X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বেঁচে থাকা এক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’

আহসান কবির
১২ এপ্রিল ২০২৩, ২০:৪৮আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ২০:৪৮

সবাই বীর নন, কেউ কেউ বীর। হয়তো বীররাই পারেন আদালতের সংজ্ঞায় ‘রং হেডেড’ পার্সন হয়েও সঠিক কাজটা করতে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পেরেছিলেন; পেরেছিলেন যেকোনও শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্য কথাটা বলতে। সত্য বলার জন্য, দেশকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার কারণে অনেকেই শাস্তি পেয়েছেন, ভবিষ্যতেও হয়তো পাবেন। ঘৃণার জন্য কারও কখনও শাস্তি হয়নি। আমাদের ভালোবাসার অন্যতম বীর মানুষটা চলে গেছেন অচেনা ভুবনে। আজ আর মনে করতে চাইবো না কেন তিনি আদালতে হাজির হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন কিংবা চাননি, কেন তিনি ‘রং হেডেড’ পার্সন হওয়াটাকেই ভালোবেসেছিলেন।

মনে করতে চাইবো না কেন শেষ দিনগুলোতে তাকে অনেক বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। শুধু এটুকু মনে করতে চাইবো যে আমরা জন্মেছিলাম বেঁচে থাকা এক বীরশ্রেষ্ঠর সময়ে, যার নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী!

যতবার শুনি তার কিছু প্রতিবাদ ও সত্য ঘটনা ততবার চলে যাই ভাবনার ভিন্ন মার্গে। ততবার অনুপ্রাণিত হই। মানুষ থাকে না, থেকে যায় অনুপ্রেরণা জাগানিয়া ঘটনার মালা। জাফরুল্লাহ চৌধুরী নেই কিন্তু দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে আমাদের মনে হবে তার অমর কীর্তিগুলো, অনুপ্রেরণার আলোতে মহীয়ান হবে আমাদের প্রতিবাদের বৃক্ষ। সবাই পারে না, জাফরুল্লাহ চৌধুরী পেরেছিলেন। যেমন–

এক. পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শোষণ আর নির্যাতনের প্রতিবাদে যে কয়জন মানুষ লন্ডনের হাইড পার্কে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তিনি তার মধ্যে একজন। পাসপোর্ট ছিঁড়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন– তিনি এখন থেকে রাষ্ট্রবিহীন পৃথিবীর বাসিন্দা। মানচিত্রবিহীন মানুষ হিসেবে কাগজপত্র জোগাড় করেছিলেন লন্ডনে থাকতেই। কেউ জানতো না তিনি তখনই তাঁর হৃদয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রটা এঁকে রেখেছিলেন।

দুই. শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে লিখেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও মোবিনের কথা। এফআরসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য তিনি চার বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। দুটো পরীক্ষা বাকি থাকতেই সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবার। যুদ্ধে যাবার ঘটনাটাও পুরোপুরি ফিল্মি।

বিমানে থাকলে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না, এটা জানার পর পাঁচ ঘণ্টা বিমান থেকে নামেননি ডা. চৌধুরী ও ডা. মোবিন। সিরিয়ান এয়ারলাইনসের ওই বিমান থেকে এই দুজন মানুষকে গ্রেফতার করার জন্য উপস্থিত ছিলেন এক পাকিস্তানি কর্নেল। যাত্রীদের জানানো হয়েছিল বিমান পাঁচ ঘণ্টা লেট। সিরিয়ার সহযোগিতায় পাকিস্তানি কর্নেল তাদের গ্রেফতার করতে চাইলে এই দুই জন জানিয়েছিলেন তারা পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন না। সুতরাং গ্রেফতার করার অধিকারও তাদের নেই। এরপর এই দুজন মানুষ পৌঁছাতে পেরেছিলেন ভারতে। সময়টা ছিল ১৯৭১-এর মে মাস। তারা যোগদান করেছিলেন দুই নম্বর সেক্টরে।

তিন. ডা. এম এ মোবিন (চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক)-এর সঙ্গে ডা. চৌধুরী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল’। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও স্থানীয় জিবি হাসপাতালের সার্জন রথিন দত্তের সার্বিক সহায়তায় এই হাসপাতালটি গড়ে তুলেছিলেন ত্রিপুরার মেলাঘরের হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে।

চার. স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভালোবাসায় কুমিল্লা থেকে সাভারে স্থানান্তর করেছিলেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। হাসপাতালের নাম হিসাবে বঙ্গবন্ধু তিনটি নাম বলতে বলেছিলেন। দ্বিতীয় নামটা ছিল ‘গণস্বাস্থ্য’। গণস্বাস্থ্য বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ওষুধের জন্য এক ‘দলছুট’ যাত্রা। শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মানুষ যখন পণ্য বা ব্যবসা বানাতে ব্যস্ত তখন ডা. চৌধুরী সাধারণ মানুষের জন্য একটা ‘গরিবের আধুনিক হাসপাতাল’ বানানোতে সচেষ্ট ছিলেন। এফআরসিএস ডিগ্রি নেননি, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ঝুঁকি নিয়ে বিমানে চড়ে বসেছিলেন, স্বাধীনতার পর নেতা, মন্ত্রী কিংবা বড় ব্যবসায়ী হতে পারতেন। চিকিৎসা সুবিধা মানুষের নাগালে রাখার সাধনা ছাড়া তিনি অন্য কিছুর সঙ্গে সহসা জড়াননি। জড়িয়েছিলেন সত্য কথা বলার জন্য প্রতিবাদে, প্রতিবাদকে তিনি শিল্পে পরিণত করেছিলেন। যেমন–

এক. যখন তিনি গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন তার পরপরই সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের সঙ্গেও নতুন করে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তিনি কারও সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বিশ্বাস বা দর্শনের ফারাক থাকলেও তিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারতেন– দেশপ্রেম তার (সিরাজ সিকদারের) মিথ্যা ছিল না। সিরাজ সিকদার নিহত হবার পরও তার প্রতি ডা. চৌধুরীর ভালোবাসা কমেনি। উল্টো সিরাজের পরিবারের প্রতি তিনি সহমর্মী ছিলেন।

দুই. জিয়াউর রহমানের আমলে মন্ত্রী হতে পারতেন। হননি। বরং নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করেছেন। জিয়াউর রহমানের বিপক্ষে জেনারেল ওসমানী যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন তখন তিনি প্রভাবক ভূমিকা পালন করেছিলেন! জিয়াউর রহমান ডা. চৌধুরীকে ব্ল্যাংকচেক দিতে চেয়েছিলেন। ডা. চৌধুরী বলেছিলেন, যারা ব্ল্যাংকচেক দিতে চায় তাদের আসলে কোনও টাকাই থাকে না।

তিন. এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতকে বদলে দিয়েছিলেন। যে দেশে বিদেশি ওষুধ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না, যে দেশে অনেক দাম দিয়ে ওষুধ কিনতে হতো, সেই দেশে তিনি যুগান্তকারী ‘ওষুধনীতি’ প্রণয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আজ যে ওষুধের দাম তুলনামূলক কম, আজ যে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করে, এটা ডা. চৌধুরীর দেশপ্রেমমূলক চিন্তার ফসল।

আজীবন এমনই ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সত্য কথা বলা আর প্রতিবাদকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। দলছুট হয়ে দেশপ্রেম আর মানুষের সেবায় একা একা পথ হাঁটতে শিখেছিলেন। যারাই ক্ষমতায় ছিল হয়তো সহায়তা নিয়েছেন মানুষের জন্য, নিজের জন্য না। যেমন-

এক. গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার পর নারীদের অধিক মাত্রায় হাসপাতালের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। সাইকেল চালানো, ড্রাইভিংসহ প্রশিক্ষিত নার্স বা চিকিৎসার কাজে নারীদের সংখ্যা তার প্রতিষ্ঠানে ৪০ শতাংশের বেশি। ১৯৭৭ থেকেই তিনি এটা শুরু করেছিলেন।

দুই. হাসপাতাল বানাতে চেয়েছিলেন, পাঁচতারা হোটেল বানাতে চাননি। চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষ যেন কম মূল্যে আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। প্রশাসনও তথাকথিত স্মার্ট বানাতে চাননি, সেবার মানসিকতা বজায় রাখার পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

তিন. বহু দিন ধরে দুটো কিডনি নিয়েই জটিলতা ছিল। তিনি নিজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করিয়েছেন, কিন্তু সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকায় গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে রাজি হননি। এটাও এক ধরনের প্রতিবাদ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় নিকটাত্মীয় ছাড়া কিডনি দান করা যায় না। তিনি এই আইন বদলাতে চেয়েছিলেন। করোনার সময়েও তিনি স্বল্পদামে ওষুধ আর টিকা সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন। বাকিটা আর না বলি।

চার. যে স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশ কী কখনও সেদিকে যাবে? কেউ কী কল্পনা করতে পারেন যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু মালিক নন। গণস্বাস্থ্যের সম্পদের পরিমাণ এখন শত কোটি টাকা। জানামতে ডা. চৌধুরীর কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই।

কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা? জীবনভর সত্য বলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। নিজ জীবনে ভোগবিলাস করতে যাননি। ৭৭ সালে পেয়েছিলেন স্বাধীনতা পদক। পেয়েছেন দ্বিতীয় নোবেল খ্যাত রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার। পেয়েছেন বিদেশ বিভুঁইয়ে নামি মানবতা পুরস্কার। শেষযাত্রায় তাকে শহীদ মিনারে রাখা হবে। গান স্যালুটের পর বিদায়ী বিউগলের সুর হয়তো তার কথাই বলবে। পত্রিকা আর রেডিও টেলিভিশনগুলো চট্টগ্রামে তার জন্ম, ঢাকা শহরে বেড়ে ওঠা, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিক্যালের জীবন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা দেশ স্বাধীন হবার পর তার স্বাধীন যাত্রার কথা বলবে।

কেউ কী বলবে তিনি জনগণের পক্ষে সত্য কথা বলতে চেয়েছিলেন? কেউ কি বলবে তিনি শিক্ষা আর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পণ্য বানাতে চাননি, সাধারণ মানুষের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন? কেউ কি বলবে বেঁচে থাকা বীর হিসেবে তিনি আজীবন শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে নিমগ্ন ছিলেন? কেউ কি বলবে তিনি অনেকটাই একা ছিলেন?

শেষযাত্রায় একটাই অনুরোধ আপনার কাছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আপনার এই স্বপ্নযাত্রার প্রেরণা দিয়ে যান আমাদের।

কেউ কেউ যেন আপনার মতো হতে চাই, হতে পারি আমরা।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ