X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কূটনীতিকদের অতি তৎপরতা, আন্তর্জাতিক আইন কী বলে?

মো. জাকির হোসেন
২৮ জুলাই ২০২৩, ১৬:৫৭আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৩, ১৬:৫৭

কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে কর্মরত কিছু দেশের কূটনীতিক আইন, প্রথা ও শিষ্টাচার নির্ধারিত সীমার বাইরে অতি তৎপরতা দেখাচ্ছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের আচরণ রাজনৈতিক দলের কর্মীর মতো প্রতীয়মান হচ্ছে। কখনও আবার কোনও কোনও দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের সমান্তরাল সরকারের মতো আচরণ করছে।

জাতিসমূহের মধ্যে দূতবিনিময় স্মরণাতীতকাল থেকে চলে আসছে। অতীতে দুটি দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে সময়ে সময়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে দূত পাঠানো হতো। নিজ দেশের বাইরে ভিন দেশে স্থায়ী দূতাবাস ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে তখন অন্য রাষ্ট্রসমূহকে কয়েক দিন কিংবা কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হতো। ফলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও বিলম্বিত হতো। এরই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করার প্রথাগত বিধান চালু হয়। পরবর্তীতে কূটনীতিকদের কার্যপরিধি, দায়-দায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা ও দায়মুক্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬১ প্রণীত হয়।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কূটনীতিকদের কাজ হলো- এক. গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা; দুই. আইন মোতাবেক গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করা; তিন. গ্রহীতা রাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা; চার. গ্রহীতা রাষ্ট্রে বিদ্যমান যেকোনও অবস্থা সম্পর্কে আইন অনুমোদিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা নিজ রাষ্ট্রের সরকারকে অবহিত করা; এবং পাঁচ. প্রেরক রাষ্ট্র ও গ্রহীতা রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন ও তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্কের প্রসার ঘটানো।

আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রদূতদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যম হবে সরকার। কোনোভাবেই কোনও রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ নেই। প্রশ্ন হতে পারে, কোনও রাষ্ট্রের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল কিংবা নির্বাচনে কূটনীতিকরা নাক গলাতে পারবেন না এটি কোথায় বলা আছে? ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১(১) ধারায়  বলা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি অন্য কোনও দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন, তারা ওই দেশের আইন ও নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। পাশাপাশি কূটনৈতিক কার্যাবলি ছাড়া তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোনও বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।

৪১(২) ধারায় বলা হয়েছে, কূটনীতিকদের সব ধরনের দাফতরিক কাজ, যা প্রেরক রাষ্ট্র কূটনীতিক মিশনের ওপর ন্যস্ত করবে, তা গ্রাহক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হবে।

আর ৪১(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কূটনীতিকরা তাদের মিশন অফিসের প্রাঙ্গণ ভিয়েনা কনভেনশন কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনের বিধান কিংবা প্রেরক ও গ্রহীতা রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান কোনও চুক্তি অনুযায়ী কূটনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবেন না।

১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন কূটনীতিকদের আচরণ ও নিষিদ্ধ কার্যাবলির তালিকার ক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন নয়। কালের পরিক্রমায় কূটনৈতিক রীতি-প্রথা ও নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিকদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি গড়ে উঠেছে। এসব আচরণবিধি বিধিবদ্ধ করা না হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৭ সালে Sir Ernest Satow-এর লেখা বই A Guide to Diplomatic Practice এবং ২০১৬ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক Paul Behrens-এর বই Diplomatic Interference and the Law প্রণিধানযোগ্য। এ বই দুটিতে গ্রহীতা রাষ্ট্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ, গ্রহীতা রাষ্ট্রের সরকারের সমালোচনা, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের সীমাবদ্ধতার বিষয় বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।

ভিয়েনা কনভেনশনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনও দেশ ওই দেশে নিযুক্ত অন্য দেশের কূটনীতিকদের কোনও কারণ দর্শানো ছাড়াই পারসোনা নন গ্রাটা বা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পারে। প্রেরক রাষ্ট্র যথাযথ সময়ে তাদের কূটনীতিককে ফিরিয়ে না নিলে গ্রহীতা রাষ্ট্র ওই কূটনীতিকের বিশেষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা নাকচ করতে পারে।

গ্রহীতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, এটি কোনও প্রথা বা সৌজন্যতার বিধি নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যতামূলক বিধান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, হস্তক্ষেপের অভিযোগে গ্রহীতা রাষ্ট্র কূটনীতিকদের সতর্কতা, বহিষ্কার এবং এমনকি কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। জানা ইতিহাস মতে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রথম ঘটনা ঘটে ১৫৮০ সালে। ইংল্যান্ডে নিযুক্ত স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত বার্নার্ডিনো ডি মেন্ডোজা প্রথম এলিজাবেথকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র ‘Throckmorton Plot’-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাধারণের প্রত্যাশা ছিল এই ঘটনায় রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু, এলিজাবেথের উপদেষ্টা আলবেরিকো জেন্টিলির পরামর্শে তাকে বহিষ্কার করা হয়। আন্তর্জাতিক আদালত Tehran Hostages মামলায় বলেছেন, কূটনৈতিক দায়িত্বের অপব্যবহার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অজুহাত তুলে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নজিরবিহীন নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত কোনও কোনও পশ্চিমা দূতাবাস রাজনৈতিক সংগঠনের মতো মাঠে নেমেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলে এবং বাংলাদেশে আজ্ঞাবহ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে নানা অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত। এরই অংশ হিসেবে একটি দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত, বিদেশে পলাতক, বিতর্কিত ব্যক্তির তৈরি তথ্যচিত্র পোস্ট করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আজকাল হামেশাই খবর বেরোয় বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। বৈঠক শেষে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে রাষ্ট্রদূত ও বিএনপি নেতৃবৃন্দের ছবি ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দ আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুটা লুকোচুরির আশ্রয় নেন। কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে– এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে অপারগতা জানান। রুদ্ধদ্বার বৈঠক কখনও কোনও বিএনপি নেতার বাসায় কিংবা কখনও পশ্চিমা কোনও রাষ্ট্রদূতের বাসায় অনুষ্ঠিত হয়। এসব রুদ্ধদ্বার বৈঠকের হকিকত কী? বৈঠক রুদ্ধদ্বার হওয়াই বলে দিচ্ছে, ‘ডাল ম্যা কুছ কালা হ্যায়।’ বাংলার নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ক্লাইভের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের সময় কাশিম বাজার কুঠিতে এমন গোপন বৈঠক হতো। কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক হস্তক্ষেপের একটি ঘটনা হলো, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলায় নিন্দা জানিয়ে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ১২টি বিদেশি মিশন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান। বিবৃতিতে তারা ওই ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহির দাবি জানায়। এর আগে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসও ১৮ জুলাই টুইট করেছিলেন। এর জেরে দুদিন পর ২০ জুলাই জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়কারীকে তলব করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এরপর বিবৃতিদানকারী ১২টি বিদেশি মিশন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন, হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় ১২টি বিদেশি মিশন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল, তাতে কূটনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারকে পাশ কাটিয়ে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতাবর্জিত আচরণ কেবলই পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করবে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের প্রতি ভবিষ্যতে এমন ‘অকূটনৈতিক’ আচরণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়ে জানার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন কমিশন ও সরকার দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। ১৯ জুলাই কূটনীতিকেরা যৌথ বিবৃতি প্রদান ও ১৮ জুলাই বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস টুইট করার আগেই দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই তা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। অথচ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কূটনীতিকরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যা ‘অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয়’।

সরকারের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের বলা হয়েছে, ‘যে দ্রুততা ও গুরুত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ঘটনাটির সমালোচনা তাঁরা করেছেন, সেই গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে তাঁরা সরকারের গৃহীত তাৎক্ষণিক ও ত্বরিত আইনানুগ ব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করেননি। তাই যৌথ বিবৃতিটির বস্তুনিষ্ঠতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যায়।’ যৌথ বিবৃতিটি ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে তড়িঘড়ি করে অপরিণতভাবে উপস্থাপন করায় কূটনীতিকদের কাছে আহ্বান জানানো হয় যে ভবিষ্যতে এমন অকূটনৈতিক আচরণ থেকে তারা বিরত থাকবেন।

কূটনীতিকরা যা করেছেন তা কেবল ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনেরই লঙ্ঘন নয়, অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস গত বছর বাংলাদেশ মিশনে যোগদান করার পরই পক্ষপাতমূলক ও জাতিসংঘের সনদবিরোধী আচরণ করছেন। যোগদানের অব্যবহিত পরই গত বছরের ১২ জুলাই তিনি বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে বিতর্কের জন্ম দেন। গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে আমীর খসরু বলেন, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। কী বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে তা নিয়ে কোনও পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। ‘ভাসুরে’র নাম মুখে নিতে লজ্জা হলেও এটি যে কেবল সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল না এবং আলোচনার বিষয়বস্তু যে পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক তা সহজেই অনুমেয়। খবরে প্রকাশ, বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ও প্রতিনিধি রেবেকা ভিকের সঙ্গে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়েছে। এছাড়া দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়।

প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ও তার প্রতিনিধি কোনও রাজনৈতিক দলের অফিসে যেতে পারেন কিনা? এবং সৌজন্য সাক্ষাতের নামে কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মতবিনিময় করতে পারেন কিনা? জাতিসংঘের গঠনতন্ত্র তথা জাতিসংঘ সনদের কোনও বিধানে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কিংবা অন্য কোনও প্রতিনিধিকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কিনা? উত্তর, অবশ্যই না। কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতিসংঘের ভূমিকা রাখার কোনও সুযোগ নেই। কোনও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কারও অভিযোগের কারণে জাতিসংঘ একতরফা কোনও ভূমিকা রাখতে পারে না। এমনকি কোনও দেশের রাজনীতির ঘরোয়া বিবাদ মেটাতেও জাতিসংঘ ভূমিকা রাখতে পারে না। এরকম ভূমিকা পালনের কোনও এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই।

ঢাকায় অবস্থিত জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র ‘অল্প কথায় জাতিসংঘ সনদ’ নামে যে প্রকাশনা বের করেছে তার ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সনদের ২ ধারা অনুযায়ী সব সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সমতাই জাতিসংঘের ভিত্তি। সংস্থাটি বিশ্ব সরকার নয়।…সনদে এমন কিছু নেই যা জাতিসংঘকে কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অধিকার দেয়। এরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোনও দেশকেও জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না। কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ এখতিয়ারভুক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে সনদের ভাষা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে এমন যেকোনও বিষয় ওই পরিষদ বিবেচনা করতে পারে। অনুরূপভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও জাতিসংঘের উপযুক্ত সংস্থাসমূহ আলোচনা করতে পারে।’ গোয়েন লুইস স্পষ্টতই জাতিসংঘ সনদের বিধান লঙ্ঘন করেছেন। জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ও যৌথ বিবৃতিদাতা কূটনীতিকরা ২০০১ সালের Responsibility of States for Internationally Wrongful Acts শিরোনামের আন্তর্জাতিক আইনের বিধানও লঙ্ঘন করেছেন। এই আইনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র তথা সরকার নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগে নিযুক্ত কোনও ব্যক্তি কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়ী হবে। কোনও সাধারণ নাগরিকের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায় সরাসরি সরকারের ওপর বর্তায় না। আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুযায়ী সাধারণ নাগরিকের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য সরকার দায়ী হবে যদি এই লঙ্ঘনের ঘটনায় সরকার আইনগত ও বিচারিক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করে।

হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরকার হামলাকারীদের গ্রেফতার করেছে, রিমান্ডে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বাংলাদেশ সরকার অযাচিত যৌথ বিবৃতি ও টুইটের জবাবে এমন ঘটনাকে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বলে কূটনীতিকদের যেভাবে সতর্ক করেছেন তার উদাহরণ অন্যান্য দেশে আছে কি? পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেসব ইন্দোনেশীয় সহিংসতায় জড়িত ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলেন ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এটি ২০০০ সালের ঘটনা। ইন্দোনেশিয়ার সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্যকে ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিযুক্ত করে। জিম্বাবুয়েতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘জিম্বাবুয়েতে (রাজনৈতিক) সহিংসতা বন্ধ করতে হবে’। এর জের ধরে জিম্বাবুয়ে সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যাকজিকে মন্ত্রণালয়ে তলব করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক করে। এটি ২০০৮ সালের ঘটনা। এর আগে ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিদেশমন্ত্রী Simbarashe Mumbengegwi একদল পশ্চিমা কূটনীতিককে ডেকে হুঁশিয়ার করে দেন যে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী জিম্বাবুয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ।

২০০৭ সালে সুদানে নিযুক্ত কানাডিয়ান চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মিসেস ললর এবং ইইউ কূটনীতিক ডিগারফেল্ডকে বহিষ্কার করে সুদান। রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আটককৃত ও কারাবন্দি বিরোধী নেতাদের মুক্তির জন্য রাষ্ট্রদূতরা আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০১০ সালের মে মাসে, স্লোভাকিয়ায় নিযুক্ত ১০টি দেশের রাষ্ট্রদূত একটি যৌথ খোলা চিঠি প্রকাশ করেছিল– যাতে তারা লেসবিয়ান, গে, উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের (এলজিবিটি) প্রাইড প্যারেডের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। স্লোভাকিয়া রাষ্ট্রদূতদের এই পত্র প্রকাশকে স্লোভাকিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিযুক্ত করে। ফিজিতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রীনিবাসন সে দেশে অবস্থিত ভারতীয় মন্দিরে বোমা নিক্ষেপের প্রতিবাদে ও সমস্যার সমাধানকল্পে ফিজির সংবিধানে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বিধান সংযোজনের বিবৃতি দেয়। এই ঘটনায় ফিজি শ্রীনিবাসনকে বহিষ্কার করে। নেপালে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রাকেশ সূদ নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রর সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে কূটনীতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেন। ১৯৭০ সালে যুগোস্লাভিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সিলবারম্যান যুগোস্লাভিয়া সরকার কর্তৃক কারাবন্দিকৃত একজন আমেরিকান নাগরিককে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। রাষ্ট্রপতি টিটো এই ঘটনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে যুগোস্লাভিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করেন। 

রাষ্ট্রদূতরা যৌথ বিবৃতির পক্ষে যৌক্তিকতা প্রমাণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের কথা তুলে ধরেন। এই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য? ২০০০ সালে পেরুতে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রবার্ট হার্টকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রদূত রবার্ট হার্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। ২০০৪ সালে মেসিডোনিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ভোটারদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই ঘটনায় মেসিডোনিয়া সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘গুরুতর হস্তক্ষেপ’ করার অভিযোগ করেছিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনায় নির্বাচনের দিন ১৬ জন ও তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের আগে আরও ১৯ জনসহ মোট ৩৫ জন নিহত হয়েছে। অসংখ্য আহত হয়েছে। নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই, ব্যালট বাক্স পুড়িয়ে দেওয়া, ব্যালট বাক্সে পানি ঢেলে দেওয়া, জোর করে ব্যালট পেপারে সিল দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ কিংবা ইইউ কোনও উদ্বেগ বা বিবৃতি দেওয়ার সাহস দেখাতে পেরেছে? এখানে রাষ্ট্রদূতরা ভারতের সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বদ্ধ ঘরে আলাপ করার দুঃসাহস দেখাতে পারে?

রাজনৈতিক দলের মতো জোটবদ্ধ হয়ে পশ্চিমা দূতাবাস ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ক্রমাগত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যেভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে তা কেবল দুঃখজনকই নয়, লজ্জাজনক বটে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হরণে যারা বিদেশিদের উসকে দিচ্ছে, তাদের অবৈধ হস্তক্ষেপে উল্লসিত হচ্ছেন, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ