X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশবিরোধী এ কেমন রাজনীতি

মো. জাকির হোসেন
২৪ জুন ২০২৩, ১৫:৫৭আপডেট : ২৪ জুন ২০২৩, ১৫:৫৭

বহু দশক ধরে টিকে থাকা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনের রং পাল্টাচ্ছে। রাশিয়া ও চীনের মৈত্রী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের একচেটিয়াতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বৈশ্বিক রাজনীতির এই টালমাটাল অবস্থা স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশকে মারাত্মক বেকায়দায় ফেলেছে। সেই সাথে ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর জন্য নজিরবিহীন সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জন্য এই সংকট অন্যদের চেয়ে বেশি ভয়াবহ। একদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাব। আর অন্যদিকে বাংলাদেশকে ভূ-রাজনীতির বলির পাঁঠা বানানোর বিরামহীন প্রয়াস। সবকিছুকে ছাপিয়ে ভয়ংকর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশবিরোধী অভ্যন্তরীণ ভয়ংকর নোংরা রাজনীতি। বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলায় কারো পক্ষ অবলম্বন না করে সাইডলাইনে বসে থেকে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোক্ষম অস্ত্র হলো বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরীতা নয়’। পুঁজি, অবকাঠামো, বিদেশি বিনিয়োগ ও জ্বালানি ক্ষুধার্ত বাংলাদেশ তাই সবার সঙ্গে বন্ধুতা বজায় রাখতে বৈশ্বিক রাজনীতির বাইরে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে আগ্রহী। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দলের গণবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি ভূ-রাজনীতির খোলোয়াড়দের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও বাংলাদেশের জন্য বিশেষ ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে। কয়েকজন কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশকে টার্গেট করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে পত্র দিয়েছে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ সদস্য। চিঠিতে নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কংগ্রেসম্যান ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য উভয়ের চিঠিতে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা, গুম ও মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। চিঠিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ধ্বংস, ধর্ষণ, বলপ্রয়োগে ধর্মান্তকরণ ও খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকজন আইনপ্রণেতাই নন তাদের সাথে যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এনজিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল লবিস্ট।

এরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য যেন না নেওয়া হয় তার তদবির ও প্রচারণা করছে। প্রশ্ন হলো, এই লবিস্ট কারা? কী স্বার্থে ও কার স্বার্থে তারা এমন দেশবিরোধী লবিং করছে? লবিং পশ্চিমা দেশে একটি আইনসম্মত ব্যবসা। লবিং মানে সোজা বাংলায় কারও পক্ষে দালালি বা তদবির করা। বিভিন্ন কোম্পানি, সংগঠন লবিস্ট হিসাবে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে তাদের পক্ষে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তদবির করে থাকে। সঠিক হোক বা না হোক, নৈতিক হোক বা অনৈতিক– তাতে এদের কিছু আসে যায় না। এরা শুধু দালাল হিসেবে তাদের মক্কেলের বক্তব্যকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে পৌঁছে দিয়ে সরকারকে কারও পক্ষে বা বিরুদ্ধে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।

এখন প্রশ্ন হলো, কারা বাংলাদেশের গর্ব সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর শান্তি মিশনে যাওয়া বন্ধ করতে চায়? দেশের অর্থনীতিতে আঘাত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ’র কাছে লবিং করছে? মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে কারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে? এটি জানা কোনও কঠিন কাজ নয়। বরং, কারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে, কী উদ্দেশ্যে করছে, কত অর্থের বিনিময়ে করছে, কোন তারিখে কত পেমেন্ট করা হয়েছে সব তথ্য জানা সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্রের Lobbying Disclosure Act এর বিধান অনুযায়ী লবিং সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য কংগ্রেসের নিকট প্রকাশ করতে বাধ্য।

অন্যদিকে Foreign Agents Registration Act এর শর্ত অনুযায়ী কোন বিদেশির পক্ষে লবিং করা হচ্ছে তা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের Department of Justice (DOJ)-এর নিকট প্রকাশ করতে হবে। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপি বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে লবিং করতে Akin Company Associates, Blue Star Strategies, Rasky Partners ও Akin Gump Strauss Hauer & Feld LLP নামে লবিস্ট ফার্মকে নিয়োগ করেছে। আর জামায়াত ইসলাম ‘Peace and justice’ লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে Blue Star Strategies-র সাথে বিএনপির পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা আব্দুস সাত্তার। লবিস্ট ফার্ম ব্লু স্টার স্ট্যাটেজিস-কে দুই বছরে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫৮২ ডলার পরিশোধের প্রমাণও পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরুপ, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ১০ হাজার ইউএস ডলার, সেপ্টেম্বর মাসে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৯৯০ ডলার এবং ২০১৯ সনের মার্চ- সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭০ হাজার ৭৯২ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে।

শেষ কিস্তি সিঙ্গাপুর ভিত্তিক Overseas-Chinese Banking Corporation (OCBC) এর মাধ্যমে পরিশোধের প্রমাণও মেলে। Blue Star Strategies বিএনপির পক্ষে লবিংয়ের কাজের সুবিধার্থে আরেক লবিস্ট ফার্ম Rasky Partners এর সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। এজন্য Rasky Partners-কে ৮৬ হাজার ৬২৭ ডলার পরিশোধের একটি তথ্য জানা যায়। বিএনপি ব্লু স্টার স্ট্র্যাটিজিস নামে যে লবিং ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান ও কো-ফাউন্ডার Karen Tramontano এর সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পুত্র Hunter Biden এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। হান্টার বাইডেন নিজেও একজন লবিং ফার্ম ব্যবসায়ী। বিএনপির নিয়োগকৃত লবিস্ট Akin Gump Strauss Hauer & Feld LLP বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী Toby Cadman-কে নিয়োগ করে বিএনপির পক্ষে লবিং করার জন্য। এই টবি ক্যাডম্যান ২০২১ সনে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ কর্তৃক র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে প্রধান ভূমিকা পালন করে। নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক সহকারী প্রেস সচিব মুশফিকুল ফজল আনসারী কয়েকজন সিনেটরের কাছে ক্রমাগত তদবির করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে, ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর ১০ জন সিনেটর Secretary of State Mike Pompeo and Secretary of Treasury Steven Mnuchin বরাবর চিঠি লেখে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য।

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের Foreign, Commonwealth and Development Office এর নিকট ২০২১ সনের আগস্ট মাসে টবি ক্যাডম্যান প্রতিষ্ঠিত Guernica 37 Chambers Law Offices ১৫ জন র‌্যাব কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বক্তব্য উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ভিসা নীতি, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, পশ্চিমা কূটনীতিকদের শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তি মিশনে যাওয়া বন্ধ করার অপপ্রচার সবই এই লবিংয়ের ফসল। যেসব কারণে আমি এটি লবিংয়ের ফসল বলছি, তার মধ্যে অন্যতম হলো –

এক. পাকিস্তানে গণগ্রেফতার, গুম ও নির্যাতন রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হলেও সে দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র ও সামরিক আইন পরিস্থিতির বিষয়ে নীরব মার্কিন প্রশাসন। ভিয়েতনামে একদলীয় অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলমান থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ক্রমাগত বাড়াচ্ছে।

ইসরায়েলের মানবাধিকার রেকর্ড ভয়ংকর খারাপ এবং নেতানিয়াহুর অধীনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে থাকা সত্ত্বেও এটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্র।

দুই. ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অচেনা-অপরিচিত হলেও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ সদস্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছেন যা বিএনপির দাবি। পশ্চিমারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা কখনই বলেনি।

তিন. গত ১৪ জুন নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারকে বাংলাদেশ নিয়ে বাইডেনের কাছে ৬ কংগ্রেসম্যানের চিঠি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি চিঠির বিষয়ে অবগত নই।’ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র কংগ্রেসম্যানের চিঠি সম্পর্কে জানার আগেই বিএনপির কিছু নেতা-নেতৃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা আপলোড করে দিয়েছেন। তার মানে লবিস্ট ফার্ম তাদের সাফল্য প্রচার করতে চিঠির অগ্রিম কপি বিএনপিকে সরবরাহ করেছে।

চার. কংগ্রেসম্যানরা যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং তাদের যে ভাষা তা কূটনৈতিক শিষ্টাচারসুলভ নয়। চিঠিতে এমন কিছু শব্দ ও বাক্য আছে, যা অন্য দেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না।

পাঁচ.  যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এজেন্ডা ভুলে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তি মিশনে যাওয়া বন্ধ করতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে শান্তি মিশনে বাংলাদেশ কীভাবে সবার ওপরে থাকে।

অন্য দিকে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমেছে। তাহলে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও শান্তিরক্ষী মিশনের প্রধান Jean Pierre Lacroix এর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় মানবাধিকার ইস্যু উত্থাপনের বিষয়ে এইচআরডব্লিউ কেন প্রচারণা চালাচ্ছে?

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তি মিশন ব্যাহত করতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিকল্পিত প্রচারের সাথে শান্তিমিশনবিরোধী বিএনপির টুইট মিলে যায়। সমীকরণটি খুবই সহজ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও বিএনপির যোগসূত্র রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র‌্যাবের বিষয়ে নিজেদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে গিয়ে শান্তি মিশন নিয়ে পরিকল্পিত প্রচার কি বিনা লাভে করছে? উত্তর, অবশ্যই না।

বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হেন কোনও পদক্ষেপ নেই যা তারা গ্রহণ করেনি। তখন অভিযোগ উঠেছিলো বিশার অংকের অর্থের বিনিময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে পরিষ্কার অভিযোগ আছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।

১৯৭৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মাইরিদ মগুর এবং ১৯৮০ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অদেতালভো পেরেজ এসকুইভালসহ বহু মানবাধিকারকর্মী এই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকাণ্ড নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, এই প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।

ছয়. আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ধ্বংস, ধর্ষণ, বলপ্রয়োগে ধর্মান্তকরণ ও খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে চিঠির এই বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। কংগ্রেসম্যানের চিঠিকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। আর বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও বলেন, ‘এটি পুরোদস্তুর মিথ্যা কথা। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায় আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছি। বর্তমান সরকারের সময়ে ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত পরিচয় ভুলে গিয়ে যোগ্যতা ও মেধার সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে সবার সরকারি চাকরি করার অধিকার এবং পেশাগত সুবিধা লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।’

পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবে রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় ১৯টি বিহার ও কিছু বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলে গত ৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রামু পরিদর্শন করেন এবং পুড়ে যাওয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত সব বিহার ও ঘর-বাড়ি পুনর্নির্মাণ করার ঘোষণা দেন। প্রতিশ্রুতি মতো, ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সব বিহার ও বাড়ি-ঘর পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রকৃত সত্য হলো, বিএনপি-জামায়াত মিলে এদেশে নজিরবিহীন নৃশংসতা চালিয়েছে সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি সংখ্যালঘুদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন করেছে তা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, কানাডার Research Directorate, Immigration and Refugee Board, যুক্তরাষ্ট্রের Department of State’s Commission on International Religious Freedom (USCIRF) এর প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।

এছাড়া, BBC (October 10, 2001), Gulf News (February 12 2002), Press Trust of India (October 20, 2001), Pax Christi (26 Nov. 2001) এর প্রতিবেদনেও সংখ্যালঘু নির্যাতনে সুস্পষ্টভাবে বিএনপি-জামায়াতের নাম উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার প্রতিবেদনে বলেছে, “The wave of attacks against the Hindu community in Bangladesh began before the general elections of October 1 2001 when Hindus were reportedly threatened by members of the BNP-led alliance not to vote, since it was perceived their vote would be cast for the Awami League. The backlash after the elections was systematic and severe. Reports indicate that the worst affected areas have been in Barisal, Bhola, parts of Pirojpur, Khulna, Satkhira, Gopalganj, Bagerhat, Jessore, Commilla and Norsingdi. Attackers have reportedly entered Hindu homes, beaten members of the family, looted their property and in some cases, raped Hindu women. During this carnage, rape was used as a principal means of violence and intimidation. Human rights organizations in Bangladesh believe over 100 women may have been subjected to rape. Reports persistently allege that the perpetrators have been mainly members of the BNP or its coalition partner Jamaat-e-Islami. A number of Hindu girls were reportedly abducted.”

কানাডার প্রতিদেনে বলেছে, “…these incidents include rape, torture, murder and looting as well as setting fire to Hindu properties. Hundreds of Hindus have reportedly fled the violence, crossing the border into India. The Fair Election Monitoring Alliance (FEMA) reported that most of the violence was committed by BNP activists… The attacks against Hindus have occurred in numerous districts across Bangladesh”. আর যুক্তরাষ্টের USCIRF এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “Reports of BNP harassment of Hindus, who traditionally vote for the AL (Awami League), preceded and followed the 2001 election. Reported incidents included killings, rape, looting, and torture… Since the 2001 elections, religious minorities reportedly have continued to be targeted for attacks, which has led to the requirement for guards to be present at church and temple ceremonies. Reportedly, incidents include killings, rape, torture, attacks on places of worship, destruction of homes, forced evictions, and desecration of items of worship. These claims continued during the period covered by this report”.

কানাডার আদালত বিএনপির রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে এক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। অন্টারিও স্টেটের অটোয়ার ফেডারেল আদালত Gazi v. Canada (Citizenship and Immigration) (2017 FC 94) এর মামলায় Justice Brown বলেন, “The court took into account that BNP is a party that uses armed struggle or violence to reach political objectives, uses ‘ammunitions and arms’ like hand bombs, pistols, and big swords like in a war and also attacks the leading government’s people at the time of strike or precession.” It also noted that BNP “…uses sticks to hit people and shoot pistols at people and throw hand bombs. They burn the stores”.

বিচারপতি আরও বলেন, ‘The hartals [general strike] employed by the BNP have significant economic impact on Bangladesh’s economy and have resulted in both substantial damage to property and both death and serious bodily harm caused by BNP activists and members as well as disruptions in service. BNP’s continued reliance on hartals as a tool to coerce the government by creating significant economic disruption as well as the incidences of violence that resulted from the implementation of the hartals caused by BNP members are sufficient to find that the BNP constituted terrorist acts’.

রায়ের উপসংহারে আদালত স্পষ্ট করে বলেন, ‘that it is indeed reasonable to believe that the BNP was, is, or will be engaged in terrorism..’  Gazi v.

কানাডা মামলার কয়েক মাস পর বিএনপির আরেক আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন কানাডা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ খারিজ করলে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। ফেডারেল আদালতের বিচারপতি Justice Fothergill ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন এবং বিএনপির সহিংসতা, ভাংচুর ও দীর্ঘসময় ধরে দেশব্যাপী হরতালের উল্লেখ করে রায়ে বলেন, ‘BNP is a terror organization.’

সাত. কংগ্রেসম্যানরা চিঠিতে আরেকটি অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে বলেছেন, র‌্যাবের সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু “দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরপরও বাংলাদেশে দমন-পীড়ন কমেনি।” এটি পুরাদস্তুর মিথ্যা কেননা যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বলেছে, সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়,  বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমেছে।

গত ১৫ জানুয়ারি দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে র‌্যাবের অসাধারণ অগ্রগতির কথা স্বীকার করা হয়েছে। আমরাও এই অগ্রগতির বিষয়টি স্বীকার করি। এটি একটি অসাধারণ কাজ।

লবিং একটি বৈধ ও স্বীকৃত পন্থা। যে কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের লবিস্ট নিয়োগের অধিকার রয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থ আর জাতীয় স্বার্থ এক নয়। এই দেশ কোনও রাজনৈতিক দলের একার নয়, আমাদের সবার দেশ এটি। সেনাবাহিনী, পুলিশ বা র‌্যাবে শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থক বা তাদের নিকটজনরাই চাকরি করে না। এখানে নানা রাজনৈতিক দল, মত ও পথের পরিবারের মানুষেরা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে শান্তি মিশনে যাওয়া বন্ধ হলে, বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক কোনও নিষেধাজ্ঞা নেমে এলে রাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে তাতে কেবল আওয়ামী লীগ নয়, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোনও সন্দেহ নেই। দেশবিরোধী রাজনীতি থেকে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশি শক্তিকে ক্ষেপিয়ে তুলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করা থেকে তাই সবাইকে বিরত থাকতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ