X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বজনের কাছে ফেরার দিন

মো. জাকির হোসেন
১৭ মে ২০২৩, ১৬:৪৩আপডেট : ১৭ মে ২০২৩, ১৬:৪৩

১৯৮১ সালের ১৭ মে ৬ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বদেশের মাটিতে স্বজনের কাছে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এজন্য বলছি যে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখনও দেশে-বিদেশে তৎপর।  পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া আর বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায় ছিলেন। ব্রাসেলসের সময়ে তখন ভোর সাড়ে ছয়টা। সানাউল হকের টেলিফোন বেজে উঠলো।

অন্য প্রান্তে ছিলেন জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী। তিনি যখন সানাউল হককে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর জানালেন, তখনই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা এবং জামাতাকে কোনও সাহায্য করতে অস্বীকার করলেন সানাউল। উপরন্তু, নিজের ঘর থেকেও তাদের চলে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যাদের জার্মানি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি দিতেও অস্বীকার করেছিলেন সানাউল।

বঙ্গবন্ধুর কন্যারা জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসভবনে আশ্রয় নেন। এরই মাঝে ইউরোপের সংবাদমাধ্যম খবর রটালো, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বনে রাষ্ট্রদূতের বাসায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের যে বন্দি করা হয়নি, সে জন্য সাংবাদিকদের সামনে এসে দাঁড়াতে হয়েছে দুই বোনকে। পশ্চিম জার্মানি থেকে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও জামাতা ভারতের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে ভারত সরকার তা অনুমোদন করেন। জার্মানির ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান ২৪ আগস্ট। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ২৫ আগস্ট সকালে দিল্লি পৌঁছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া ও তাদের দুই সন্তান। পালাম বিমানবন্দরে নামার পর তাদের প্রথমে ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউজ’-এ রাখা হয়। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়–

এক. বাড়ির বাইরে না যাওয়া, দুই. সেখানে কারও কাছে তাদের পরিচয় না দেওয়া এবং তিন. দিল্লিতে কারও সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা।

এরপর ওই বাসা থেকে তাদের ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কের সি ব্লকের একটি ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যাদের ওপর কড়া নির্দেশ ছিল, তারা যেন ঘরের বাইরে না যান এবং কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করেন। দিল্লি থাকাকালীন তাদের নামও পরিবর্তন করতে হয়েছে। মিস্টার তালুকদার, মিসেস তালুকদার, মিস তালুকদার নামে পরিচিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের নিরাপত্তার জন্য দুজনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সত্য ঘোষ নামের এক ইন্সপেক্টর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। অন্যজন ছিলেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস অফিসার পি কে সেন। এই দুজন অফিসারই ছায়ার মতো শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকতেন। শেখ রেহানার ওই বছরই দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলির জন্য তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে তাঁর ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিল। চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ হাসিনা যে দিল্লিতে আছেন, সেই খবরটা যাতে কেউ না জানতে পারে।

তবে বাংলাদেশের সরকার তাঁর অবস্থান জেনে গিয়েছিল। ১৯৮০ সালেই আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে দিল্লিতে এসেছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন তাকে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য। পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ আর কোরবান আলীর সঙ্গে ঢাকা রওনা হন। ৪২ বছর আগে ১৯৮১ সালের ১৭ মে, দিনটি ছিল রবিবার।

সেদিন ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছিল। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। শেখ হাসিনার আগমন ঠেকাতে তৎকালীন জিয়া সরকারের মদতে শেখ হাসিনা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বৈরী আবহাওয়া ও সরকার সৃষ্ট প্রতিরোধ কমিটি মানুষের উপস্থিতি ঠেকাতে পারেনি। জাতির পিতার কন্যাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ঢাকা বিমানবন্দরে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ তাঁকে স্বাগত জানাতে সেদিন হাজির হয়েছিলেন।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক সংবাদ ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাজধানী ঢাকা গতকাল (১৭ মে) মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। স্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে।’

সংবাদ আরও লেখে, বিকেল সাড়ে ৪টায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায়, তখন সব নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বিমানটি অবতরণ করে। জনতা একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায়। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেওয়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এ সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী স্লোগান: ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম মুজিব হত্যার বদলা নেবো।’ এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। যখন তাঁকে মালা পরিয়ে দেওয়া হয়, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন। জনসমুদ্রে সব অর্গল খুলে গিয়েছিল। শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে ছুটে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই রাষ্ট্রটি একটি বর্বর, অরাজক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করতে অধ্যাদেশ জারি করা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, খুনিদের বিরুদ্ধে কোনও আদালতে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। জিয়া আরেক ধাপ এগিয়ে সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী এই বর্বর আইনকে সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জাতীয় চার নেতা যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন, তাদের জেলখানার অভ্যন্তরে কারাবন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না, মামলা ছিল না, বিচারের রায় ছিল না। সম্পূর্ণ নিরপরাধ, নিরস্ত্র চার জন পরীক্ষিত নেতা, জাতির গভীর সংকটে যারা সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের হত্যা করা হলো। সংবিধানকে পায়ে দলে একে পর এক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে শুরু করলো মোশতাক, বিচারপতি সায়েম, জিয়া, বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করা জিয়া নিজের পদ দখলকে বৈধতা দিতে হ্যাঁ, না ভোটের আয়োজন করে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেছিলেন। হ্যাঁ, না ভোটে রাষ্ট্রপতি হওয়ার কোনও বিধান কখনোই সংবিধানে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে জড়িত ছিল তাদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দালাল আইনে বিচার শুরু করেছিলেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই বিচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। দালাল আইন বাতিল করা হয়। বিচারে দণ্ডিতদের বিচারিক কিংবা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ ব্যতিরেকেই মুক্তি দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীতে ক্যু, পাল্টা ক্যুর অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারসহ শত শত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যকে বিনা বিচারে কিংবা প্রহসনের বিচারে হত্যা করা হয়। এমন একটি ভয়ানক অরাজক পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল দেশের মানুষ। কিন্তু সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে মানুষ সঠিক দিশা খুঁজে পাচ্ছিলো না। সাহসী পিতার সাহসী কন্যাকে পেয়ে মুক্তিপাগল মানুষ তাই বাঁধভাঙা আবেগে আপ্লুত হয়েছিল। সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পিতার মতো কন্যার সাহস সঞ্চারিত হয়েছিল সাধারণ মানুষের মাঝে। পশ্চিমবঙ্গের সিনিয়র সাংবাদিক মানস ঘোষ যিনি ওই দিনের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন, তিনি সম্প্রতি একটি আলোচনায় বলেছেন, রিকশাচালকরা বলছিল, ‘শেখের বেটি আইতাছে, এইবার একটা কিছু অইবো’।

শিরোনাম দেখে কারও মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, পিতা বঙ্গবন্ধু, মাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, ভ্রাতৃবধূ, চাচাসহ পরিবারের সব সদস্যকে যিনি হারিয়েছেনে তিনি কীভাবে স্বজনের কাছে ফেরত আসবেন? এই প্রশ্নের উত্তর ৪২ বছর আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেই দিয়েছেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা লাখো জনতার সংবর্ধনার জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি সবকিছু হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার বিচার করতে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এই জীবন দান করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’

৪২ বছর আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা যে কথা দিয়েছিলেন, সেই অঙ্গীকার পূরণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকিকে আলিঙ্গন করে জনগণের ভাগ্যবদলে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ১৪ বছরে দেশের উন্নয়ন আকাশ ছুঁয়েছে। শেখ হাসিনা এক সাহসী রাজনীতিকের নাম; যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় বাংলাদেশ বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। ধৈর্য ও সাহসের প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশ।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্রবন্দর, ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণের প্রকল্প গ্রহণ এ কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, শেখ হাসিনা প্রকৃতপক্ষে আলাদা, ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মূল কারণ।’ জাতির বিভিন্ন সংকটকালে সাহসী, দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। জাতির সংকটে সবাই যখন উত্তরণের কোনও সম্ভাবনা দেখেন না, তখনও তিনি একটা না একটা উপায় বের করে ফেলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার সিনেটে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কিংবা অস্ট্রেলিয়ার সংসদে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অর্জনের প্রশংসা করে যখন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এক সমীহের নাম। আর এই রূপকথার রূপান্তর ঘটেছে শেখ হাসিনার হাত ধরে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষাবিদ রিচার্ড ও’ব্রেইন ‘নারী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী’ শীর্ষক গ্রন্থে অন্য ছয় জন বিশ্বনেতার সঙ্গে শেখ হাসিনার অবদান উল্লেখ করেছেন। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠতা ও কঠোর পরিশ্রমী এবং বাংলাদেশের তিনবারের (সে-সময় তিনবার) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার অর্জন লিপিবদ্ধ করে ও’ব্রেইন লিখেছেন, বাংলাদেশকে অধিকতর স্থিতিশীল ও অধিকতর গণতান্ত্রিক এবং অপেক্ষাকৃত কম হিংসাত্মক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তাঁর অনবদ্য নেতৃত্বের জন্য ৪০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন যে পুরস্কার পেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যাও সেই পুরস্কার পেয়েছেন। শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ৪১ বছরের বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি, শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান সমুদ্রসীমা জয় বাংলাদেশের ভৌগোলিক ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। স্বপ্নচারী শেখ হাসিনা উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ ঘোষণা করেছেন। তৃতীয় কোনও পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া কয়েক দশক ধরে চলা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহ অবসানে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জঙ্গিবাদের উল্লম্ফন উত্থান হয়েছিল।

৬৩ জেলায় জঙ্গিরা একযোগে বোমা হামলা করেছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জঙ্গি ও রাষ্ট্রযন্ত্র মিলে আওয়ামী লীগের জনসভায় সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত গ্রেনেড দিয়ে হামলা করা হয়েছিল। ওই সময় জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলাও শুরু করে। অন্ততপক্ষে ১০টি আত্মঘাতী হামলা চালানো হয় তিন মাসের ব্যবধানে। এতে বিচারক, পুলিশ, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক কর্মী, পথচারীসহ ৩০ জন নিহত এবং কয়েকশ’ আহত হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ অনুকরণীয়। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে গবেষণা করা অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়েও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। একটি দেশের প্রতি বছর সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনা, জিম্মি ও হতাহতের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে এই সূচক তৈরি করা হয়। তাদের সূচক অনুযায়ী, আফগানিস্তান হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের এক নম্বর দেশ। পাকিস্তানের অবস্থান ৬, ভারতের অবস্থান ১৩, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৩০, যুক্তরাজ্যের অবস্থান ৪২ আর বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩।

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের এই দীর্ঘ পথ পুষ্প বিছানো ছিল না। পদে পদে বিপদ এবং মৃত্যুর ঝুঁকি তাকে তাড়া করেছে। ২১ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করে পিলখানা ট্র্যাজেডির মতো নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। অন্য দেশের ক্ষমতাসীনদের যখন বিরোধী রাজনৈতিক দলের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে হয়, তখন শেখ হাসিনাকে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিপক্ষ শত্রুর মতো একটি প্রবল বিরোধী শক্তিকে প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ এই নীতিতে বলীয়ান হয়ে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারবহির্ভূত এই শত্রুপক্ষ হেন কোনও হীন কাজ নেই যা তারা করছে না। বিদেশি শক্তি ব্যবহার করে সরকার উৎখাত করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী গোপন চিঠি পাঠাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর কাছে লবিং করছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে, যাতে সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে ভাড়াটিয়া ওয়াগনার বাহিনীর মতো সাইবার বাহিনী নিয়োগ করেছে দেশে দেশে। এদের কেউ কেউ মিডিয়া ক্যু করতে সরকারবিরোধী ফিকশন থ্রিলার সিরিজ তৈরি করে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রচারও করছে। সাইবার দুর্বৃত্তদের একটি দল জাতির পিতা ও তাঁর কন্যা সরকার প্রধানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ছবি অশ্লীলভাবে এডিট করে এমন অসভ্য কল্পকাহিনি তৈরি করছে, যা দেখলে কোনও সভ্য মানুষের বিবমিষা পাবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে এই দীর্ঘ সময় দলের প্রধানের দায়িত্বে থেকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নানা চড়াই-উতরাই ও অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন।

শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের ফলেই আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থেকে চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করে জাতিকে বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার সব অর্জনকে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা কখনোই সম্ভব নয়। কেবল নির্বাচিত কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

১৯৮১ সালের আগে-পরে বহুবার ১৭ মে এসেছে, আসবে। কিন্তু ৪২ বছর আগের ১৭ মে জাতির ইতিহাসে এক অনন্য দিন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি যুগান্তকারী ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাঙালি জাতির নির্মোহ ইতিহাসে ১৭ মে অমরত্ব লাভ করবে, অনন্তকাল ধরে প্রেরণা জোগাবে।

এই কলাম যখন লিখছি তখন সুখবর পেলাম শেখ হাসিনার অর্জনে যোগ হলো আরও একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। শেখ হাসিনার ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ সর্বসম্মতভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সফল এই উদ্ভাবনী উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়ে একে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে
প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে
সুঁই-সুতোয় ‘স্বপ্ন বুনছেন’ ভোলার আমেনা খানম
সুঁই-সুতোয় ‘স্বপ্ন বুনছেন’ ভোলার আমেনা খানম
ভিজিএফের চাল না পাওয়া উপকারভোগীদের মানববন্ধনে হামলা
ভিজিএফের চাল না পাওয়া উপকারভোগীদের মানববন্ধনে হামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ