’ (কাজী নজরুল ইসলাম) কিংবা ‘সবিনয় নিবেদন’ (বুদ্ধদেব গুহ)-এর মতো পত্রোপন্যাসের যুগ শেষ, প্রেমের গান, কবিতা, নাটক বা উপন্যাস তবু হয়তো থাকবে প্রযুক্তিগত বিবর্তনের পরেও। আগুনে পোড়ালে যেমন কিছু থাকে, হোক না সে ধূসর বর্ণ ছাই, প্রেমও নাকি তেমন। ‘অতিকায় ডাইনোসর লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে’র মতো করে প্রেম টিকে থাকে।

গল্প, উপন্যাস, নাটকের সঙ্গে প্রচলিত সিনেমার প্রেমের একটু হলেও পার্থক্য আছে। সিনেমার চৌধুরী সাহেবরা সবসময়ে বড়লোক থাকেন, আর তার কন্যা ভালোবাসে গরিবের ছেলেকে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়েও নায়ক বা নায়িকা তার প্রেম বিক্রি করে না। এরপর ঢিসুম ঢিসুম মারামারি হয় আর নায়িকার জন্য নায়ক ১০০ জনকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না। সিনেমাতে নায়ক নায়িকার শ্রেণি উত্তরণের সংগ্রামও চোখে পড়ার মতো। টাকাওয়ালা হবার জন্য ইটভাঙা থেকে শুরু করে রিকশা বা ভ্যান চালানো, খুবই অল্প টাকায় তরকারি বেচার ব্যবসা থেকে নায়ক হয়ে যায় কোটিপতি। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। জানি না এর ভেতরে প্রেম আর সিনেমার প্রভাব কতটুকু।

তবে প্রেম ভালোবাসায় এখন ব্যবসা বা করপোরেটদের প্রভাব ভয়াবহ। প্রেমের ভেতরে বাণিজ্যকে মেশানো হয়েছে সুন্দরভাবে। যেমন– টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে দেখা যায় নির্দিষ্ট কোম্পানির টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মেজে হাসলেই মেয়েরা দ্রুত তার কাছে চলে আসে। সাবানের বিজ্ঞাপনেও তাই। ওই সাবান দিয়ে গোসল করলেই হবে। গোসলকারীর দিকে দৌড়ে আসা শুরু করবে মেয়েরা। পারফিউমের বিজ্ঞাপন আরও ভয়াবহ। পারফিউম মেরে বেরুলেই মেয়েরা সব একসঙ্গে হামলে পড়ে। এত সুন্দরী, ‘কোনটা থুইয়া কোনটারে ধরি’ অবস্থা হয়।

এমনকি প্রেম ভালোবাসাও বাণিজ্যের বাইরে নয়। কেউ কেউ বলেন, প্রেমের জন্য শাহজাহান যে তাজমহল বানিয়েছিলেন সেটা ছিল মোগল সম্রাটদের প্রেমের সিএসআর বা করপোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি। মমতাজের জন্য তাজমহল বানানোটা জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা। শাহজাহান ক্ষমতায় না থাকলে এই তাজমহল বানানোই হতো না। কত হাজার মানুষ কত বছর পরিশ্রম করে তাজমহল বানিয়েছিল? আর ১৫তম সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল মমতাজ। আসলে প্রেম একালে যেমন বাণিজ্য তেমনি প্রেমের জন্য ক্ষমতাটাও জরুরি। বেশিদূর যেতে হবে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি মহান এরশাদ সাহেবের স্মৃতি মনে করলেই চলবে। ক্ষমতায় থাকাকালে তার প্রেম ও বিয়ে নিয়ে অনেক গসিপ ছিল। ক্ষমতা হারানোর পরে তিনি কতটা প্রেমিক ছিলেন সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কবিতাও ছিল না বা আসেনি তখন এরশাদ সাহেবের কাছে। টাকা কড়ি বা ক্ষমতা ছাড়া প্রেমও সম্ভবত থাকতে চায় না।

কাজী নজরুল ইসলাম যতই বলুন- ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান’, তার সামান্য অংশ ভাবনা নিয়ে আপনি তসলিমা নাসরিনের কথা ভাবতে পারেন। তিনি একদা লিখেছিলেন– ‘আজকাল অর্থকড়ির গন্ধ ছাড়া গরিবের গোলাপ থেকে সুগন্ধি নেয় না কেউ’!

পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকে মানুষেরা তবু ভালোবাসার কথাই বলে এসেছে। এ পর্যন্ত ভালোবাসার জন্য বহু মানুষের দণ্ড বা শাস্তি হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। মানুষকে ঘৃণা করার জন্য কারও কখনও শাস্তি হয়নি। লাইলি মজনু, সিরি ফরহাদ, রোমিও জুলিয়েট কিংবা সোনালি ত্রিস্তানের ভালোবাসার গল্প মিথে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বুটা সিং আর জয়নবের ঘটনা? অনেকের মতে, একালে ভালোবাসার এমন গল্প বিরল।

বুটা সিং ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈনিক এবং একা একজন মানুষ। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অধীনে বার্মা ফ্রন্টে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। ১৯৪৭-এর আগেই তিনি অবসরে গিয়ে চাষাবাদে মনোযোগী হন। দেশ বিভাগের সময়ে সৃষ্ট দাঙ্গায় লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এ অবস্থার মধ্যে একদিন এক মুসলিম তরুণী পালাতে পালাতে আসেন বুটা সিংয়ের কাছে। কয়েকজন উন্মত্ত শিখের তরবারির হাত থেকে জয়নবকে প্রাণে বাঁচান বুটা সিং। তার একা একা জীবনটা বদলে যায় এরপর। কোনও আত্মীয়-স্বজন না থাকা সতেরো আঠারো বছরের তরুণী জয়নবের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সী বুটার। তারা বিয়ে করে ফেলেন। বছর না ঘুরতেই জয়নবের কোল আলো করে জন্ম নেয় এক কন্যাশিশু তউরা।

বুটা সিং জমিজমা ছাড়া আর যে সম্পদ করেছিলেন তার ওপর লোভ ছিল তার ভাইয়ের ছেলেদের। বুটা বিয়ে করায় তাদের প্রাপ্তিতে ব্যাঘাত ঘটে। সে সময়ে যারা পাকিস্তান থেকে ভারতে আসতে চাচ্ছিল বা ভারত থেকে পাকিস্তানে যেতে ইচ্ছুক ছিল, তাদের সহায়তার জন্য ক্যাম্প অফিস খোলা হয়েছিল। বুটার ভাইস্তারা সেখানে নালিশ করলে জয়নবকে ক্যাম্পে নিয়ে আসে পুলিশ এবং পাকিস্তানে থাকা জয়নবের বাবা ও ভাইকে খবর দিলে তারা চলে আসেন জয়নবকে নিতে। বুটার মাতম তাদের মনকে তরল করতে পারে না। জয়নব চলে যায় পাকিস্তানে।

কন্যাকে নিয়ে ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় বুটা। সে পরপর তিনবার ভিসার জন্য আবেদন করে এবং তিনবারই ভিসা পেতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৭। বুটা যেন তার সৈনিক জীবনে ফিরে আসে। সে তিন চারবার সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ১৯৫৭-এর ফেব্রুয়ারিতে কন্যাকে নিয়ে সে শেষমেশ ভারতের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে আসতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানে বুটা সিংয়ের জন্য আরেক বাস্তবতা অপেক্ষা করছিল। জয়নবকে খুঁজে পেয়ে তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে বুটা যখন তাকে ফিরে পেতে চায়, তখন মারধর করে পাড়া-প্রতিবেশীরা। বুটা সিং শুধু জয়নবের মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়। জয়নব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের কথা অস্বীকার করে। বুকভাঙা কষ্ট কমাতে কন্যাকে বুকে চেপে চলে আসে বুটা সিং।

পরদিন বিকালে সুন্দর কাপড়চোপড় কিনে মেয়েকে পরায় বুটা। এরপর একটা চিঠি লিখে বুক পকেটে রাখে। সাদারা রেলস্টেশনে এসে রেললাইন ধরে হাঁটা শুরু করে বুটা সিং। কন্যা তার কোলে। ট্রেন আসে, শব্দ তোলে; বুটা সিংয়ের তাতে কিছু যায় আসে না। ট্রেন পিষে ফেলে, টুকরো করে ফেলে তাকে। বুটার হাত থেকে ছিটকে পড়ে বেঁচে যায় তার কন্যা তউরা।

রক্তে ভেজা চিঠিটা পাওয়া যায় বুটা সিংয়ের বুকে! যেখানে লেখা ছিল- আমি জানি জয়নব তুমি এখনও আমাকেই ভালোবাসো! তুমি যা কিছু করেছ তা তোমার আত্মীয়-স্বজনের মুখের দিকে তাকিয়েই করেছ। আমি শুধু তোমার পুরোনো ও গোপন ভালোবাসাটা বুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।

দোমিনিক ল্যাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্স-এর লেখা ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইতে এই কাহিনির কথা লেখা আছে। প্রেম সম্ভবত বিরহে উজ্জ্বল।

জয়নব ও তউরার এতদিনে কী হয়েছে জানি না, তবে বুটা সিংয়ের জন্য বড় দুঃখ হয়।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ