X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

নগর রাজনীতিতে ক্ষমতার খেলা, পুলিশ ও ওয়েব সিরিজ ‘মহানগর’

ড. রাশেদা রওনক খান
২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:০২আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:০২

ইদানীং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দর্শকের কাছে যেমন জনপ্রিয়, তেমনই তরুণ গবেষকদের কাছেও রয়েছে তার কদর। আমার সঙ্গে গবেষণা করেছে, এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এই প্ল্যাটফর্মের কন্টেন্ট বিশ্লেষণ নিয়ে আমারও আগ্রহ তৈরি হয়। তাছাড়া বিভাগের ভিজ্যুয়াল অ্যানথ্রপলজি ক্লাবের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে এই ধরনের কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা আমাদের মাঝে চলমান একটি প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মহানগর দেখা। উপরন্তু, আমার পিএইচডি’র গবেষণার বিষয় নগর রাজনীতি, ফলে মহানগর সিরিজটি দেখার সময় মেট্রোপলিটনের রাজনীতিকে বাস্তব আর পরবাস্তবের জালে কীভাবে আটকেছেন পরিচালক, তা বিশ্লেষণ করার আগ্রহ তৈরি হয়।

মহানগরের দুটি মূল কথা তাদের প্রচার প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হচ্ছে– এক. সকল মিথ্যাই মিথ্যা; দুই. সবার চোখে যেটা সত্য, সেটা সত্য নাও হতে পারে। লাইন দুটি মনে ধরেছে।

আলোচনা শুরু করি দ্বিতীয় লাইনটি নিয়ে, প্রথম লাইনটিতে পরে আসছি। ১৯৮৬ সালে জেমস ক্লিফোর্ড সম্পাদিত ‘রাইটিং কালচার’ বইটিতে ‘আংশিক সত্য’ (Partial Truth) ধারণা দেন, যেখানে তিনি বলতে চাইছেন, পূর্ণাঙ্গ সত্য বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো আংশিক সত্য। ধরুন, আপনার কাছে যা সত্য মনে হচ্ছে, আমার কাছে তা যুক্তি দিয়েই মিথ্যা বা পুরোপুরি সত্য নয় মনে হতে পারে। যেমন– গুম, খুন, ধর্ষণ, ক্রসফায়ার এসবই সমাজে বিদ্যমান, কিন্তু এসব ঘটনা যার সঙ্গে ঘটেছে, তার কাছে এসবের সত্যতা যতটুকু, সেটুকু সত্যতা যার সঙ্গে ঘটেনি, তার কাছে নাও থাকতে পারে। আবার, একটি ঘটনার দর্শক হিসেবে আপনি নিজে যে যুক্তিটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন, পাশের দর্শক ঠিক তাকেই অগ্রহণযোগ্য মনে করে খারিজ করে দিতে পারেন। ফলে, ব্যক্তি মানুষ আসলে নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে, নিজের অভিজ্ঞতা ও যুক্তির ওপর ভিত্তি করে একটি ঘটনার সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করেন। কিন্তু প্রথম লাইনটি নিয়ে একটা প্রশ্নবোধকের উদয় হয়। মহানগরে বোমাবাজির মিথ্যা মামলায় মামুন ওসি হারুনের সহায়তায় মুক্তি পেলেও বাস্তবের মামুনরা অনেকেই মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর কারাগারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না?

মিশেল ফুকোর ‘Discipline and Punishment’-এর চক্রে নিরীহ অনেক মানুষের স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না?

পরিচালক আশফাক নিপুন তার সিরিজজুড়ে কেবল মহানগরের রাজনীতি দেখিয়েছেন তাই নয়, সত্য মিথ্যা উদঘাটনে ব্যস্ত আমাদের দ্বিধান্বিত নাগরিক মনকে নিয়ে তিনি উপস্থাপনার রাজনীতিও করেছেন। পরিবেশনের রাজনীতিতে সত্য-মিথ্যা নির্মাণের যে কৌশল স্টুয়ার্ট হল বিশ্লেষণ করেছেন, তা থেকে নিপুন খুব দূরে নন, বরং বেশ অনুপ্রাণিত বোধ করি। সিরিজটিতে রাষ্ট্রের ‘পুলিশ’ ইমেজ উপস্থাপনে ব্যাপক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, যেখানে পরিচালক  ইমেজটিকে পেন্ডুলামের কাঁটার মতো দোদুল্যমান  রেখেছেন দুটো সিরিজ ধরেই। যেমন, ওসি হারুনকে নিয়ে দর্শক ভাবে এক, পরিচালক দেখায় আরেক। কখনও চরিত্রটি আপাতভাবে স্বচ্ছ মনে হলেও কোথায় যেন ঠিক বোঝে ওঠা যায় না। এখানে ‘আইনি’ বাহিনীর ‘বেআইনি’ কাজ কী করে ‘স্বাভাবিকায়ন’ হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ততা তৈরি করে, তা বোঝার জন্য দর্শকের মনোজগৎ নিয়ে এক ধরনের খেলা খেলেছেন নিপুন, যা মহানগর পুলিশের কার্যক্রম ও কাজের পরিধি সম্পর্কিত ধারণার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎপাদন আর পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ বুঝতে খুব জরুরি হয়ে পড়ে। হারুন চরিত্রটি সত্য-মিথ্যার দোলাচলে অপরাধ, পুলিশ, উপরের আদেশ-নির্দেশ, অভিযান, নিরীহ মানুষের আটক, মানবিকতা বা আইন-প্রয়োগ নিয়ে দর্শকের রাজনৈতিক চেতনা বা কল্পনার একটি স্ববিরোধী প্রতীকী চরিত্র হয়ে ওঠে। বিষয়টা একটু সহজ করে বলি।

মহানগরে উপস্থাপিত পুলিশের ইমেজ আর দর্শক মনে পূর্ব থেকে মিশে থাকা পুলিশের ইমেজ- এই দুই বিপরীত কল্পনা বা ইচ্ছার প্রতীক, যা দিয়ে তারা বাস্তবের ‘পুলিশ’ নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে। এই ভাবনায় বাস্তবতা যেমন থাকে, পরাবাস্তবতা বা অতি বাস্তবতাও থাকে। এই বৈপরীত্যেরই হাজারো প্রকাশ আছে আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় আর দৈনন্দিন চর্চায়, তবে ওসি হারুনের চরিত্রটিকে নিয়ে এই বাইনারি অপজিশনের সাইকোলজিক্যাল খেলা যেভাবে খেলেছেন পরিচালক, তা অনেকটাই দর্শককে কনফিউজড করতে সহায়তা করেছে, একই সঙ্গে চমক আনতেও। গল্পের মৌলিকত্ব বজায় রাখতেও এই বাইনারি ধারণা উল্লেখযোগ্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ‘পুলিশ’ নিয়ে আমাদের কল্পনায় যে ইমেজ আটকে আছে, তাও কিন্তু বাইনারি হবারই কথা ছিল, কিন্তু আমরা আমাদের মনোজগতে একটা কাঠামো তৈরি করে পুলিশ ইমেজটিকে সেই ছাঁচে আটকে রাখি বলে কাঠামোকে ভাঙা গড়ার খেলায় মেতে ওঠা ওসি হারুনের চরিত্রকে দেখে আন্দোলিত হই। যেই পুলিশ নিরীহের জন্য কঠোর কঠিন, সেই পুলিশ ক্ষমতাশীলদের কাছে শিথিল। আবার উল্টোটি যে হয় না, তাও তো নয়। হয়তো ক্ষমতাশীলরা ক্ষমতার ফাঁকফোকর খুঁজে ঠিক বের হয়ে যান একসময়। যাহোক, পোস্টমডার্নিস্ট ভাবনায় আলোড়িত ছিল ওসি হারুনের চরিত্র নির্মাণ, তা বলা যায় অনায়াসেই।

শার্লক হোমস পুলিশের লোক না হলেও অপরাধ তদন্তে তার দক্ষতা ছিল পুলিশের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে ওসি হারুন পুলিশের লোক হয়েও, তাও আবার বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের পুলিশ হয়ে, আইনের সীমার মধ্যে থেকে সেই কাজটি করতে পেরেছিলেন মহানগরে। এখানে ওসি হারুনকে গ্লোরিফাই করার চিন্তা কাজ করেছে পরিচালকের, নাকি তা ছিল রাষ্ট্রীয় পুলিশ ইমেজের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া, তা স্পষ্ট না।  কারণ, ওসি হারুন প্রায় সব কাজই করেন আইনের সীমার মাঝে, কিন্তু আবার কিছুটা বাইরে গিয়েও। তাকে বিভিন্ন ‘চাপ’র মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়, নিজ থানার জুনিয়র অফিসার মলয় তাকে ডিবির হাতে ধরিয়ে দেয়, অপরাধের দায়ে তাকে আটকে রাখা, আটকের মাঝেই তার চাতুরতা, মানবিকতা, দায়িত্ববোধ, জিজ্ঞাসাবাদ সবই চলছে একসঙ্গে। অন্যদিকে টাকা চেনেন বলে হারুনের প্রথম থেকে যে ইমেজ মনে হচ্ছিল, সেই হারুন খুব মানবিক বলে সেই মলয়ের প্রতি তার কোনও আক্রোশ জন্মায় না, বরং মলয় এখনও পৃথিবী চেনেনি বলে প্রায় ক্ষমা করে দেওয়ার ভঙ্গি করেন।

আবার যেই বন্ধু ডিবি অফিসারের ওপর তার এত নির্ভরতা, সেই তাকে গুলি করে। শেষ দৃশ্যের এই ঘটনাটি চমক এনেছে ঠিকই, কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বুদ্ধিদীপ্ত হারুনের দূরদর্শী বুদ্ধিমত্তাকে।

তবে পরিচালক সামনের সিজনে এটাকে নিছক কল্পনা হিসেবেও দেখতে পারেন। কারণ, ডিবির তদন্ত শেষে ওসি হারুনের বুদ্ধি ও কনফিডেন্স লেভেল আরও কয়েকশ’গুণ বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যুক্তিতে এই হিসাবে গরমিল হয়ে যায়। এই ধরনের মেরে ফেলার কল্পনা এমপি রজব আলীরও হতে পারে। যাহোক, দ্বিতীয় সিজনে ওসি হারুনের খেলা শেষ হয়েছে কী হয়নি, তা সময় বলে দেবে। তৃতীয় সিজন নির্মিত হলে চিত্রনাট্যকার হারুনকে সারিয়ে তুলে রজব আলীর সঙ্গে নতুন খেলা দেখাবেন নাকি ওসি হারুনের জায়গায় মলয়কে ফিরিয়ে আনবেন তা দেখার বিষয়। তবে এটাই সত্য, রজব আলীরা তাদের নির্দেশের নড়চড় হলে কাউকে সরিয়ে দিতে সময় নেন না, যা আমরা আমাদের সমাজেই দেখতে পাই।

সিরিজ-২-এর  সর্বশেষ দৃশ্যে উদ্বেলিত পাঠকের মনে হয়তো ইতোমধ্যে লেভিস্ট্রসের কাঠামোগত বিশ্লেষণ পাওয়ার আশা তৈরি হয়েছে, কিন্তু ওসি হারুনের স্ট্রাকচার থেকে বের হবার ক্ষমতা ও পরিচালকের বিনির্মাণবাদের প্রতি যে আগ্রহ তা দেখে বলা যায়, পরিচালক সামনের সিরিজে কাঠামোকে ভেঙে বিনির্মাণের পথেই হাঁটবেন। মহানগরের স্টোরিলাইন যে প্রবলভাবে জ্যাক দেরিদা’র বিনির্মাণবাদ দ্বারা প্রভাবিত, তা পুরো সিরিজে দৃশ্যমান। তবে, কাঠামোতে বা ছাঁচে ফেলা প্রতীকী চরিত্রগুলো যেভাবেই বিনির্মিত হোক না কেন, বাস্তব চরিত্রগুলো যে আরও বেশি ভয়াবহ রকমের দুর্ধর্ষ ও দুর্দমনীয়, এবং তা চলমান খুনাখুনির ভূত-ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণের ঝুঁকি বাড়াবে নাকি কমাবে, নাকি স্বাভাবিককরণের প্রক্রিয়ায় পরিণত  হবে, তা সময় বলে দেবে।

শিল্পপতি এবং রাজনীতিবিদ আলমগীর চৌধুরীর বখে যাওয়া পুত্র আফনান চৌধুরীরা সমাজে কারা– তা যেমন সচেতন দর্শক মাত্রই জানেন এবং বুঝেন, ওসি হারুন কারা, তা কতটা স্পষ্ট এখানে? ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনের মাঝে এখানে যুদ্ধটা হচ্ছে না, হচ্ছে দুই ক্ষমতাবানের মাঝে, একজন রাজনৈতিক- অর্থনৈতিকভাবে, আরেকজন প্রশাসনিকভাবে। এখানে দুই চরিত্রই দানব, প্রথম পক্ষ হচ্ছে ধনী ও অসৎ। তারা কেবল মানুষ ও রাজনীতি নিয়ে খেলেন তা নয়, আছে অভিজাত্যের অহংকার, থাকেন সমাজের উঁচুতলায়, যেখানে মুনিয়াদের মতো মেয়েরা কিংবা চিত্রনায়িকারা অসহায়, কেবল ভোগের বস্তু। অন্যপক্ষ, প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাবান, বিচক্ষণ, চালাক এবং দূরদর্শী। তবে এই পক্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাকে জানান দিতে চাইলেন না পরিচালক। সিরিজটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে তৈরি, যা কখনও ওসি হারুনের বর্ণনায়, কখনো বা সিআইডির তদন্তের মাঝে যে বয়ান তার মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

এখানে ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের ‘নিবিড় বর্ণনা’ (thick description)-কে পদ্ধতিগত কার্যকারিতার বিশ্লেষণের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি। এই বর্ণনায় নাগরিক জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে মনে হলেও ঠিক কতটা উঠে এসেছে, পরিচালক কেন ঠিক শেষ পর্যন্ত ‘নিবিড় বর্ণনায়’ থেকেও থাকলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারি। যেমন, ওসি হারুনের কখনও কোনও ব্যক্তিগত জীবন দেখানো হয় না, কেন? ব্যক্তি হারুন যখন বুঝিয়ে বলেন, আমাদেরও ফ্যামিলি আছে, সেই ফ্যামিলির চিত্র হাজির হয়নি একেবারেই। সেখানে ঠিক গল্পের ‘নিবিড় বন্ধন’টিকে কিছুটা হলেও দর্শক মিস করে। নাকি পরিচালক ভাবছেন ওসি হারুনের পরিবার, ক্রাইসিস এসব দৃশ্যায়িত হলে বাংলা চলচ্চিত্রের সেই গতানুগতিক পুলিশ পরিবারের ইমেজকেই পুনরুৎপাদন করা হবে? অনেক সময় মনে হয়েছে, ‘ভিজ্যুয়াল স্টোরি টেলিং’-এর ক্ষেত্রে কি পরিচালক আরেকটু মনোযোগী হলে মন্দ হতো না। ওসি হারুনের চরিত্রটিকে ঠিক জেমস বন্ডের মতো ফেরারি বলা যাবে না, যিনি নিজেই একপ্রকার দানব হয়ে লড়তেন অশুভ শক্তির সঙ্গে। বরং ওসি হারুন খুবই সাধারণ, নিছক একজন সরকারি কর্মচারীর মতো দানবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অপ্রস্তুত। যদিও শেষদিকে পরিচালক দুই পক্ষকেই দানব দেখান, একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে প্রতীকী সম্পর্কে আবদ্ধ থাকার কারণেই তারা আবির্ভূত হন জনমানসের কল্পনায়, কিন্তু ওসি হারুনকে গুলি করার মধ্য দিয়ে একপক্ষকে ক্ষমতা ও নিষ্ঠুরতার দিক থেকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছেন। দেখার অপেক্ষায় থাকলাম, মাত্রাটা কোন পর্যায়ে পৌঁছে।

পরিচালক রাষ্ট্রের সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি আলোচিত ঘটনাকে একত্রে জড়ো করেছেন, যা উদ্বেলিত নাগরিক মাত্রই জানতে চায়, বুঝতে চায়। আবার একটি থানায় ঘটে চলা বিভিন্ন নিয়ম-অনিয়মের চালচিত্র ওঠে আসে এখানে, যার সঙ্গে অনেকেই অনেকভাবে পরিচিত। একদিকে যেমন দেখানো হয় কীভাবে পুলিশ আসামির কাছে বিক্রি হয়, কীভাবে সোর্স কাজ করে, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল, কিংবা ডিবি পুলিশের কার্যক্রম, সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি, অন্যদিকে দেখানো হয় সাধারণ মানুষের চোখে কিংবা সাংবাদিকের চোখে পুলিশ কি বা কেমন।

আমাদের প্রিয় মেট্রোপলিটনের পলিটিক্স যে ক্রমশ নেক্রোপলিটিক্সে পরিণত হতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে কারও কোনও সন্দেহ থাকার কথা না। রাষ্ট্রের মাঝে ঘটে যাওয়া নানা গুপ্ত ও প্রকাশ্য ঘটনার বিশ্লেষণ করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক প্রবৃত্তিকে ব্যবহার করছে একদল ক্ষমতালোভী দালাল, যারা রাজনীতিকে মতাদর্শের মাপকাঠিতে নয়, টাকা বানানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে শহরটিকে প্রায় ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে, তাদের পরিচয় ও কার্যক্রম উঠে আসুক এভাবেই, তা-ই চাই। ঢাকা শহরকেন্দ্রিক শাসন-প্রণালির অঙ্গীভূত চর্চা হিসেবে ঘটে যাওয়া নানা ঘটন-অঘটন বুঝতে হলে, রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র ও প্রান্ততে যে এই ধর্ষণ-খুন-ঘুষ-দুর্নীতির দুষ্টচক্র আছে, তার প্রবৃত্তির কাজকারবার ব্যাখ্যা করতে গেলে, এই ধরনের নির্মাণ আরও আসা প্রয়োজন। তবে ওসি হারুনের মিথ্যা মামলায় আটক মামুনকে উদ্দেশ্য করে ডায়ালগ দিয়েছিল সেসব বয়ান আরও আসা জরুরি, যেমন– যাদের কথায় বোমা মারলি, তারা তো নাই তোর পাশে, আছে তোর বোন, বসে আছে সারা দিন তোর জন্য। এই ধরনের জরুরি সংলাপগুলো থেকে একদল মগজহীন বিপথে যাওয়া তরুণদের মনোজগতে পরিবর্তন আসলেও আসতে পারে, যারা প্রতিনিয়ত বলির পাঁঠা হয়।

শেষ করি দুটি কথা বলে:

এক– সমাজের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, ধর্ষণ, খুন, দুর্নীতি প্রশ্নে জনমানসে বিরাজমান যে দ্বিধা, সমর্থন, ঘৃণা, প্রতিবাদ, সম্মতি কিংবা স্ববিরোধ, তার মূলে আছে আপাত অর্থে দেখতে সরল কিন্তু আসলে জটিল এক নেক্রপলিটিক্সের সম্মোহনী সুর, যেখানে ভূমি দখল, ধর্ষণ, ক্ষমতার রেষারেষি, এমনকি খুনাখুনিও ‘স্বাভাবিক’ শাসন দশা হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে।

দুই– ওটিটি প্ল্যাটফর্মের হাইপার রিয়াল সময়ে সত্য, আংশিক সত্য, মিথ্যা আর ফিকশনের মাল্টিলিনিয়াল জগতে আটকা পড়া বিহ্বল আমাদের নাগরিক মন, সেখানে মিথ্যাকে মিথ্যা আর সত্যকে সত্য ভাবার মতো সরল চিন্তায় থাকা বিচ্ছিন্ন নাগরিক মনকে নিয়ে খেলার খায়েশ এমপি রজব আলী কিংবা ওসি হারুনের যেমন আছে, সেই খেলার বয়ান নির্মাণের ক্ষমতা কিন্তু কোনও অংশে কম নেই পরিচালক আশফাক নিপুনের মতো পরিচালকদের, কেবল দরকার সাহস ও উৎসাহের। আর আমাদের নাগরিক মন এই ধরনের কিছু সিরিজ দেখে ‘ক্ষমতা’র খেলা সম্পর্কে বুঝবে, কাঠামোকে ভাঙার চিন্তা করবে, ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে– যা মিশেল ফুকোর নানা লেখায় উঠে এসেছে বারবার, সেই প্রত্যাশায় রইলাম।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ