X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’

মো. জাকির হোসেন
১৯ জুলাই ২০২৩, ০৯:০২আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৩, ০৯:০২

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ শিরোনামের কবিতাখানি গান হিসেবেই অধিক সমাদৃত। হৃদয়কে শিহরিত করে, শিরায় অনুরণন তোলে, অতল আবেগে আপ্লুত করে যে গান তারই একটি কলি আজকের লেখার শিরোনাম। গানটির প্রথম স্তবক– ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;/ সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/ সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’

সত্যিই সকল দেশের রানি আমাদের এ জন্মভূমি। সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা, রূপের মধু, সুরের জাদুভরা আমাদের এ দেশ। নদীর কলতান, পাখির কলকাকলি ও সবুজের সমারোহে পরিপূর্ণ আমাদের এ দেশ। পরিতাপের বিষয়, সকল দেশের রানি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র চলছে। সোনার বাংলার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি একশ্রেণির কুচক্রী মহল উঠেপড়ে লেগেছে।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে তারা অন্যের হাতে সোপর্দ করতে চায়। দেশের ক্ষমতার শক্তি বহির্বিশ্ব নির্ধারণ করলে এটি কী আর রাষ্ট্র থাকলো? বিদেশি শক্তি যদি ক্ষমতার পালাবদলে চরিত্র ঠিক করে দেয়, তাহলে জনসাধারণ আর সার্বভৌম রইলো কোথায়? লাখ লাখ শহীদ আর কন্যা-জায়া-জননীর সম্ভ্রমের চরম মূল্যে অর্জিত আমাদের প্রিয় ভূমি আজ অনানুষ্ঠানিক আগ্রাসনে বিপদাপন্ন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ ক্রমেই বাংলাদেশের সমান্তরাল সরকার হয়ে উঠছে। হিরো আলম বলেছে সে ই্‌উরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে অভিযোগ জানাবে। হিরো আলমের ওপর সহিংসতা অবশ্যই নিন্দনীয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ২ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে ও পরে আরও ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপরও জাতিসংঘ হিরো আলমের ওপর হামলায় উদ্বেগ জানিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিংয়ে হিরো আলম ওপর হামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এ ঘটনা তদন্তের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ম্যাথু মিলার বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এই ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার কোনও স্থান নেই। মিলার বলেছে বাংলাদেশের নির্বাচনে অব্যাহত নজর রাখছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে আওয়ামী লীগের এমপি শামীম ওসমানকে বিএনপির উগ্র নেতাকর্মীরা হেনস্তা করলে বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়েও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, যদিও এটি নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বাংলাদেশের নির্বাচনে সহিংসতা একটি সাধারণ ঘটনা। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনেও অতীতে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। তখন কি যুক্তরাষ্ট্র এমন বিবৃতি দিয়েছে? অবশ্যই না। কারণ, তখন সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের জন্য কোনও দল যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানায়নি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনায় নির্বাচনের দিন ১৬ জন ও তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের আগে আরও ১৯ জনসহ মোট ৩৫ জন নিহত হয়েছে। অসংখ্য আহত হয়েছে।

নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই, ব্যালট বাক্স পুড়িয়ে দেওয়া, ব্যালট বাক্সে পানি ঢেলে দেওয়া, জোর করে ব্যালট পেপার সিল দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ কিংবা ইইউ’র কোনও উদ্বেগ বা বিবৃতি নেই। কারণ, ভারতের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের জন্য ওই দেশের কোনও রাজনৈতিক দল তাদের কাছে লবিং করেনি।

প্রশ্ন হলো, কেন এমন হলো? আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক প্রয়াত লি কুয়ান ইউকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল মাত্র ৩০ বছরে একটা দরিদ্র দেশকে কীভাবে ধনী দেশে উন্নীত করলেন? তার প্রধান ‘সিক্রেট’ কী? লি কুয়ানের উত্তর ছিল, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব সিঙ্গাপুরবাসী জাপানিদের পক্ষে দালালি করেছে তাদের রাজনীতি তো দূরের কথা, কোনও সরকারি চাকরিতেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ মূলনীতিই আমাদের সফলতার মূল প্রতিপাদ্য।”

অথচ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে যারা বিরোধিতা করেছিল তারা রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তি। যারা অস্ত্র হাতে বাঙালি নিধন করেছে, আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের ধর্ষণ করেছে কিংবা পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে তারা মন্ত্রী-এমপি হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণের সুযোগ দিয়েছে, তাদের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এই দেশেরই আরেকটি রাজনৈতিক দল। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে শুধু অমান্য নয়, প্রচণ্ড বিদ্বেষে ছুড়ে ফেলে দেয়, রাষ্ট্রের সংবিধান ও জাতির স্থপতিকে যারা মানে না তারাও রাজনীতির বড় নিয়ামক। একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তারা রাষ্ট্র ও সংবিধান পাল্টে দিয়েছে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে যারা গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ করেছে জার্মানির ন্যুরেমবার্গে তাদের বিচার হয়েছে, যা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নামে পরিচিত। এই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের যারা পক্ষ নেয় ইউরোপে তাদের রাজনীতি জনতার আদালতেই প্রত্যাখ্যাত। জবর-আজব রাজনীতি আমাদের এই দেশে। পশ্চিমা গণতন্ত্রের কথা জপতে জপতে যারা মুখে ফেনা তোলেন, তারা এ কথা বুঝতে অক্ষম যে এই অদ্ভুত রাজনীতির দেশে ওই গণতন্ত্র লাগসই ও টেকসই নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অমান্য ও বিদ্বেষে ছুড়ে ফেলার সাহস করবে কেউ? যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি জর্জ ওয়াশিংটনকে কেউ অস্বীকার, অমান্য, অশ্রদ্ধা করার কথা কল্পনাও করতে পারে? স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও রাষ্ট্রের স্থপতি ওয়াশিংটনকে অমান্য-অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতি করা যাবে? প্রায় আড়াইশ’ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও রাষ্ট্রের স্থপতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব পক্ষের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও শ্রদ্ধা বজায় রয়েছে।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্যা রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম বিশ্বের অনেক দেশে অন্যতম বড় সমস্যা। আফ্রিকার বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, আইভরিকস্ট, কেনিয়া ও লিবিয়ায় বিচারবহির্ভূত হত্যা নৈমিত্তিক ঘটনা। আমেরিকা মহাদেশের আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, এল সালভেদর, জ্যামাইকা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, সুরিনাম ও খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যা অতি সাধারণ ঘটনা। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়। আর ২০২১ সালে ল্যানসেটে প্রকাশিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে,  আইনশৃঙ্খলা  বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে প্রকাশিত সংখ্যার অন্তত দ্বিগুণ, তথা ২ হাজার। আমেরিকা শুধু নিজ দেশেই নয় অন্যান্য দেশেও টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যা করে থাকে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ইউরোপের দেশগুলোতেও সংঘটিত হয়। গবেষণা বলছে, বেলারুশ, রাশিয়া, স্পেন এমনকি যুক্তরাজ্যেও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, সিরিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইসরায়েল, ফিলিপাইন, তাজিকিস্তান ও পাপুয়া নিউগিনিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার সমস্যা রয়েছে। গুম হওয়ার ঘটনাও পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হয়।

Statista Research Department কর্তৃক ২০২৩ সনের জুন মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গুম/ নিখোঁজ হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রকাশ, ১৯৯৭ সালে সর্বোচ্চ গুম/ নিখোঁজ হয়েছে ৯ লাখ ৮০ হাজার ৭১২ জন। আর সর্বনিম্ন ৫ লাখ ২১ হাজার ৭০৫ জন গুম/ নিখোঁজ হয়েছে ২০২১সালে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুম হয় শ্রীলংকায়। এছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, বেলারুশ, বসনিয়া, চিলি, চীন, হংকং, কলম্বিয়া, মিসর, এল সালভেদর, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, মরোক্কো, মিয়ানমার, আয়ারল্যান্ড, ইকোয়েটোরিয়াল গিনি, ফিলিপাইন, রুমানিয়া ও রাশিয়ার গুমের ঘটনা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে না হলেও কয়েক দশক আগে ব্যাপক সংখ্যক গুমের ঘটনা ঘটেছে জার্মানি ও স্পেনে।

নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক শুধু বাংলাদেশেই হয়, এমন নয়। পৃথিবীর বহু দেশেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হয়। কয়েকশ’ বছর ধরেই পৃথিবীর নানা প্রান্তের নির্বাচন নিয়ে অহর্নিশ বিতর্কের অন্ত নেই। অনেক দেশেই নির্বাচন নিয়ে নানা অনিয়ম, প্রতারণা, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সম্পদের ব্যবহার, ভোট গণনা নিয়ে বিতর্ক, ভোটের ফল পাল্টে দেওয়া, সহিংসতা ও নির্বাচনে অনিয়মের জন্য মামলা হয়। উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত সব দেশেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়। বিচার বিভাগের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনি সংস্থা কাজ করে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও ব্রাজিলে। লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্র রফতানির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯১২ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করেছে। তবু এসব দেশের একাধিক নির্বাচন নিয়ে তুমুল বিতর্ক রয়েছে। লাতিন আমেরিকায় ১৯৩১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অন্তত ১৬টি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, জালিয়াতি, প্রতারণা, নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যেসব দেশের নির্বাচনে এসব গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সেগুলো হলো– আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, পেরু, হাইতি, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, বলিভিয়া, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়া। মেক্সিকোর ১৯৮৮, ২০০৬ ও ২০১২ সালের নির্বাচনে জালিয়াতি, ভোট ক্রয়, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহারসহ গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। লাতিন আমেরিকার কোনও কোনও দেশে পর পর কয়েকটি নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কানাডার ১৯৫৭ ও ২০১১ সালের ফেডারেল নির্বাচনে ফল প্রভাবিত করতে অযোগ্যদের ভোটদানের সুযোগ করে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র পরিবর্তন হয়েছে এমন মিথ্যা ফোনকলে ভোটারদের প্রতারণা করা ও ভোটাধিকার প্রয়োগে বঞ্চিত করা ও ভোটার নিপীড়নের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করেছে ইউরোপের আন্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা  Organization for Security and Co-operation in Europe (OSCE)। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। প্রতিপক্ষ Strache দাবি করেছেন ৩০ হাজারেরও বেশি ভোট অগ্রিম গণনা করা হয়েছে। ৫০ হাজারেরও বেশি ভোট অননুমোদিত কর্মীদের দ্বারা গণনা করা হয়েছে এবং পাঁচ লাখের বেশি ব্যালট অবৈধ ছিল। এ ছাড়া অভিযোগ করা হয়েছে অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং অনাগরিকদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু অনিয়ম স্বীকার করেছে, তবে বলেছে যে প্রভাবিত ভোটের সংখ্যা ফলাফল উল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

২০১২ ও ২০১৮ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আছে। অনিয়মের মধ্যে অন্যতম হলো পুতিনের পক্ষে কারচুপি করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা ও  carousel voting  তথা বাসভর্তি করে একদল ভোটারকে বিভিন্ন কেন্দ্রে নিয়ে বারবার ভোটদানের সুযোগ দেওয়া। ইউক্রেনের পক্ষ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সিযুদ্ধ করছে। অথচ ইউক্রেনের ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৯৫৮ সালের পর্তুগিজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন Americo Thomaz ও Humberto Delgado।

নির্বাচনে সাধারণ প্রত্যাশা ছিল  Humberto Delgado-র ভূমিধস বিজয় হবে। কিন্তু ফলাফলে দেখা যায় Thomaz ৭৬.৪ শতাংশ ও Delgado ২৩.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। নির্বাচনে  Delgado-র সমর্থকদের ব্যাপক হয়রানি ও সহিংস আক্রমণ করা হয়। নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি করা হয়। ভোট গণনার সময় Delgado-র প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। রাশিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া ছাড়াও ইউরোপের আরও অনেক দেশের নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যেমন, রুমানিয়া, গ্রিস, সার্বিয়া ও বেলারুশ। ১৯৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত ৫২টি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। যেসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো হলো—আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, চাদ, ক্যামেরন, রুয়ান্ডা, ইথিওপিয়া, মিসর, উগান্ডা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, গিনি, আইভরি কোস্ট, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালাবি, জাম্বিয়া, সুদান টোগো, বুরুন্ডি, তানজানিয়া, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, জিবুতি ও গ্যাবন।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নির্বাচন নিয়েও রয়েছে তুমুল বিতর্ক। দক্ষিণ কোরিয়া পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ হলেও অতীতে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। ফিলিপাইন, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, তাইওয়ান, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কোনও কোনও নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত তুরস্কের নির্বাচন নিয়েও কেমাল কিলিচদারওলুর অভিযোগ, তুরস্কের সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি কারচুপি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দল তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে।

আমেরিকার ইতিহাসে একাধিকবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অনেক বিশ্লেষক এই অনিয়মকে নির্বাচনি ‘ফলাফল ছিনতাইয়ের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ১৭৭২, ১৮২৪, ১৮৭৬, ১৮৮৮, ১৮৯১, ১৯৪৮, ১৯৬০, ২০০০, ২০০২, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট কিংবা সিনেট নির্বাচনে জালিয়াতি, ভোটার নিপীড়ন, ভোটার তালিকাভুক্তকরণে অনিয়ম, Absentee Ballot (তথা পোস্টাল, প্রক্সি, অনলাইন ভোটে) অনিয়ম, ভাঁওতাবাজি ও মিথ্যা সংবাদের মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করা, প্রতিপক্ষ দলের ফোন ব্যাংক জ্যামিং, গ্যারি মেন্ডারিং (সুবিধা মতো নির্বাচনি এলাকার সীমানা পরিবর্তন), ভোট গণনা বিতর্ক, কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের প্রতি ভয়ভীতি ও সহিংসতার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে গুগলে সার্চ দিলে যে দেশের বিতর্কিত নির্বাচনের বিষয় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রদর্শন করে সেটি যুক্তরাষ্ট্র। অথচ বিএনপি ও তার মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের গুরু মেনে বাংলাদেশে মার্কিন গণতন্ত্র রফতানির জন্য লবিস্ট নিয়োগ করেছে। বাংলাদেশের সরকারকে চাপে ফেলতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে অগণিত অর্থ ব্যয় করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে কয়েক দফা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে বাংলাদেশের বিকল্প সরকারের কেন্দ্র পরিগণিত করে কয়েকশ’ পুলিশ কর্মকর্তার নামের তালিকা প্রেরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। অথচ সাম্প্রতিক জরিপে প্রকাশ, গণতন্ত্র গুরুর নিজ দেশেই নেই সঠিক গণতন্ত্র চর্চা।

যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে কিনা অথবা গণতন্ত্রে দেশের স্বার্থ দেখা হয় কিনা সে বিষয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে চালানো এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করে দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্চ। ২২-২৬ জুন পরিচালিত জরিপে প্রকাশ, যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের মতে, অর্থনীতি থেকে শুরু করে যেকোনও সরকারি ব্যয়, বন্দুকনীতি, অভিবাসন এমনকি গর্ভপাত বিষয়ে মার্কিন আইন এবং নীতি জনগণের নিজস্ব ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ৪৯ শতাংশ মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা ঠিকমতো হচ্ছে না। উল্টোদিকে গণতন্ত্র চর্চা ঠিকভাবে হচ্ছে বলে মনে করেন মাত্র ১০ শতাংশ মার্কিনি। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় অর্ধেক নাগরিক জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কোনও রাজনৈতিক দলেই গণতন্ত্র চর্চা নেই। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলে মনে করে ৪৭ শতাংশ। আর ৫৬ শতাংশ জানায় রিপাবলিকানদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা নেই।

নির্বাচনে অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ওপরে যেসব দেশের নাম আমি উল্লেখ করেছি সেসব দেশের কোনও রাজনৈতিক দল কি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে তাদের দেশে ডেকে এনেছে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য? নির্বাচন কীভাবে হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য? কোনও দেশের রাজনৈতিক দল কি বিদেশে লবিং করেছে নিজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য? মিথ্যা গল্পের সিনেমা তৈরি করে কি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করেছে?

নিজ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচার করতে ভিন দেশের কাছে তাদের নামের তালিকা পাঠিয়েছে? উত্তর, অবশ্যই না। কারণ, কোনও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে নিজ রাষ্ট্রকে, দেশের মানুষকে অপমান করতে পারে না। ওইসব দেশের রাজনৈতিক দল যা করছে, তা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রেখে পরিস্থিতি পাল্টানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তারা বিদেশিদের কাছে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়নি। কারণ তারা জানে কুইনাইন হয়তো জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?

পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে এমন রাজনৈতিক দল আছে যাদের কাছে দেশ বা দেশের সার্বভৌমত্ব বড় নয়, ব্যক্তি স্বার্থ গোষ্ঠী স্বার্থ দেশের স্বার্থের ওপরে। এমন নষ্ট, অপরিণামদর্শী রাজনীতি বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশবিরোধী এই রাজনীতির অভিঘাতে কষ্টার্ত হৃদয়ে কোনও কবি হয়তো ডি এল রায়কে অনুকরণ করে লিখবেন- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/ সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।/নষ্ট-নোংরা রাজনীতি সেই রানিকে সতত করছে দুয়োরানি।’

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মুশফিকদের বন্ধু ফুটবলার হীরকের অকস্মাৎ মৃত্যু
মুশফিকদের বন্ধু ফুটবলার হীরকের অকস্মাৎ মৃত্যু
খিলগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
খিলগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
‘দাবদাহের মধ্যে কষ্ট হলেও মানুষ ভোট দিতে আসবে’
‘দাবদাহের মধ্যে কষ্ট হলেও মানুষ ভোট দিতে আসবে’
ইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
প্রয়াণ দিনে স্মরণইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ