X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ আগস্ট ঘিরে যে ভাবনাগুলোর উত্তর খুঁজে ফিরছি

মো. জাকির হোসেন
১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:১১আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:১১

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে আমার মনে বেশ কিছু ভাবনা ঘুরপাক খায়। ওই ভাবনাগুলোর উত্তর খুঁজে ফিরছি বহু বছর। সন্তোষজনক উত্তর আজও খুঁজে পাইনি। উত্তর খুঁজে ফেরা সে ভাবনাগুলো হলো–

এক. বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত, নিষ্ঠুর ও অকৃতজ্ঞ। কেন বলছি? বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এক ধরনের সম্মোহনী শক্তি ছিল। তাঁর উচ্চতায়, ভরাট কণ্ঠে, দেহ সৌষ্ঠবে, তর্জনী হেলনে, মানুষকে ভালোবাসবার ক্ষমতায়, ক্ষমার উদারতায়, কুসংস্কার ও বিদ্বেষ মুক্ত হৃদয়, আসাম্প্রদায়িকতার প্রতি দৃঢ়তা, অতল ত্যাগের মানসিকতায় তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব। নিজের ব্যক্তিগত ও পরিবারের সুখ, স্বপ্ন, আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে কেবল দেশের ও দেশের মানুষের জন্য বছরের পর বছর কারাগারের জীবনকে মেনে নেওয়া; মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি ত্যাগ না করার দুর্বিনীত সাহসিকতায় বঙ্গবন্ধু এক অতুলনীয় চরিত্র ছিলেন। এমন একজন ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ালে কোনও মানুষ যত কঠিন, কঠোর হৃদয়ের হোক না কেন, তার অন্তর বিগলিত হতে বাধ্য।

তাঁকে গুলি করে হত্যার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু খুনি রশিদ, ফারুক, নূর, হুদা গংরা ভয়ঙ্কর জিঘাংসায় উন্মত্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখেন বাড়ির গেট দিয়ে মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন হুদা এগিয়ে আসছে। কামাল তাদের দেখেই বলতে শুরু করেন, আপনারা এসে গেছেন, দেখেন তো কারা বাড়ি আক্রমণ করলো? শেখ কামালের কথা শেষ হতে পারলো না। তাদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠলো। কামাল সেখানেই লুটিয়ে পড়লো। পরম নির্ভরতায় যাদের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানালো তারাই ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর নূর আর শেখ কামাল একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। আর সে কারণে ওরা একে অপরকে ভালোভাবে চিনত। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! সে চেনা মানুষগুলো কেমন অচেনা ঘাতকের চেহারায় আবির্ভূত হলো। নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করলো সহযোদ্ধা কামালকে। বঙ্গবন্ধু নিচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হন। কথা বলতে বলতে তিনি সিঁড়ির কাছে পৌঁছান। এ সময় সিঁড়ির মাঝের প্ল্যাটফরমে খুনিরা দাঁড়িয়েছিল, তারাও দোতলায় উঠে আসছিল। এদের মধ্যে হুদাকে চিনতে পারেন বঙ্গবন্ধু।

তার বাবার নাম ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন— তুমি রিয়াজের ছেলে না? কী চাস তোরা? কথা শেষ করতে না করতেই গর্জে ওঠে ওদের হাতের অস্ত্র। তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগ দিয়েছিল রিসালদার মোসলেউদ্দিন। ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়লেন জাতির জনক। যে বাড়ি ছিল বাঙালির মুক্তির ঠিকানা, যে বাড়ি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সেই বাড়ি স্বাধীনতার স্থপতির রক্তে সিক্ত হলো। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘাতকের দল ততক্ষণে ওপরে ওঠে এসেছে।

বঙ্গমাতাকে তারা বাধা দিল এবং বলল যে, আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন। তিনি বললেন— আমি এক পা-ও নড়ব না, কোথাও যাব না। তোমরা উনাকে মারলে কেন? আমাকেও মেরে ফেলো। ঘাতকদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠল। লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি ব্যক্তিগত স্বপ্ন, সাধ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। দেশের জন্য স্বামীর কারাবরণকে হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত জীবনে বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দী জীবনের ১৪ বছর স্বামীর সহচার্য বঞ্চিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নেপথ্যে থেকে দল পরিচালনা করেছেন, আন্দোলনে পরামর্শ দিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছেন। দেশের স্বার্থে যিনি এত ত্যাগ স্বীকার করলেন তাঁকে হত্যা করতেও ঘাতকের বুক কাঁপেনি। ঘাতকদের অনেকের ৩২ নম্বরের বাসভবনে যাতায়াত ছিল। বঙ্গমাতার স্নেহের পরশে খুনিরা কতবার সিক্ত হয়েছে। জিঘাংসার আগুনে পুড়ে খাক হয়েছে সেই স্নেহ ও ভালোবাসা।

স্মরণাতীত কাল থেকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বিশ্বে অনেকবার হয়েছে। বিশ্বের বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কয়েকটি দেশে জাতির পিতাকেও হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে এমন আরেকটি উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে একটি জাতির স্থপতিকে হত্যার পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণে জনকের শিশুপুত্রসহ হাতের কাছে যাদের পেয়েছে সবাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

১৫ আগস্টের নৃশংসতা অমোচনীয় ইতিহাস- বাঙালির কলঙ্কের ইতিহাস। এতটা অকৃতজ্ঞ আমরা কেন হলাম? এখনও কেন বাঙালিদের একটা অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ওই অকৃতজ্ঞদের দলে?

আমরা কেন এই অকৃতজ্ঞদের বিরুদ্ধে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হবো না? তাদের বর্জন করবো না?

দুই. বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনৈতিক দর্শন ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রকেও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সংবিধানে গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের সংযোজন সারা বিশ্বেই একটি অনন্য উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেই দায়িত্ব শেষ করেননি। বরং, বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেন। শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করেন। জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পদে ৪০ শতাংশ শ্রমিকের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের জনগণকে বাঁচাতে হলে সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।’

বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, ‘আমি মার্ক্সিস্ট নই। আমি একজন সমাজতান্ত্রিক, কিন্তু সেটা আমার নিজস্ব পথে।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, যে সমাজতন্ত্র জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটা সত্যিকারের সমাজতন্ত্র হতে পারে না। মানুষের মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, বিকাশ লাভ করে, সেই সমাজতন্ত্রই প্রকৃত সমাজতন্ত্র।’ তারপরও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে দেশে কেন অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল? এ সময় পাঁচজন সংসদ সদস্যসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো, ঈদের জামাতে হামলা করা হয়েছিলো, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া হয়েছিলো, থানা আক্রমণ করা হয়েছিলো, রেললাইন তুলে ফেলা হয়েছিলো। যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া রাষ্ট্র যখন সবাই মিলে মেরামত করার কথা তখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে অরাজকতার পেছনে কী কারণ ছিল? কেন এভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিলো? স্বাধীনতাবিরোধীদের সংগঠিত ও পুনর্বাসিত হয়ে প্রতিবিপ্লবের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিলো?

তিন. খুনিরা বা তাদের মদদ দাতারা কী চেয়েছিল? অপবাদ দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্র হত্যা করেছিলেন। এই কথা কি সত্য? পুঁজি বা জমির মালিক উৎপাদনের প্রায় সবটুকু ভোগ করে। আর উচ্ছিষ্টভোগী শ্রমিক মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হয়। এভাবে সমাজে সৃষ্টি হয় ভয়ানক বৈষম্য। বঙ্গবন্ধু এই বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর করতে উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা তথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব দ্য ফিউচার অব ডেমোক্রেসির গবেষকরা সম্প্রতি বিশ্বের ১৫৪টি দেশের ওপর এক জরিপ করে জানিয়েছেন যে গণতন্ত্রের প্রতি অসন্তুষ্টি চরম পর্যায়ে। জরিপের ফলাফলে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা এখন ‘উদ্বেগের’পর্যায়ে রয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি বা উচ্চমাত্রায় অসন্তুষ্টি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক ভেদাভেদে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের অসন্তুষ্টি বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভেদাভেদের এই কুফল অনুধাবন করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সম্মিলনে নতুন রাজনৈতিক দর্শনের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। নতুন যাত্রার শুরুতে সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা তিনি নিজেই বলেছেন। কৃষক-শ্রমিক, গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় নতুন দর্শনের যাত্রায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ যদি গণতন্ত্র হত্যা হয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

মোশতাক, বিচারপতি সায়েম ও জিয়া তিনজনই তো অসাংবিধানিক ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।’

এই তিনজনের কেউই সংবিধানের বিধান মেনে সংসদ সদস্যদের কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হননি। তদুপরি জিয়া একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কয়েক বছর সামরিক শাসন জারি ছিল। সামরিক শাসন বহাল থাকা অবস্থায় ‘হ্যাঁ, না’ ভোটের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। এটা কি গণতন্ত্র?

চার. বিএনপি প্রতিষ্ঠা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তিন বছরেরও বেশি সময় পরে। বঙ্গবন্ধু তো বিএনপির কোনও ক্ষতি করেননি, তবু বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিএনপির কেন এত বিদ্বেষ, এত শত্রুতা? বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিএনপির কেন পরিকল্পিত মিথ্যাচার? বঙ্গমাতা যদি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে স্বামীর বার বার জেলে যাওয়ার বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়াতেন; কিংবা দু’য়েক বছর জেল খাটার পর নিপীড়নের ভয়ে বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে সরে আসতেন; পাকিস্তানিদের সাথে সমঝোতা করতেন; কিংবা বঙ্গবন্ধু যদি দেশে ও দেশের মানুষের ভাবনা বাদ দিয়ে নিজের ঘর-সংসার আর পরিবারের প্রতি মনোযোগী হতেন এই দেশ কি স্বাধীন হতো?  

পাঁচ. ১৯৮৫ সনে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস খুনি রশিদকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ছোট শিশুকেও আপনাদের কেন হত্যা করতে হয়েছিল?’ দাম্ভিক উত্তর ছিল, ‘শেখ মুজিবকে সবংশে নির্মূল করার জন্য রাসেলকে হত্যা করা দরকার ছিল।’

বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারী রাসেলসহ সবাইকে হত্যা করা হত্যাকারীদের জন্য বিকল্পহীন প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধুকে বিনাশ করতে হলে শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে বিনাশ করলে চলত না, বিনাশ করতে হতো গোটা পরিবারসুদ্ধ। কারণ খুনিরা জানতো, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরিরা একদিন লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অশুভ শক্তি বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করবে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরা বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর মতই বাঙালি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতেন, বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা হতেন। রাসেলকে হত্যা করার পর খুনিদের একজন বলেছিলো, ‘অল আর ফিনিশড’। খুনিরা কি জানে না মানুষের ভালবাসায় যুগ যুগ যারা বেঁচে থাকে, মৃত্যু তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না? অল আর ফিনিশড বলে খুনিরা ভেবেছিলো তাদের মিশন সফল হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাদের দম্ভ ধূলিস্যাৎ হয়েছে; তারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু, রাসেলসহ ১৫ আগস্টের সব শহীদ অমর। আর আত্মস্বীকৃত খুনিদের স্থান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। শহীদরা পান আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা; আর খুনিরা পায় ঘৃণা, নিরন্তর ঘৃণা।

যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ থাকবে, ততদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হবে। তাঁর মুক্তির দর্শন চর্চিত ও অনুসৃত হবে। খুনিরা এতটাই ক্রোধান্ধ ছিল যে, তারা অনুধাবন করেনি বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ যমজ। এটি ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাগ বা ক্ষোভের বিষয় নয়। ভয়ানক জিঘাংসা। খুনিদের মনে কেন এত সর্বনাশা জিঘাংসা ছিল? এই জিঘাংসা কে বা কারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উসকে দিয়েছিলো? মদদ জুগিয়েছিলো? হত্যাকাণ্ডে খুনিদের মদদদাতারা শুধু বাংলাদেশের নাগরিক, না অন্য কোনও দেশের সম্পৃক্ততা রয়েছে?

ছয়. কয়েকজন মধ্যম সারির সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক ব্যক্তির বিচার হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিলো সিআইডি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দিন কি কেবল এই কয়েকজন কিলিং মিশনের সাথে যুক্ত ছিল নাকি আরও মানুষ ছিল? তথ্য-প্রমাণ বলছে হত্যাকাণ্ডের দিন প্রায় ৬০০ সেনা সদস্য কিলিং মিশনের নানা প্রান্তে দায়িত্বপালন করেছে। খুনের সহযোগী ওই সদস্যদের বিচার হলো না কেন?

জাতির পিতা হত্যার মিশনে যারা ছিল তাদের কি বোধোদয় হয়েছে? তারা কি অনুতপ্ত? নাকি সেই বিনাশী জিঘাংসা নিয়ে তারা ও তাদের বংশধরেরা আজও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে? তাদের চিহ্নিত করে নাম, পরিচয়, অবস্থান কেন প্রকাশ করা হবে না?

সাত. নিরপেক্ষতার ভানধরা কিছু সুশিল গণতন্ত্র, মানবাধিকারের জন্য হাহাকার করছে। এরা ১৫ আগস্টের খুনের শিকার, খুনি ও খুনের সুবিধাভোগী সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে চান। তারা একথা বলেন না যে, দায়মুক্তি আইন যারা সংবিধানে সংযোজন করেছে, খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে তারা অপরাধ করেছে। অপরাধের ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে হবে।

জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের প্রতি যে নৃশংসতা হয়েছে তার প্রতি সংবেদনশীল, সহমর্মী হতে। জাতির পিতাকে মানতে হবে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে মানতে হবে। তারা একথা বলে না যে, জাতির পিতাকে অস্বীকার-অসম্মান করে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ছুঁড়ে ফেলে বাংলাদেশের পক্ষে হওয়া যায় না। এই নীরবতা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের মাধ্যমে সুশিলরা কি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার প্রতি মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করছেন না? স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার করাকে সমর্থন করছেন না?

আট. যার অঙ্গুলিহেলনে দেশের কোটি কোটি মানুষ জীবন দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই প্রতাপশালী পরাশক্তির সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন, জাতির সেই প্রাণভোমরাকে কয়েকজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা হত্যা করেছেন– এটি বিশ্বাসযোগ্য? কেউ খুন করেছেন, কেউ নেপথ্যে ষড়যন্ত্র করেছেন। কেউ পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু, তাঁর সরকার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কদাকার-কুৎসিত অপপ্রচার করে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। কেউ পরিকল্পিতভাবে অরাজকতা সৃষ্টি করে ষড়যন্ত্র ও খুনের পরিবেশ তৈরি করে প্রভাবকের কাজ করেছেন।

কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। নেপথ্যের এসব কুশীলবের মুখোশ উন্মোচন করতে, ইতিহাসের কাঠগড়ায় এসব বিশ্বাসঘাতকের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি তদন্ত কমিশন করতে কেন এত বিলম্ব হচ্ছে?

নয়. বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যারা হত্যা করেছে, হত্যায় যারা সহযোগিতা করেছে, হত্যাকারীদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, হত্যার বিচার করা যাবে না মর্মে যারা আইন তৈরি করেছে তাদেরকে ইসলামের নামে রাজনীতি করা কিছু দল সমর্থন করে, তাদের সহযোগী। পবিত্র কোরআনে এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন। ’(সূরা নিসা: ৯৩)

কোরআনের বিধান অনুসারে হত্যাকারীকে আইনের সহায়তায় ঠিক সেভাবেই হত্যা করা হবে, যেভাবে সে হত্যা করেছে যদি না নিহতের নিকটজন হত্যাকারীকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেয়। কোরআনে হত্যার বিচার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘মুমিনরা, তোমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে অন্যায়ভাবে হত্যার বিরুদ্ধে অনুরূপ প্রতিশোধ নিতে।’ (সূরা বাক্বারাহ: ১৭৮-১৭৯)

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: ‘দুনিয়া ধ্বংস করার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণ্যতর কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি, ১৩৯৫)

অন্য এক হাদিসে রাসূল(সা.) বলেছেন, ‘যদি আসমান ও জমিনের সব অধিবাসী একজন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যার জন্য একমত হয়, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (তিরমিযী, ১৩৯৮)

ইসলামে যুদ্ধক্ষেত্রেও নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করা নিষিদ্ধ।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ: ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৪৮৭-৪৮৮) অথচ ১৫ আগস্ট নিরীহ, নিরস্ত্র নারী ও শিশু হত্যাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিলো আইন প্রণয়ন করে।

এখনও যারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে সমর্থন করে, আরেকটি ১৫ আগস্টের হুমকি দেয়, তাদেরকে সমর্থন ইসলাম সম্মত কি?

১৫ আগস্টের এই ভাবনাগুলো হামেশাই তাড়িয়ে বেড়ায়। নিরন্তর উত্তর খুঁজে ফিরি। জীবদ্দশায় এর অবসান হবে কি?

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ