X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিনির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা অস্ত্র

মো. জাকির হোসেন
৩০ মে ২০২৩, ১৭:৫২আপডেট : ৩০ মে ২০২৩, ১৭:৫৩

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে অতি উৎসাহী। বলতে গেলে বাইডেন প্রশাসনের ঘুম হারাম। যদিও আন্তর্জাতিক আইন অন্য রাষ্ট্রের ব্যাপারে নাক গলাতে অনুমতি দেয় না। বরং, এটিকে হস্তক্ষেপ হিসাবে গণ্য করে। তবু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে গণতন্ত্র নির্মাণের ঠিকাদারি নিয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে শুরু করে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক অবরোধ, নির্বাচনে অনিয়মের কারণে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ নানা কলাকৌশল অবলম্বন করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই অতি আগ্রহ নিয়ে বরাবরই নানা সন্দেহ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় না। বরং, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে ‘কইয়ের তেলে কই ভাজা’ এবং ‘কিছু তেল নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া’।

যাহোক, যুক্তরাষ্ট্র সমসাময়িক বিশ্বে গণতন্ত্র নির্মাণে ৮০টিরও বেশি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, কিন্তু কোনোটিতেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন প্রমাণ নেই। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স, ২০২৩-এর পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অবনমন হয়েছে। বিশ্বের প্রায় আট বিলিয়ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বাস করে। তারা গণতান্ত্রিক নীতি ও পরিবেশের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করছে তা পরিমাপ করতে প্রতিবছর ইআইইউ প্রতিবেদন ও র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। পাঁচটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা পর্যালোচনা করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এই ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স তৈরি করে থাকে। মানদণ্ডগুলো হলো– নির্বাচনি প্রক্রিয়া এবং বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক স্বাধীনতা।

সম্প্রতি প্রকাশিত ইআইইউ ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ৬.৪ শতাংশ পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করছে। আর বিশ্বব্যাপী এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট। বাকিরা ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ কিংবা হাইব্রিড শাসনের অধীন। প্রতিবেদন আরও বলছে, জনসংখ্যার মাত্র ৪৬ শতাংশ ‘কোনও ধরনের’  গণতন্ত্রে বাস করে। তার মানে, ৫৪ শতাংশ জনগণ অগণতান্ত্রিক শাসনের অধীন রয়েছে।

ল্যারি ডায়মন্ড তার বই ‘ডেমোক্র্যাসি ইন ডিক্লাইন?’ গ্রন্থে লিখেছেন, বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ গণতন্ত্র গত ৩০ বছরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে বা পতিত হয়েছে।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এই পরিসংখ্যান ও ল্যারি ডায়মন্ডের গবেষণা স্পষ্টতই এই বার্তা দিচ্ছে যে গণতন্ত্র নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের ঠিকাদারি নিম্নমানের। ঠিকাদারির এই নিম্নমান নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন ভিসানীতি সংশোধন করেছে। সংশোধিত নীতিতে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করলে সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। এ ভিসানীতি যেকোনও বাংলাদেশির ওপর কার্যকর হবে। বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে ভিসানীতিতে। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা দেখা যায় যেখানে গণতন্ত্র বা নির্বাচন বলতে কিছুই নেই এবং সেসব দেশের মানবাধিকার নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন আছে। অথচ ওই দেশগুলোকে ফেলে ওয়াশিংটন হঠাৎ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি দুটি উদাহরণ উল্লেখ করছি–

এক. ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তের সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র অভিযান শুরু করেছিল তাতে ব্যাপক বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হয়। ফিলিপাইন ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির অফিসিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী, জুলাই ২০১৬ থেকে নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৫০। আর মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো হত্যার সংখ্যা ২০ হাজার বলে উল্লেখ করেছে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান ছাড়াও দুতার্তে তার দেশের সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের হত্যার মাধ্যমে ‘শেষ করে ফেলার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লক্ষ্যে আয়োজিত এক সরকারি সভায় প্রকাশ্যে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন দুতার্তে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে বলেছি, যদি কখনও কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয় তবে তাদের হত্যা করো। এরপর নিশ্চিত হও যাকে গুলি করা হয়েছে তার মৃত্যু হয়েছে কিনা। যদি মৃত্যু না হয়ে থাকে তবে সেখানেই তাকে হত্যা করো। তবে মরদেহগুলো যেন পরিবারের কাছে পৌঁছানো হয় সেটা নিশ্চিত করতে বলেছেন দুতার্তে। মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি বলেন, মানবাধিকারের তোয়াক্কা করতে হবে না। এটা আমার নির্দেশ। আমি জেলে যেতেও রাজি আছি। এটা কোনও সমস্যা নয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনে দুতার্তেকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দুই. আগামী জুলাই মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হান সেন। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি কম্বোডিয়ার ক্ষমতায়। দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা কেম সোখাকে মাস দুয়েক আগে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। তিনি যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সে জন্যই এই রায় দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এর আগে ২০১৭ সালে তার দল কম্বোডিয়ান ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি (সিএনআরপি)-কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এরপর এ বছরের ১৫ মে কম্বোডিয়ার নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ সঠিক কাগজপত্র না থাকার অজুহাতে দেশের বর্তমান বৃহত্তম বিরোধী দল ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ২৬ মে এক বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে কম্বোডিয়ান কর্তৃপক্ষ দেশটির বৃহত্তম বিরোধী দল– ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধা দিচ্ছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিরোধী দল, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে লক্ষ্য করে কল্পিত আইনি পদক্ষেপ, হুমকি, হয়রানি এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফৌজদারি অভিযোগগুলো বহুদলীয় গণতন্ত্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারকে দুর্বল করছে। এমন এক নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে কম্বোডিয়ান এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা অবাধ বা সুষ্ঠু বলে মূল্যায়ন করছেন না। এই পরিস্থিতিতে দেশটির বিরোধী দল, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে লক্ষ্য করে আইনি পদক্ষেপ, হুমকি, হয়রানি এবং মামলার বিষয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে কোনও নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে কেবল নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

২০২৩ সালে প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে ১০-এর মধ্যে ২.৯ স্কোর নিয়ে কম্বোডিয়ার অবস্থান ১৩০তম। আর লিবারেল ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে ০.০৭ স্কোর নিয়ে কম্বোডিয়ার অবস্থান ১৬০তম। অন্যদিকে, ৬.০০ স্কোর নিয়ে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। তার মানে, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে বাংলাদেশ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দ্বারপ্রান্তে। আর মাত্র ০.০১ স্কোর করলেই ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের কাতারে শামিল হবে বাংলাদেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশও রয়েছে। এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক দেশের হাইব্রিড শাসনের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বাইরে বাংলাদেশের রয়েছে সর্বোচ্চ আঞ্চলিক গড়।

লিবারেল ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে ০.১২ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২তম, যেখানে কম্বোডিয়া ১৬০তম। কম্বোডিয়া গণতন্ত্র ও নির্বাচনে বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও আসন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোনও ভিসানীতি ঘোষণা করেনি। উদ্বেগ প্রকাশ আর পর্যবেক্ষক না পাঠানোর মধ্যে সীমিত থেকেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের নির্বাচন এখনও ৮ মাস বাকি থাকতেই ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি জারি করেছে। বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতলববাজি এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এ নিষেধাজ্ঞা কি দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে, নাকি ভূ-রাজনৈতিক কোনও অভিপ্রায় ও কৌশলগত বিষয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বিশ্বের যেসব দেশে (নাইজেরিয়া ও সোমালিয়া) প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে কোনও সাফল্য এসেছে কিনা রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তবে তিনি সেটা বলতে পারেননি।’

নতুন ভিসানীতি কোথাও পরীক্ষিত হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত হাস বলেছেন, ‘আসলে পরীক্ষিত হয়নি।’ এটি কোথায়ও সফল হয়েছে কিনা রাষ্ট্রদূত তাও বলতে পারেননি। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, এ ভিসানীতি জনগণের ভোটাধিকার কতটা সুনিশ্চিত করবে। দেশে-বিদেশে বিশ্লেষকদের অভিমত, যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মতো যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ- গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকার নয়। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আসলে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব-বলয়ের বাইরে রাখতে চায়। বাংলাদেশ অনেক বছর আগেই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছে। মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য। নোয়াম চমস্কির মতে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ ও কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্পৃক্ত। যেখানে উদ্দেশ্যের অসততা রয়েছে সেখানে ভিসানীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রকল্পে সফল হবে তা কতটুকু বাস্তবসম্মত?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ন প্রচেষ্টা সফল হয়নি, তার মধ্যে অন্যতম হলো –

এক. Bruce Bueno de Mesquita তার ‘Why Gun-Barrel Democracy Doesn't Work’ প্রবন্ধে এবং James Meernik তার ‘United States Military Intervention and the Promotion of Democracy’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশে সামরিক হস্তক্ষেপকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করতে গণতন্ত্রকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছে। অনেক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করেছে।’ Mark Peceny তার “Democracy at the Point of Bayonets” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের পরে সৃষ্ট গণতন্ত্র এখনও গণতন্ত্রের চেয়ে স্বৈরাচারের কাছাকাছি’। Samia Amin Pei তার “Why Nation-Building Fails in Mid-Course” প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মার্কিন হস্তক্ষেপ সত্যিকারের গণতন্ত্র তৈরি করে না, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দশ বছর পরে বৃহত্তর কর্তৃত্ববাদে পরিণত হয়।’ Professor Abraham Lowenthal তার ‘The United States and Latin American Democracy: Learning from History’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা প্রায়শই বিপরীত ফল বয়ে এনেছে’।

দুই. অন্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের বোঝাপড়া ও কৌশলে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্র রফতানির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯১২ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত হস্তক্ষেপে করেছে। Professor Paul W. Drake এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্রকে উন্নীত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ হিসাবে সুস্পষ্টভাবে  Drake বলেছেন, ‘গণতন্ত্রকে অভ্যন্তরীণ অবস্থা থেকে বিকাশ করতে হবে এবং জোর করে চাপিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না’। ড্রেক বলেন, আমেরিকান নেতারা কখনও কখনও গণতন্ত্রকে সংকীর্ণ অর্থে সংজ্ঞায়িত করে একে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমিত করে ফেলে।

প্রকৃতপক্ষে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বোঝাপড়ার পরিসর অনেক বিস্তৃত। এ কথা অনস্বীকার্য, মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের নামে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হস্তক্ষেপের পর রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। Alexander B. Downes এবং Jonathan Monten তাদের ‘ Forced to Be Free?: Why Foreign-Imposed Regime Change Rarely Leads to Democratization’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘স্বৈরাচারী সরকার ও তার দোসরদের উৎখাত করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় এমন ধারণা ভ্রমাত্মক।’ ‘Why Is America So Bad at Promoting Democracy in Other Countries?’ প্রবন্ধে Stephen M. Walt বলেছেন, বাইরের শক্তির মাধ্যমে কোনও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক উত্তরণে কোন দ্রুত, সহজ বা নির্ভরযোগ্য উপায় নেই। বিশেষ করে ওই দেশটিতে গভীর সামাজিক বিভাজন থাকলে উত্তরণের পথ ভয়ংকর দুর্গম।

তিন. ভিসা অস্ত্র প্রয়োগ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সফলতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই ভিসানীতি বাস্তবে সততার সঙ্গে প্রয়োগযোগ্য নয়। প্রায় ১২ কোটি ভোটারের জন্য ৪০ হাজারের অধিক ভোটকেন্দ্রে ২ লাখের অধিক ভোটকক্ষ রয়েছে। কে, কাকে, কোন ভোটকক্ষে ভোটদানে বাধা দিলো, কার হুকুমে বাধা দিলো এটা নিরপেক্ষভাবে মনিটর করবে কে? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, বেলারুশ, নিকারাগুয়া, সোমালিয়ায় মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা অস্ত্র গণতন্ত্রের জন্য কোনও সুফল বয়ে আনেনি। সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশে পর পর চারটি নির্বাচন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০ বছর ধরে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফল হলো গণতন্ত্রের অসুখ আরও গভীরতর হয়েছে। সেজন্যই তো গণতন্ত্রের অসুখ সারাতে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞার দাওয়াই নিয়ে এসেছে।

এই দাওয়াই দিয়ে গণতন্ত্রের অসুখ সেরে ওঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। Stephen M. Walt বলেন, সফল উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা লিখিত সংবিধান বা নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভর করে: কোনও রাষ্ট্রের কার্যকর আইনি ব্যবস্থা, বহুত্ববাদের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার, নাগরিকদের আয় ও শিক্ষার একটি ন্যূনতম পর্যায়, নির্বাচনে হেরে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যতে আরও ভালো করার প্রত্যয় ইত্যাদি। আর এসবের জন্য দরকার অনেক সামাজিক উপাদানকে সঠিকভাবে সক্রিয় করা। বাংলাদেশে তার গুরুতর অভাব রয়েছে।

বাংলাদেশে একটি বড় রাজনৈতিক গোষ্ঠী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মেনে জন্মগ্রহণ করেনি। সামরিক গর্ভে জন্মগ্রহণ করা এই রাজনৈতিক দল জন্মগত ত্রুটি থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি। তাই আচরণ পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক। এরা হ্যাঁ, না ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক মনে করে, সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকে ও হত্যার বিচার বন্ধে খুনিদের দায়মুক্তিকে সমর্থন করে, জাতির পিতার হত্যাকে উদ্ধৃত করে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে স্লোগান দেয় ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’, একটি রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করতে জঙ্গিদের সহায়তায় ও রাষ্ট্রীয় মদতে সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত গ্রেনেড দিয়ে রাজনৈতিক সমাবেশে আক্রমণ করে মানুষ হত্যা করার পথ বেছে নেয়, রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে, একটি পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্র, অসংখ্য স্কুল, সরকারি অফিস, একটি আস্ত ট্রেন আগুনে পুড়িয়ে দেয়, যে দলিলের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে সেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ও বাংলাদেশের সংবিধানকে অস্বীকার করে, জাতির পিতাকে অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে, সংবিধানকে ছুড়ে ফেলতে চায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে বিদেশে লবিং করে।

এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ যে দেশে বিদ্যমান, সেখানে ভিসা অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অলীক- বাস্তবসম্মত নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একটি বিশাল সামাজিক প্রকৌশল প্রকল্পও বটে। Stephen M. Walt-এর অভিমত হলো, একটি দেশের সমাজ ও রাজনীতিকে যথাযথ অনুধাবন না করে বাইরের শক্তির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার আশা সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে কোনও ব্লুপ্রিন্ট ছাড়াই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করার মতো। এরূপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্রুত পতন অবশ্যম্ভাবী।

ফলশ্রুতিতে, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা যথার্থই বলেছিলেন, “বিশ্বে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত সাফল্য এ জন্য আসবে না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটি নির্দেশ করে; বরং এটি আসবে, কারণ নাগরিকরা কীভাবে শাসিত হবে এটি তাদের দাবি।

কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলোতে শতাব্দীর পর শতাব্দী লেগেছে। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া কেবল বিতর্কিত ও বিরোধপূর্ণই ছিল না, অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকর সহিংসও ছিল। তাই বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিনির্মাণ যদি কাম্য হয়, তবে জবরদস্তি সঠিক হাতিয়ার নয়। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি নিজেই অগণতান্ত্রিক, মানবাধিকারবিরোধী ও আইনের সাধারণ নীতির পরিপন্থী। এই ভিসা নীতিতে একজনের অপরাধের জন্য নিরপরাধ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে। অথচ আইন ও মানবাধিকারের সর্বজনীন নীতি হচ্ছে একজনের অপরাধের দায় কোনোভাবেই অপরের ওপর আরোপ করা যাবে না।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাফাহ শহরে নতুন করে  ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
রাফাহ শহরে নতুন করে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ