X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ এবং কিছু কথা

সালেক উদ্দিন
১১ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:৪৯আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:২৯

মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশের খবর পেলাম বাংলা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনে। ৯ এপ্রিল প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে– সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এই শোভাযাত্রা বন্ধের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। নোটিশের মূল বক্তব্য হলো, বাঙালি সংস্কৃতির পহেলা বৈশাখ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগণ একে অপরের ধর্মকে সম্মান করে উদযাপন করে থাকে। সেই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামের একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ ঢুকিয়ে দিয়ে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের সরাসরি লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ না হলে তিনি হাইকোর্টে রিট দায়ের করবেন বলেও নোটিশে উল্লেখ করেছেন।

মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করেছে কিনা, এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিনা, এ জন্য হাইকোর্টে রিট করা যৌক্তিক কিনা এ সবই আইনের বিষয়। আইনের বিষয় আইনজীবীরাই ভালো জানেন। ভালো জানেন আইন প্রণেতারা। প্রসঙ্গটি সম্পর্কে আমার লেখার উদ্দেশ্য বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের কর্মসূচির সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রার যোগসূত্র নিয়ে।

বাংলা বর্ষের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সালে। আর এই নববর্ষ প্রবর্তন করেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। প্রজাদের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবরের আমলে ইংরেজি ও আরবি সনের পাশাপাশি নতুন বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। সম্রাটের নির্দেশে তৎকালীন বিখ্যাত চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজী ফসল তোলা ও খাজনা আদায়ের সময় বিবেচনায় রেখে এই নতুন সনের নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন। শুরুতে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন। মুঘল সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে এই সনের গণনা কার্যকর হয়। এদেশের প্রকৃতি ও মানুষের জীবন চারণ কেন্দ্রিক হওয়ায় ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষ একে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে। কালক্রমে সেই অসাম্প্রদায়িক ফসলি সনই পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ হিসেবে।

সম্রাটের সময়ে মানুষদের চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা শোধ করতে হতো। পরের দিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টিমুখ করাতো। বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। সেসময়ের পহেলা বৈশাখে প্রধান ঘটনা ছিল একটি নতুন হিসাব বই বা হালখাতা তৈরি করা।

তারওপরে ক্রমে ক্রমে নববর্ষ বাঙালির সামাজিক অনুষ্ঠানের রূপ নেয়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়।

সকল দুঃখ গ্লানি ও জরা মুছে ফেলে পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করার লক্ষ্যেই বাঙালি জাতি উদযাপন করে অসাম্প্রদায়িক বাংলা নববর্ষ  উৎসব। এই উৎসবে দেশের সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ করে থাকে। সে সময়ে নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ সকালে মরিচ পেঁয়াজ দিয়ে ঢেঁকি ছাটা মোটা চালের পান্তা ভাত খেয়ে দিন শুরু করতো বাঙালিরা।

রান্না করা হতো শতপদের শাকসবজি। খাবারের সঙ্গে থাকতো বিভিন্ন ফলমূলের আয়োজন। তারপর সারা মাস ধরে চলতো বৈশাখী মেলা। গ্রামীণ ব্যবসায়ীরা কদমা, বাতাসা, খই, মুড়কি, নাড়ু ইত্যাদি বিক্রি করতো বৈশাখী মেলায়। বিক্রি করতো হাতপাখা, খেলনা হাতি, খেলনা ঘোড়া, একতারা, ডুগডুগি, ঢোল ইত্যাদি। উৎসবমুখর ঘরোয়া আমেজ ছিল মেলাতে। বিনোদনের জন্য মেলায় বউ নাচনি, পুতুল নাচ, চরকা ঘুরানোসহ নানান আয়োজন থাকতো। এই দিন মানুষেরা নতুন কাপড় পরতো, আনন্দ উল্লাসে সময় কাটাতো এবং প্রার্থনা করতো– সারা বছর যেন এমনই আনন্দঘন থাকে।

পাকিস্তান আমলে বাঙালির নববর্ষ উদযাপন প্রধানত ছিল গ্রাম কেন্দ্রিক। সে সময় শহরে এর প্রসার বিস্তারের প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল এর প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা ও ঘৃণা। ফলে শহরে পহেলা বৈশাখ শুধু পারিবারিকভাবে পালিত হতো। ষাটের দশকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবের মধ্য দিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে শহরাঞ্চলে বাংলা নববর্ষ সামাজিকভাবে উদযাপনে শহরবাসীরা উদ্বুদ্ধ  হতে থাকে। নববর্ষের সামাজিক উৎসব সমূহ গ্রামের মতো পালিত হতে শুরু করে শহরেও। এখন রমনার বটমূল থেকে এ দেশের শহর বন্দর গ্রামগঞ্জ সর্বত্র মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে বাঙালির আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলা নববর্ষের নানা উৎসব।

এবার আসা যাক, বর্ষবরণের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রসঙ্গে নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে এর সাথেও পান্তা ইলিশের বিষয়টিও উল্লেখ করা যেতে পারে। পান্তা ইলিশ মূলত কয়েকজন ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের কারণে নববর্ষ অনুষ্ঠানে চালু হয়েছিল। প্রাচীনকাল থেকে গ্রামবাংলায় নববর্ষের যে উৎসব হতো তাতে পান্তা ইলিশের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। বৈশাখ মাস জাটকা ইলিশের বড় হওয়ার সময়। দেশে ইলিশ সম্পদ রক্ষার্থে নববর্ষে পান্তা ইলিশ খাওয়া বন্ধ হওয়ার বিষয়টি সরকারিভাবে এবং সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত হয়েছে।

পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান মালায় মঙ্গল শোভাযাত্রার সংযোজন হয় আশির দশকে। সময়টি ছিল স্বৈরশাসকের যুগ। ১৯৮৭ সালে যশোরে উদীচীর পৌর পার্কে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান থেকে শুরু হয়েছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেখানে যশোরের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে পৌর পার্ক থেকে বের হয় এক আনন্দ মিছিল, যার নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। দেশে তখন স্বৈরাচার মুক্তির আন্দোলন চলছিল। স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির জন্য মঙ্গল কামনায় ঢোল, খোর করতালের মুখরিত হয়ে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সেদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা পেয়েছিল সার্বজনীনতার মর্যাদা। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা অচিরেই দেশের সব  মানুষের নজর কাড়ে।

১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউট যশোরের আদলে আয়োজন করে চলছে বর্ষবরণ উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা। সংযোজিত হয়েছে আরও ব্যাপক পরিসরে বিশাল আকৃতির বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শন করে।

আইনি নোটিশে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বলেছেন যে, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগণ একে অপরের ধর্মকে সম্মান করে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে কিন্তু  বর্তমানে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামের এই ভাস্কর্য  প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে।

শুরুতেই লিখেছি মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করেছে কিনা, এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিনা, এ জন্য হাইকোর্টে রিট করা যৌক্তিক কিনা এ সবই আইনের বিষয়। সে বিষয়ে আইন প্রণেতারা, আইনজীবীরাই ভালো জানেন। তবে বিষয়টি মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে কিনা সেটা ভালো বলতে পারবেন বিজ্ঞ ধর্ম বিশারদরা। যদি আঘাত না করে তবে এটা চালিয়ে যেতে বাধা নেই। আর যদি মুসলিম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে থাকে তবে অসাম্প্রদায়িক বাংলা নববর্ষে অনুষ্ঠানমালায় থেকে এটাকে পান্তা ইলিশের মতো নিরুৎসাহিত করা খুব একটি কঠিন বিষয় নয়।

সকল দুঃখ গ্লানি ও জরা মুছে ফেলে কল্যাণ বয়ে আনুক এবারের নববর্ষ। পহেলা বৈশাখের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি উদযাপন করুক অসাম্প্রদায়িক বাংলা নববর্ষ উৎসব অনুষ্ঠানমালা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সফলতায় কিছুটা দায়মুক্ত হয়েছি: মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সফলতায় কিছুটা দায়মুক্ত হয়েছি: মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী
ক্রিমিয়ায় মার্কিন নির্মিত ৪টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিতের দাবি রাশিয়ার
ক্রিমিয়ায় মার্কিন নির্মিত ৪টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিতের দাবি রাশিয়ার
‘খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন’
‘খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন’
পশ্চিমবঙ্গ জয়ে এবার মোদির ত্রিপুরী সেনা!
পশ্চিমবঙ্গ জয়ে এবার মোদির ত্রিপুরী সেনা!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ