X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপসাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

মো. জাকির হোসেন
০৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৯:৩৩আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ২০:১৯

অপসাংবাদিকতা নিয়ে শোনা গল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মজার গল্পটি হলো– তিনটি ভিন্ন সংবাদপত্রের তিন জন সাংবাদিক বন্ধু একবার জঙ্গলে বেড়াতে যান। তারা দেখলেন বাঘ শিকার ধরার জন্য একটি হরিণকে তাড়া করেছে। হরিণটি বাঘের কবল থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঘের থাবায় মারাত্মকভাবে জখম হলো। বাঘও শিকার হারিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে গুহায় ফিরে এলো। তিন বন্ধুর একজন বাঘের এবং অপর জন হরিণের সাক্ষাৎকার নিতে গেলেন। তৃতীয় জন জঙ্গলে যে রেস্ট হাউজে উঠেছিলেন, সেখানেই রয়ে গেলেন। পরের দিন দুই সংবাদপত্রের শিরোনাম: এক. ‘জঙ্গলে চরম খাদ্য সংকট, বিপন্ন বাঘ’; দুই. ‘জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব, বিপন্ন হরিণ’। তৃতীয় জন জঙ্গলে না ঢুকেই ওই দুই সাংবাদিকের সঙ্গে ঘটনার বিষয়ে আলাপচারিতার ভিত্তিতে রিপোর্ট করলেন। তার সংবাদের শিরোনাম হলো– ‘বাঘে-হরিণে তুমুল লড়াই, সম্মুখে পড়ে গিয়ে বিপন্ন দুই সাংবাদিক’।

প্রথম আলো ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাদের অনলাইনে ফটো স্টোরি করেছে, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের গেটের বাইরে দাঁড়ানো একটি শিশু স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে আছে। ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব: জাকির হোসেন, দিনমজুর, সাভার।’ ফটো স্টোরিটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের ঝড় ওঠে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ক্যাপশনের ছবির শিশুটির নাম জাকির নয়, সবুজ। তার বয়স সাত বছর। সবুজের হাতে দশ টাকা দিয়ে প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক ছবিটি তুলেছেন। এই ঘটনায় সরকার কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে মামলা হয়েছে। তিনি গ্রেফতার হয়ে জামিন না পেয়ে কারাগারে আছেন। সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলায় আগাম জামিন পেয়েছেন।

এই ঘটনায় আমি অধম বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছি। কিছু উত্তর অন্যদের মাধ্যমে পেলেও সন্তুষ্ট নই। যেসব প্রশ্ন আমি অধমের মনে জেগেছে তা হলো – এক. প্রথম আলো ও তার পক্ষের মানুষদের যুক্তি হলো স্টোরিটি প্রকাশের ১৭ মিনিট পর ভুল বুঝতে পেরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্য পক্ষের দাবি, অনলাইনের বিষয়বস্তু সরিয়ে নিলেও বৈশ্বিকভাবে তার যে বিশাল মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তা প্রশমনের সুযোগ নেই। তদুপরি এটি ভুল নয়, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংবাদিকতা। সরকারকে হেয় করতে ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তোলা সাধারণ কোনও ভুল নয়, বরং এটি ফৌজদারি অপরাধ। গণমাধ্যমের সাথে আওয়ামী লীগের কোনও শত্রুতা নেই, কিন্তু প্রথম আলো আমাদের শত্রু ভাবে।’

দণ্ডবিধি আইনের ৫২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘Nothing is said to be done or believed in “good faith” which is done or believed without due care and attention.’ কোনও কাজ অপরাধী মন নিয়ে ও ইচ্ছাকৃতভাবে না করলেও তা অপরাধ হতে পারে যদি তা যথাযথ সাবধানতা ও মনোযোগ সহকারে করা না হয়। গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত বা হত্যা করার উদ্দেশ্য আমার কস্মিনকালেও ছিল না। কিন্তু আমার গাড়ির নিচে পড়ে কেউ আহত বা নিহত হলে অপরাধের দায় আমাকে বহন করতেই হবে। অপরাধমূলক কাজে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও অপরাধের দায় সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা না হলেও এটি অপরাধ। প্রথম আলো সরকারকে শত্রু না ভাবলেও সরকার ও প্রথম আলোর সম্পর্কে অস্বস্তি রয়েছে। এটি এজন্য নয় যে প্রথম আলো ন্যায়নিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন সাংবাদিকতা করছে। বরং, অনেক ক্ষেত্রে একপেশে, একদেশদর্শী, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ করে থাকে।

আমি সাম্প্রতিক দুয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। একটি বিদেশি সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনকে প্রথম পাতায় নিউজ আইটেম হিসাবে প্রথম আলোর প্রকাশিত শিরোনাম ‘ড. ইউনূসের সঙ্গে আচরণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৪০ বিশ্বনেতার খোলা চিঠি’। আসলে তারা বিশ্বনেতা ছিল? সিনেমার নায়িকা, সংগীতশিল্পী, ব্যবসায়ী কোন ক্যাটাগরিতে বিশ্বনেতা?

সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্র্যাসির (ভি-ডেম) বরাত দিয়ে কয়েক কলামব্যাপী সংবাদ শিরোনাম ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতি’। অথচ ভি-ডেমের এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে (লিবারেল ডেমোক্র্যাসি ইনডেস্ক) ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম। গতবারের চেয়ে স্কোর কমেছে শূন্য দশমিক ০২। বিবিসির বরাতে প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনাম ‘ভাত না জোটার’ বক্তব্য প্রকাশ করে সাংবাদিক কারাগারে। অথচ পুরোপুরি মিথ্যা এই সংবাদ প্রথম আলোর প্রথম পাতার লিড নিউজ। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এজেন্ডা নির্ধারণ এবং সেই এজেন্ডার পক্ষে বা বিপক্ষে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার অভিযোগ অনস্বীকার্য।

ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ভূমিকা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

দুই. পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, জনজীবনে অসহনীয় দুর্ভোগ ও জনমনে ক্ষোভ নিয়ে ২৬ মার্চ প্রথম আলোর ফটো স্টোরি প্রকাশের আগে ও পরে অসংখ্য সংবাদ-প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এজন্য কোনও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, হয়রানি হয়েছে শুনিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকবান্ধব। এটি উত্তরাধিকার সূত্রে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন। যে সাংবাদিকরা তাদের লেখনীতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হনন করেছেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নীতি-আদর্শের সমালোচনার বাইরেও তাঁর সম্পর্কে কুৎসাপূর্ণ লেখা লিখেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও বঙ্গবন্ধু কোনও প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। পাকিস্তানি মালিকানার পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’-এর সম্পাদক এসজিএস বদরুদ্দিন অহর্নিশ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করতেন। আগরতলা মামলার সময় তাঁর ফাঁসি দাবি করেছিলেন এই সাংবাদিক। অথচ স্বাধীনতার পর বদরুদ্দিনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধু বিহারি হিসেবে পরিত্যক্ত বদরুদ্দিনের বাড়ি বিশেষ ব্যবস্থায় বিক্রির ব্যবস্থা করে বিক্রীত অর্থ বিদেশি মুদ্রার রূপান্তর করে নেপাল হয়ে পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের অনেক বছর পর লাহোরে বদরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, আল্লাহর শোকর, শেখ সাহেব ফিরে এসেছিলেন। তাই তো বেঁচে আছি। এখনও বহাল তবিয়তে আছি। তারপরই মাথা থাবড়াতে থাকলেন, “ইয়ে ফেরেশতা কো তোমলোক খুন কিয়া”?’

তিন. মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য অনন্য কোনও ঘটনা নয়। বিশ্বব্যাপী একই অবস্থা। কোনও কোনও দেশে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সংবাদে প্রকাশ, লন্ডনে ছয়টি ডিম ৫৫০ টাকা, কেনা যাচ্ছে না ইচ্ছেমতো টমেটো, শসা, মরিচ। গবেষণা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশেও সাধারণ মানুষ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করছে। গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান বলছে, কানাডার নাগরিকরা তাদের অর্থ ব্যয়ের ধরনে পরিবর্তন এনেছে। তারা অর্থ বাঁচাতে মাংসসহ সব ধরনের খাদ্য গ্রহণ কমিয়েছে। সাহায্য সংস্থা ফুড ব্যাংক কানাডার প্রধান নির্বাহী কার্স্টিন বেয়ার্ডস্লে বলেন, ‘গত দুই বছরে প্রতি পাঁচ জনের একজন কানাডীয় ক্ষুধার সমস্যার কথা জানিয়েছে। টানা ১০ মাস ধরে কানাডার মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে দোকানে বিক্রি হওয়া খাবারের দাম।’

যুক্তরাজ্যের ফুড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সির (এফএসএ) ভোক্তা জরিপে দেখা গেছে, মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশটির মানুষ কম খাচ্ছে; বিশেষ অফার পেলে খাবার কিনছে এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প খাবারের দিকে ঝুঁকছে। মার্চ মাসে পাকিস্তানের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ। জিও নিউজ বলছে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর গত ৭৬ বছরে এই পরিমাণ মূল্যস্ফীতি দেখেনি দেশটির জনগণ। অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, চলতি এপ্রিল বা আগামী মে মাসের মধ্যেই গড় হিসাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির (হাইপার ইনফ্ল্যামেশন) স্তরে প্রবেশ করবে পাকিস্তান। সে সময় দেশটির মূল্যস্ফীতি পৌঁছাবে ৫০ বা তারও বেশি হারে। পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত মার্চ মাসে পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৫০ দশমিক ২ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে বেড়েছে ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলোতে খাদ্যত্রাণ পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার। কিন্তু সেখানেও ত্রাণের গাড়ি লুটপাট ও খাদ্য নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মানুষ নিহতের ঘটনা ঘটছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকার এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে কার্ডের মাধ্যমে ন্যায্য দামে টিসিবির পণ্য দিচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে প্রতি লিটার ১১০ টাকা দরে ২ লিটার সয়াবিন তেল, ৫৫ টাকা দরে ২ কেজি চিনি, ৬৫ টাকা দরে ২ কেজি মসুর ডাল, ৫০ টাকা দরে ২ কেজি ছোলা। এমন বাস্তবতায় স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম’ স্টোরি সম্পাদকীয় নীতির কাঁচি এড়িয়ে গেলো কীভাবে?

চার. বাজারের হাল-চাল, স্বাধীনতা দিবস ও রাজনীতির কূটচাল সাধারণত সাত বছর বয়সী শিশুকে এমনভাবে প্রভাবিত করে না যে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সঙ্গে চাল-ডালের দামকে সে তুলনার ক্ষমতা রাখে। মেনে নিলাম শিশুটির ছবি ভুলে চলে গিয়েছে। তারপরও, আমার নামে নাম মিতা জাকির এমন কথা বলেছেন কিনা সে সন্দেহ থেকেই যায়। ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়’- বক্তব্যের এ অংশটুকু স্বাভাবিক। বাজার দরে ক্ষুব্ধ যে কেউ বলতেই পারেন। কিন্তু ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ এই বক্তব্যটি একজন দিনমজুরের বিশ্বাস করা কঠিন। বিশেষ করে শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাস ও বক্তব্যের যে গূঢ় অর্থ রয়েছে তা কখনোই একজন দিনমজুরের হতে পারে না। এখানেই উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

পাঁচ. আমার মতো অনেকজন জাকির হোসেনের মেধা যোগ করলে যা দাঁড়াবে তারচেয়েও অনেকগুণ মেধাবীরা প্রথম আলোতে কাজ করেন। তারা কি জানেন না শিশুর অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া তার ছবি ও বিতর্কিত রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশ করা যায় না?

ছয়. সংবাদ প্রকাশের পর প্রথম আলোসহ দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। এসব প্রতিক্রিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও ডিজিটাল সুরক্ষা আইন বাতিলের কথা বলা হচ্ছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ আর ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

সংবিধানের বক্তব্য অনুযায়ী চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা শর্তহীনভাবে নিশ্চয়তাদান করা হয়েছে। অন্যদিকে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতা কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধের শর্তযুক্ত। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ১৯৬৬-এর ১৯(৩) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে বাক-স্বাধীনতার অধিকার চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও অবাধ নয়, বরং শর্তযুক্ত। ১৯(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এ ধারার (২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রয়োগের সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। অতএব, এসব অধিকারের ওপর কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে।

তবে অনুরূপ বাধা-নিষেধসমূহ কেবল আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং সেগুলো: (ক) অন্যের অধিকার ও সুনামের প্রতি সম্মানের জন্য; (খ) জাতীয় নিরাপত্তা অথবা জনশৃঙ্খলা অথবা জনস্বাস্থ্য অথবা নৈতিকতার জন্য যেরূপ আবশ্যক কেবল সেরূপ হবে।’ অন্যদিকে, এই আইনের ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিভেদ, শত্রুতা অথবা সহিংসতা প্ররোচিত করে এমন কোন জাতিগত, বংশগত অথবা ধর্মগত বিদ্বেষের সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা করা আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ থাকবে।’ সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বিশ্লেষণে এটি প্রতীয়মান হয় যে বাকস্বাধীনতার নামে ইচ্ছাখুশি সবকিছু করা যাবে না। কারণ, বাকস্বাধীনতার সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। অনেক সংবাদপত্র মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচার করছে। এমনকি কাবা শরিফের ইমামকে নিয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছে আমাদের সংবাদপত্র। এ দেশের শীর্ষ দৈনিকের সম্পাদক নির্দেশিত হয়ে অসত্য সংবাদ পরিবেশন করেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। আর অনলাইন সংবাদপত্রসমূহের অনেকে আজগুবি, বানোয়াট উদ্দেশ্যমূলক ও নির্লজ্জ মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদিকে বাকস্বাধীনতার নামে ফেসবুক দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ লেখার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলার আসামি সিলেটের গোলাম সারোয়ারের জামিন আবেদনের ওপর আপিল বিভাগে শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারও বিরুদ্ধে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ লেখা, ছবি বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার কোনও মানদণ্ডেই সমালোচনা হতে পারে না। বরং এ ধরনের কাজ ভার্চুয়াল সন্ত্রাস আর যারা এমন কাজ করে তারা ভার্চুয়াল জঙ্গি।

সরকারের সমালোচনার নামে পুরো রাষ্ট্রের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও গ্রহণযোগ্য নয়। ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সাইবার সুরক্ষা আইন কি কেবল বাংলাদেশেই আছে, না পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও আছে? জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড-এর Cybercrime Legislation Worldwide-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৮০ শতাংশ দেশে ইতোমধ্যে সাইবার সুরক্ষা আইন প্রণীত হয়েছে, ৫ শতাংশ রাষ্ট্রে খসড়া আইন রয়েছে, ১৩ শতাংশের সাইবার আইন নেই আর ২ শতাংশ রাষ্ট্রের বিষয়ে তথ্য নেই। প্রতিবেদন অনুযায়ী সাইবার সুরক্ষা আইনে চারটি বিষয় স্থান পেয়েছে– ই-লেনদেন, ডাটা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, সাইবার অপরাধ এবং ভোক্তা সুরক্ষা। ই- লেনদেন বিষয়ে আইন রয়েছে ৮২ শতাংশ রাষ্ট্রে, ডাটা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা বিষয়ে আইন রয়েছে ৬৬ শতাংশ রাষ্ট্রে, সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে ৮০ শতাংশ রাষ্ট্রে আর ভোক্তা সুরক্ষা বিষয়ে ৫৬ শতাংশ রাষ্ট্রে সাইবার আইন রয়েছে।

আমাদের আশপাশের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে যাদের সাইবার সুরক্ষা আইন রয়েছে তাদের মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান, ভিয়েতনাম ও হংকংয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে ভিয়েতনামের সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। সাইবার স্পেস বিশেষ করে ফেসবুকে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়, মানহানি, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় কাউকে আক্রমণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আক্রমণ, মিথ্যাচার, অপপ্রচার, গুজব, উসকানি, পর্নো দৃশ্য ছড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষণ করে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, মিথ্যা এডিট করা ভিডিও কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃশ্য তথা নারীর প্রতি ভয়ানক সাইবার ভায়োলেন্সের কথা প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাইবার হামলা, হ্যাকিং নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠছে। এমন জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাইবার বা ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার উপায় নেই। তবে এই আইনের কিছু বিষয়ের অস্পষ্টতার সুযোগে এর অপব্যবহার স্পষ্টতই লক্ষণীয়। এ পর্যন্ত এই আইনের প্রয়োগ গভীরভাবে পর্যালোচনা করে, এমনভাবে সংশোধন করা উচিত যাতে কেউ অপব্যবহারের সুযোগ না পায়।

সাত. কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বাংলাদেশের নানা বিষয় নিয়ে প্রায়শই উদ্বেগাক্রান্ত হচ্ছেন। অতি উদ্বেগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য যেসব পশ্চিমা দেশ মায়াকান্না করছে তাদের ইতিহাসও খুব সুখকর নয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর প্রকাশক, সম্পাদক ও লেখক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম থেকে ভারতে এসে হিকি ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশ করেন। সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন, নিরপেক্ষ ও সাহসী এক পুরুষ। ট্যাবলয়েড সাইজের দুই পাতার ইংরেজি ভাষার সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি জনসাধারণের কাছে ‘হিকির গেজেট’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিল। নানা অভাব-অভিযোগ ও অসুবিধার কথা যেমন থাকতো, তেমনি থাকতো প্রশাসনের দুর্নীতি ও অন্যায়ের খবরও।

তৎকালীন বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের ভুল নীতির কঠোর সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকে এ গেজেটে। তাছাড়া আদালতে বিশেষ করে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে কী ধরনের বেআইনি কাজকর্ম চলছে ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও খবর প্রকাশিত হতো হিকির গেজেটে। পত্রিকাটিতে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সাহসী সংবাদ প্রকাশের ফলে হিকির পত্রিকার পাঠকপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার শত্রুও বাড়তে থাকে। সরকারের অপকর্ম ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারের নামে প্রহসনমূলক কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করায় গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ও তার বাল্যবন্ধু সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে প্রচণ্ডভাবে খেপে যান হিকির ওপর। হিকিকে শায়েস্তা করার ফন্দি আঁটেন তারা। হেস্টিংস একের পর এক মামলা রুজু করতে থাকেন হিকির বিরুদ্ধে। একসময় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।

হেস্টিংসের ইঙ্গিতেই ১৭৮২ সালের মার্চে প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে বাজেয়াপ্ত করেন হিকির প্রেস, ছাপার কাগজ, যন্ত্রপাতিসহ সবকিছু। ফলে বন্ধ হয়ে যায় হিকির গেজেট। আর এভাবেই অস্তমিত হয়ে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র।

একসময় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিজ মাতৃভূমি ব্রিটেনে যাওয়ার অর্থ সংগ্রহের জন্য চীনের উদ্দেশে জাহাজে যাত্রা করেন হিকি। কিন্তু তার আর চীনে যাওয়া হয়নি। এর আগেই হিকি হয়ে যান সংবাদ। ১৮০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ প্রকাশিত হয় ছোট্ট একটি খবর ‘চীনে যাওয়ার পথে সমুদ্রে জাহাজের মধ্যেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন জেমস অগাস্টাস হিকি।’ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের রোষানলে হিকির গেজেট বন্ধ হয়েছে, হিকির মৃত্যু হয়েছে।

পশ্চিমা সংবাদপত্রের বর্তমান পরিস্থিতিও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। হংকংভিত্তিক পত্রিকা এশিয়া ২০০০-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জ্যান ক্রিক্কি লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে চারটি গোষ্ঠী দেশটির গোটা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্টারনেটের কারণে প্রায় উঠে যাওয়া যে ছাপা পত্রিকাগুলো আছে, তাকে সরকারের তোষামোদ করা যন্ত্র হিসেবে কিছু কোটিপতি বাঁচিয়ে রেখেছে। ইউরোপে বিবিসি ও ডয়চে ভেলে জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’

ভিয়েতনাম যাতে আরেকটি সমাজতান্ত্রিক ঘরানার দেশ না হতে পারে, তা ঠেকাতেই মূলত আমেরিকা ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালায়। যুদ্ধের কারণে তিরিশ লাখ নিহত, তিন লাখ নিখোঁজ, ৪৪ লাখ আহত এবং বিশ লাখ বিষাক্ত রাসায়নিকে আক্রান্ত হয়। সংবাদপত্রে যুদ্ধে মার্কিন ভূমিকাকে দেখা হয় নিদেনপক্ষে মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইরাকে আগ্রাসনের আগে পশ্চিমা গণমাধ্যম সাদ্দাম হোসেনকে যুদ্ধবাজ হিসেবে প্রচার করতে থাকে, অনেকটা অ্যাডলফ হিটলারের মতোই। সিএনএন ও ফক্স নিউজের ভূমিকা এই যুদ্ধে ছিল মার্কিন সরকারের পক্ষে।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডগলাস কেলনার তার বই ‘দ্য পার্সিয়ান গালফ টিভি ওয়ার’-এ বলেছেন, মূলত সিএনএনই মার্কিন জনগণের মনস্তত্ত্বকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে। গবেষণা বলছে যুদ্ধ শুরুর আগেই গণমাধ্যমগুলো যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছিল তাদের সংবাদের মাধ্যমে। টিভি চ্যানেল এমএসএনবিসি বলেছিল, “কাউন্টডাউন ইরাক”, পিছিয়ে ছিল না সিবিএস, তারা সংবাদের বিশেষ সেগমেন্টের নাম দিয়েছিল “শোডাউন উইথ সাদ্দাম”।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর অতি উৎসাহী ভূমিকায় “ওয়ার অ্যাগেইনস্ট টেররিজম”-এর যাত্রা শুরু করে। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক গ্রেগ ডাইক। ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিন গণমাধ্যমগুলোর সমালোচনা করে বলেন, ‘মার্কিন গণমাধ্যমগুলোর অবস্থান স্পষ্টতই যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তা নয়, তাদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছে’। সিএনএনকে ছাড়িয়ে এক নম্বরে যেতে ফক্স নিউজ মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় রেডিও নেটওয়ার্ক ইউএস কেব্ল নিউজ নেটওয়ার্কিং যুদ্ধের পক্ষে দেশজুড়ে র‌্যালি করেছে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার গবেষক ক্রিস্টোফার বেইল নিউ ইয়র্ক টাইমস, ইউএসএ টুডে ও ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত ৫০ হাজার ৪০৭টি সংবাদ ও টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে সিবিএস, সিএনএন ও ফক্স নিউজ-এর প্রায় এক হাজার ৮৪টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করেন।

তিনি এই উপসংহারে পৌঁছান যে টুইন টাওয়ারে হামলার পর মার্কিন গণমাধ্যমের অধিকাংশ খবর জুড়ে মুসলমানদের বিষয়ে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা লিঙ্কনের শিক্ষক লুকিয়ে সারাউবের গবেষণা বলছে, গণমাধ্যম জনমনে ‘ইসলামফোবিয়া’ তথা ইসলামভীতি সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম মুসলমানদের জন্য বেশ কিছু স্টেরোওটাইপ ধারণা প্রচার করেছে, যার মধ্যে ছিল মুসলিম সন্ত্রাসী কিংবা আরব সন্ত্রাসী। এসব ধারণা ইসলাম ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ভয় ও ভুল ধারণাই তৈরি করেছে।

এই হলো পশ্চিমা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। Pearson Global Forum-এর একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ডের সংবাদপত্র পক্ষপাতমূলক আচরণ করে।  

গণতন্ত্রের যাত্রা দীর্ঘ, দুর্গম ও বিপদসংকুল। যেসব দেশের গণতন্ত্র দেখে আমরা চমৎকৃত হই, তাদেরও এই অগম্য যাত্রা পাড়ি দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কয়েক’শ বছরব্যাপী তাদের মাঝে রক্তপাত হয়েছে। কোনও কোনও দেশে গৃহযুদ্ধও হয়েছে। নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে ৫২ বছর বয়েসী বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পানে এগিয়ে চলেছে। অমাদের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে বিদেশি বিনিয়োগ, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা দরকার। বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি এমনভাবে তুলে ধরা উচিত নয় যা বিনিয়োগ, বাণিজ্য অন্যান্য সহযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত। গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসনের নিরন্তর সহযোগী। কাজেই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ ও চূড়ান্ত নয়, শর্তযুক্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অপসাংবাদিকতা ও অপরাধমূলক কাজকে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ