X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মানদণ্ড কী?

মো. জাকির হোসেন
১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:৫৯আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ২০:০৪

জাতিসমূহের মধ্যে দূত বিনিময় স্মরণাতীতকাল থেকে চলে আসছে। অতীতে দুটি দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে কয়েক দিন কিংবা কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হতো। ফলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণও বিলম্বিত হতো। এরই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করার প্রথাগত বিধান চালু হয়। কূটনীতিকদের কার্যপরিধি, দায়-দায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা ও দায়মুক্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনে প্রণীত হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কূটনীতিকদের কাজ হলো–

এক. গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা;

দুই. আইন মোতাবেক গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করা;

তিন. গ্রহীতা রাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা;

চার. গ্রহীতা রাষ্ট্রে বিদ্যমান যেকোনও অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা নিজ রাষ্ট্রের সরকারকে অবহিত করা; এবং

পাঁচ. প্রেরক রাষ্ট্র ও গ্রহীতা রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করা ও তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্কের প্রসার ঘটানো। আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রদূতদের কোনোভাবেই কোনও রাষ্ট্রের নির্বাচন-রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য রাখার কিংবা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ নেই।

১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন কূটনীতিকদের আচরণ ও নিষিদ্ধ কার্যাবলির তালিকার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ আইন নয়। কালের পরিক্রমায় কূটনৈতিক রীতি-প্রথা ও নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিকদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি গড়ে উঠেছে। এসব আচরণবিধি বিধিবদ্ধ করা না হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে।

১৯১৭ সালে Sir Ernest Satow-এর লেখা বই A Guide to Diplomatic Practice এবং ২০১৬ সনে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক Paul Behrens-এর বই Diplomatic Interference and the Law প্রণিধানযোগ্য। এ বই দুটিতে গ্রহীতা রাষ্ট্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ, গ্রহীতা রাষ্ট্রের সরকারের সমালোচনা, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের সীমাবদ্ধতার বিষয় বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।

১৯৬১ সালের ভিয়েনা চুক্তির ৪১ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কূটনীতিকদের দায়িত্ব হলো গ্রহীতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।” এটি কোনও প্রথা বা সৌজন্যতার বিধি নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যতামূলক বিধান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, হস্তক্ষেপের অভিযোগে গ্রহীতা রাষ্ট্র কূটনীতিকদের সতর্কতা, বহিষ্কার এবং এমনকি কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। জানা ইতিহাস মতে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রথম ঘটনা ঘটে ১৫৮০ সালে। ইংল্যান্ডে নিযুক্ত স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত বার্নার্ডিনো ডি মেন্ডোজা প্রথম এলিজাবেথকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র ‘Throckmorton Plot’-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাধারণের প্রত্যাশা ছিল এই ঘটনায় রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু, এলিজাবেথের উপদেষ্টা আলবেরিকো জেন্টিলির পরামর্শে তাকে বহিষ্কার করা হয়। আন্তর্জাতিক আদালত Tehran Hostages মামলায় বলেছেন, কূটনৈতিক দায়িত্বের অপব্যবহার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ।

১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পোলিশ রাষ্ট্রদূত জার্মানির সমালোচনা করে বক্তব্য দিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশমন্ত্রী লিখিত পত্র দিয়ে পোলিশ রাষ্ট্রদূতকে হুঁশিয়ার করেন যে মার্কিন বন্ধুরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে বক্তব্য প্রদান কূটনীতিকের কাজের আওতাভুক্ত নয়। ১৯৭০ সালে যুগোস্লাভিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সিলবারম্যান যুগোস্লাভিয়া সরকার কর্তৃক কারাবন্দিকৃত একজন আমেরিকান নাগরিককে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। রাষ্ট্রপতি টিটো এই ঘটনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে যুগোস্লাভিয়ার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করেন। ১৯৮০ সালে নিউজিল্যান্ডে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত সোফিনস্কিকে নিউজিল্যান্ড সমাজতান্ত্রিক ঐক্য পার্টিকে অর্থ সহায়তা দেওয়ায় বহিষ্কার করা হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডে মার্কিন রাষ্ট্রদূত শ্যাননকে ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিরোধী ফাইন গেইল পার্টির প্রচার প্রচারাভিযানের বাসে দেখা যাওয়ার পর আইরিশ প্রধানমন্ত্রী হাউহে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে শ্যাননকে তীব্র তিরস্কার করেন। রাষ্ট্রদূত শ্যানন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন, তিনি পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রচারাভিযান দেখতে গিয়েছিলেন। আইরিশ প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, তার নিজের দলের প্রচারাভিযানেও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সম্পৃক্ততাকে কোনোভাবেই তিনি স্বাগত জানাবেন না।

১৯৮৪ সালে ফ্রান্সে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত Evan Galbraith কমিউনিস্টপন্থিদের ফরাসি সরকারে যোগ দেওয়ার সমালোচনা করে বলেন, সবাই জানে কমিউনিস্টরা সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। Evan Galbraith-এর বক্তব্যের পর ফরাসি প্রধানমন্ত্রী Pierre Mauroy তাকে ডেকে পাঠান এবং তার বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য বলে হুঁশিয়ার করে দেন। কিউবার মার্কিন দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব ছিলেন রবিন মেয়ার। ১৯৯৬ সালে সরকারবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের সাক্ষাৎকার নেয় মেয়ার। কিউবা রাষ্ট্রদূত মেয়ারকে বহিষ্কার করে। কিউবা অভিযোগ করে যে মেয়ার কূটনীতি নয়, প্রতিবিপ্লবে জড়িত ছিলেন। পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেসব ইন্দোনেশীয় সহিংসতায় জড়িত ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলেন ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এটি ২০০০ সালের ঘটনা। ইন্দোনেশিয়ার সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্যকে ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিযুক্ত করে। আরেকটি ঘটনায় ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত Robert Gelbard ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে দেশটির সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে Agus Wirahadikusumah-কে নিয়োগদানের চাপ সৃষ্টি করলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী Mahfful তাকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে প্রতিহত করেন।

জিম্বাবুয়েতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘জিম্বাবুয়েতে (রাজনৈতিক) সহিংসতা বন্ধ করতে হবে’। এর জের ধরে জিম্বাবুয়ে সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যাকজিকে মন্ত্রণালয়ে তলব করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক করে। এটি ২০০৮ সালের ঘটনা। এর আগে ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিদেশমন্ত্রী Mumbengegwi একদল পশ্চিমা কূটনীতিককে ডেকে হুঁশিয়ার করে দেন যে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী জিম্বাবুয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। ২০০০ সালের আরেকটি ঘটনায় পেরুতে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রবার্ট হার্টকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রদূত রবার্ট হার্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর মন্তব্য করেছিলেন যে নির্বাচনের প্রচারণা ও নির্বাচনের দিন প্রচুর অনিয়ম হয়েছে। ২০০৪ সালে মেসিডোনিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ভোটারদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই ঘটনায় মেসিডোনিয়া সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘গুরুতর হস্তক্ষেপ’ করার অভিযোগ করেছিল। ২০০৭ সালে সুদানে নিযুক্ত কানাডিয়ান চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মিসেস ললর এবং ইইউ কূটনীতিক ডিগারফেল্ডকে বহিষ্কার করে সুদান। রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আটককৃত ও কারাবন্দি বিরোধী নেতাদের মুক্তির জন্য রাষ্ট্রদূতরা আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেনিয়ায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার এডওয়ার্ড ক্লে ২০০৪ সালে কেনিয়ায় ব্রিটিশ বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের এক বৈঠকে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ কেনিয়া সরকার ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে তলব করে তার মন্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বলে সমালোচনা করে এবং এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয়।

অনুরূপ আরেকটি ঘটনায় সিয়েরা লিওনে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত কার্ল প্রিঞ্জ সিয়েরালিওন সরকারের দুর্নীতির সমালোচনা করায় এটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় সিয়েরা লিওনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সতর্ক করে যে তার মন্তব্য কূটনৈতিক আইন, প্রথা ও শিষ্টাচারবিরোধী। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, ২০১০ সালের মে মাসে, স্লোভাকিয়ায় নিযুক্ত ১০টি দেশের রাষ্ট্রদূত একটি যৌথ খোলা চিঠি প্রকাশ করেছিল– যাতে তারা লেসবিয়ান, গে, উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের (এলজিবিটি) প্রাইড প্যারেডের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। স্লোভাকিয়া রাষ্ট্রদূতদের এই পত্র প্রকাশকে স্লোভাকিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিযুক্ত করে। ফিজিতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রীনিবাসন ফিজিতে অবস্থিত ভারতীয় মন্দিরে বোমা নিক্ষেপের প্রতিবাদে ও সমস্যার সমাধানকল্পে ফিজির সংবিধানে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বিধান সংযোজনের বিবৃতি দেয়। এই ঘটনায় ফিজি শ্রীনিবাসনকে বহিষ্কার করে।

নেপালে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রাকেশ সূদ নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রর সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে কূটনীতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে প্রতিবাদকারীদের ‘তথাকথিত পানি বিশেষজ্ঞ’ এবং প্রতিবাদকে ‘ভারত ফোবিয়া’ আখ্যায়িত করলে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি হাইকমিশনারের বক্তব্যকে ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিচ্যুতি’ বলে অভিহিত করেন। কূটনৈতিক প্রাঙ্গণ অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগে হন্ডুরাস ব্রাজিলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করেছিল। হন্ডুরাস অভিযোগ করেছিল যে ব্রাজিলের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ব্রাজিলিয়ান মিশনের প্রাঙ্গণকে হন্ডুরাসের নির্বাচনি প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন।

১৯৬১ সালের ভিয়েনা চুক্তির অনুচ্ছেদ ৪১(১) লঙ্ঘনের অভিযোগে হন্ডুরাস মামলাটি দায়ের করেছিল।

বাংলাদেশে নিযুক্ত কোনও কোনও পশ্চিমা দূতাবাস রাজনৈতিক সংগঠনের মতো মাঠে নেমেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলে এবং বাংলাদেশে আজ্ঞাবহ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে নানা অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত। এরই অংশ হিসেবে একটি দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তির তৈরি তথ্যচিত্র পোস্ট করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আজকাল হামেশাই খবর বেরোয় বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। বৈঠক শেষে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে রাষ্ট্রদূত ও বিএনপি নেতৃবৃন্দের ছবি ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দ আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুটা লুকোচুরির আশ্রয় নেন। কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে– এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে অপারগতা জানান। রুদ্ধদ্বার বৈঠক কখনও কোনও বিএনপি নেতার বাসায় কিংবা কখনও পশ্চিমা কোনও রাষ্ট্রদূতের বাসায় অনুষ্ঠিত হয়। এসব রুদ্ধদ্বার বৈঠকের হকিকত কী? বৈঠক রুদ্ধদ্বার হওয়াই বলে দিচ্ছে, ‘ডাল ম্যা কুছ কালা হ্যায়’।

বাংলার নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ক্লাইভের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের সময় কাশিম বাজার কুঠিতে এমন গোপন বৈঠক হতো। সহজেই অনুমান করা যায়, রাষ্ট্রদূতের কাছে বিএনপির চাওয়া শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে একটি অনির্বাচিত সরকারের ব্যবস্থা করা। এর ফলে বিএনপি জয়লাভ করবে আর দেশে গণতন্ত্রের জোয়ার বইতে শুরু করবে। এতে পশ্চিমাদের লাভ কী? পশ্চিমারা গণতন্ত্রের রফতানি কি বিনামূল্যে করবে? অবশ্যই না। উদাহরণস্বরূপ, ইরাকে গণতন্ত্র রফতানি বাবদ ৪০ বিলিয়ন ডলারের তেলসম্পদ লুটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে।

ইরাক যুদ্ধের প্রথম বছরেই যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানি Halliburton-এর আয় বেড়েছিল ৬৮০ শতাংশ। ইরাক সরকার জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করেছে যে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ তেল বিক্রি করে ১৭ বিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে গেছে। এই চুরির অর্থ শনাক্ত করে তা উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছে ইরাক সরকার। Syrian Arab News Agency SANA-র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশ, যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানি প্রতিনিয়ত সিরিয়া থেকে তেল, গ্যাস ও গম চুরি করে তা ইরাকে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সিরিয়ার তেল মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ভাড়াটিয়া বাহিনী প্রতিদিন গড়ে ৬৬ হাজার ব্যারেল তেল চুরি করে ইরাকে পাচার করছে। এর ফলে সিরিয়ার তেল সম্পদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ১০৫ বিলিয়ন ডলার।

পশ্চিমাদের নিজ দেশের গণতন্ত্রের গুণগত মান যা-ই হোক তাদের রফতানি করা গণতন্ত্রের গুণগত মান অতি নিকৃষ্ট প্রকৃতির। এই গণতন্ত্রের বিষক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্য তছনছ হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অসংখ্য অবকাঠামো ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রোজগারের উপায় হারিয়ে লাখো মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে কুকুর-বিড়ালের মতো তাড়া খেয়ে ইউরোপের নানা দেশের সীমান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে। সাগরে সলিল সমাধি হয়েছে অনেকের। পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের বিষক্রিয়ায় কেবল আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াই নয়, আফ্রিকার তিউনিশিয়া, সোমালিয়া, মালি, নাইজেরিয়া, নাইজার, সুদান ও কেনিয়া ‘গণতন্ত্র বিষে’ জর্জরিত।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র রফতানিতে কি বিনিময় নেবে পশ্চিমারা?

পশ্চিমা যেসব দেশ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তাদের অনেকেই বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক র‌্যাংকিংয়ে পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ নয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনও মনে করে গত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। আর ডেমোক্র্যাটদের একটি বড় অংশ মনে করে, এর আগের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ে রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে। পশ্চিমা কোনও কোনও দেশে বাংলাদেশের চেয়ে অনেকগুণ বেশি সাংবাদিককে কারাবন্দি কিংবা মামলা দায়ের করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী  যুক্তরাষ্ট্রে গত তিন বছরে ২১৯ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর বাইরে শত শত সাংবাদিক বৈষম্য, শারীরিক নির্যাতন, আক্রমণ ও হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। মানবাধিকারের মূলনীতি সাম্য ও বৈষম্যহীনতা থেকে ইউরোপ, আমেরিকা এখনও অনেক দূরে। এই তো কয়েক দশক আগেও ইউরোপের অনেক দেশে আফ্রিকার কালো মানুষদের খাঁচাবন্দি করে আনন্দ উপভোগ করা হতো। বর্ণবাদ সমাজ ও রাজনীতির গভীরে প্রোথিত রয়েছে এসব দেশে।

কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত র‌্যাবের বিতর্কিত তথ্যচিত্র ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা যুক্তরাষ্ট্রে নৈমিত্তিক ঘটনা। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১ হাজার ১৪ জন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টানা চার বছর ধরে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১ হাজারের কাছাকাছি। ‘ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দেশটির ১ হাজার ১৭৬ জন নিহত হয়েছেন। টার্কিশ মিডিয়া আউটলেট (টিআরটি ওয়ার্ল্ড)-এর প্রতিবেদন অনুসারে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শীর্ষে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১ জুন, ২০২০-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে মোট ৭ হাজার ৬৬৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমা দূতদের হস্তক্ষেপের নেপথ্যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। সাধু সাবধান!



লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খিলগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
খিলগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
‘দাবদাহের মধ্যে কষ্ট হলেও মানুষ ভোট দিতে আসবে’
‘দাবদাহের মধ্যে কষ্ট হলেও মানুষ ভোট দিতে আসবে’
ইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
প্রয়াণ দিনে স্মরণইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ