X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নদীর দেশের মানুষ কেন পানি কিনে খায়?

আমীন আল রশীদ
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:২৬আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:২৬

‘নদীর জল ঘোলাও ভালো’—নদীমাতৃক বাংলাদেশে এই প্রবাদটি যখন চালু হয়েছিল, সেই সময়ে এই বাংলার মানুষেরা হয়তো জানতেন না যে, নদীর দেশের মানুষকে একসময় এক গ্লাস (আধা লিটার) পানি ২০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হবে।

২০ টাকার বাজারমূল্য এখন কত, ২০ টাকায় আর কী কী পাওয়া যায়—সেই তর্কে না গিয়েও এই প্রশ্নটি তোলার সময় হয়েছে যে, নদীর দেশের মানুষকে কেন পানি কিনে খেতে হবে?

যে দেশের প্রতিটি এলাকায় এক বা একাধিক নদী আছে, সেই দেশে কেন বিশুদ্ধ পানির আকাল? সেই দেশে নদীর পানি কেন পানযোগ্য থাকলো না? জোয়ার-ভাটার কারণে জল ঘোলা হলেও একসময় যে দেশের নদীর পানি পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হতো, সেই দেশের রাজধানী এবং আশেপাশের শহর, বড় শহর ও শিল্পাঞ্চলের নদীগুলোর পাড় দিয়ে শুকনো মৌসুমে হেঁটে গেলে কেন নাক চেপে ধরতে হয়? কেন নদীর পানি দূষিত হতে হতে পান করা তো দূরে থাক, শরীরে লাগলেও চুলকায়?  

সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে এর দুদিন আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দোয়েল চত্বর এলাকায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে নদী বিষয়ে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নদীরক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘নোঙর’—যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

উত্তাল মেঘনার পাড়ে বড় হওয়া শাহাবুদ্দীন শৈশব-কৈশরের স্মৃতি হাতড়ে শিশুদের জানান, ছোটবেলায় তিনি প্রথম স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীর ছবি এঁকে।

বাংলাদেশের অনেক নদীর পানি তিনি পান করেছেন। পেটের পিড়ার ভয় ছাড়াই গিলে ফেলেছেন। কিন্তু এখন বাংলাদেশের নদীর পানি পান করা তো দূরে থাক, অনেক নদীর পানি স্পর্শও করা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে প্যারিসপ্রবাসী এই খ্যাতিমান শিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, ‘নদীর দেশে পানি কিনে খাই; মনে হয় বিদেশে আছি।’

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার এই আক্ষেপ আমাদেরকে অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কেন এবং কোন প্রক্রিয়ায় আমাদের নদীগুলোর পানি পানঅযোগ্য হয়ে গেলো? কেন রাজধানীর আশেপাশের নদীগুলোর পানি পান করা তো দূরে থাক, এখন গৃহস্থালির কোনও কাজেও ব্যবহার করা যায় না?

পানি দূষিত হতে হতে এখন সেই সব নদীতে মাছ তো দূরে থাক, অন্য কোনও জলজ প্রাণিও আর টিকে থাকতে পারছে না। ফলে নদীনির্ভর মানুষ, বিশেষ করে জেলেদের এখন দারুণ দুর্দিন। নদীতে মাছ না থাকলে তাদের উনুনে আগুন জ্বলে না। নদী ভালো না থাকলে তারাও ভালো থাকেন না। ফলে দূষণের শিকার নদীপাড়ের জেলেদের বিরাট অংশই এখন হয় বেকার, না হয় দিনমজুর। বাধ্য হয়ে তাদেরকে এমন সব কাজ করতে হচ্ছে, যে কাজ তারা করতে চান না। যে কাজে তারা অভ্যস্ত নন। প্রশ্ন হলো, নদীকে এই পর্যায়ে কে নিয়ে এলো? কোন প্রক্রিয়ায়?

এই প্রশ্নের ‍উত্তর সবার জানা। প্রাকৃতিক কারণ (নদী ভাঙন) বাদে বাংলাদেশের নদীগুলো বিপন্ন হয়েছে প্রধানত তিন কারণে।

১. নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, ২. কল-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য এবং ৩. সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ত্রুটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তথা আধুনিক ডাম্পিং স্টেশন না থাকায় অধিকাংশ বর্জ্যের গন্তব্য নদী।

বাংলাদেশে যেসব কাজ খুব সহজে করা যায়, তার অন্যতম হচ্ছে নদী দখল। নদী দখল করে সাধারণত প্রভাবশালীরা। বিশেষ করে নগর, শহর ও শিল্পাঞ্চলে। তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নদীর পাড়ে কল-কারখানা গড়ে তুলতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ নদীর জমি দখল করে নেয়। অর্থাৎ নানা কৌশলে, কায়দা-কানুন করে নদীর ভেতরে নিজেদের জমি টেনে নিয়ে যায়। কোথাও কোথাও দখল করতে করতে নদীকে খাল এবং খালকে ড্রেনে পরিণত করে। এটা হচ্ছে নদী বিপন্নতার প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ হলো, নদীর জায়গা দখল করে যে কল-কারখানা গড়ে তোলা হয়, সেই কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যও ফেলা হয় এই নদীতে।

নদীকে বলা হয় ‘সর্বংসহা’। কিন্তু তারও সহ্যের সীমা আছে। কতটুকু দূষণ সে নিতে পারে? কত দিন, কত মাস, কত বছর? নগরায়ণ, শহরায়ণ ও শিল্পায়নের নামে নদীর ওপর এই অত্যাচার চলছে বছরের পর বছর ধরে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরাও হয়তো মনে করেন, দেশে এত নদী থাকার দরকার কী? তারাও হয়তো মনে করেন, নদী না থাকার পরেও তো পৃথিবীর অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সমৃদ্ধ। ফলে তারা হয়তো ভাবেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা প্রবৃদ্ধির জন্য কিছু নদী যদি খেয়ে ফেলতে হয়, তাতে কী এমন ক্ষতি! কিন্তু বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি যে ‍পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের মতো নয়; ইউরোপের ভূমির কাঠামো আর বাংলাদেশের কাঠামো যে সম্পূর্ণ আলাদা—সেই বোধটুকু আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নেই, অথবা তারা সবকিছুকে টাকার অংকে বিচার করেন।

নীতিনির্ধারকদের কাছে যখন টাকা তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানটাই মুখ্য হয়ে ওঠে; যখন দৃশ্যমান অবকাঠামোই উন্নয়নের প্রধান সূচক হয়ে দাঁড়ায়—তখন সেই দেশে নদীগুলো বাঁচানো কঠিন। অথচ নদীকে সুরক্ষিত রেখেই নগরায়ণ, শহরায়ণ ও শিল্পায়ন করা সম্ভব ছিল। সে জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রের নদীবান্ধব নীতি এবং তার কঠোর প্রয়োগ।

নদীর পাড়ে কল-কারখানা ও আবাসন গড়ে তোলার নামে নদীর জায়গা দখল কঠোর হাতে দমন করা গেলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। প্রতিটি কারখানা যদি বর্জ্য পরিশোধন করে শুধু তার রঙিন তরলটুকু নদীতে ফেলতো, তাহলেও আজকের এই দশা হতো না। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় আধুনিক ডাম্পিং স্টেশনও বর্জ্য পরিশোধনাগার থাকলে সকল বর্জ্যের গন্তব্য নদী হতো না।

বস্তুত বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও জনগণের চোখের সামনে নদী খুন হয়েছে। কেউ কিছু বলেনি। বলার হয়তো সাহস পায়নি। এখন কিছু কাজ শুরু হয়েছে। দখল হয়ে যাওয়া নদী পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। দূষিত নদীকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যদিও এই কাজগুলো শেষ পর্যন্ত দেশের নদীগুলো বাঁচাতে কতুটুক ভূমিকা রাখবে, সেটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তারপরও ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’।

মূলত মানুষের অতিরিক্ত লোভ; অল্প পুঁজিতে অধিক ব্যবসা; দ্রুত ধনী হওয়ার মানসিকতা এবং সর্বোপরি অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার অপসংস্কৃতির কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীই আজ সবচেয়ে বিপন্ন। বিপন্ন বলেই এখন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীকে আক্ষেপ করে বলতো হয়: ‘নদীর দেশে পানি কিনে খাই। মনে হয় বিদেশে আছি।’

তবে শিল্পী শাহাবুদ্দিন যে দেশে থাকেন, সেই ফ্রান্সের মানুষেরা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নদী দখল করে কল-কারখানা ও বাড়িঘর নির্মাণ করেন না। তারা নদীতে অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলেন না। ইউরোপের এই দেশে বাংলাদেশের মতো এত নদী থাকলে তাদের পুরো পরিবহন ব্যবস্থাই হতো নদীকেন্দ্রিক। প্রতিটি নদীকে সেই দেশের মানুষেরা মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন।

আমাদের সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যাকে বলা হয় ‘নদীমাতৃক’, অর্থাৎ নদী যার মা। কিন্তু সেই দেশের মানুষ তার মায়ের ওপর অত্যাচার চালায়। মাকে খুন করে। এমন আত্মঘাতী, এমন ‘জননীসংহারী’ সন্তান পৃথিবীতে বিরল। অতএব নদীমাতৃক দেশের মানুষেরা যতদিন না নদীকে তাদের ‘মা’ হিসেবে ভাবতে পারছে, ততদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের কোনও প্রকল্প, কোনও অভিযান নদীকে বাঁচাতে পারবে না।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রেশনে পণ্য চান শ্রমিকরা
রেশনে পণ্য চান শ্রমিকরা
অশ্রুসিক্ত হয়ে চেলসি ছাড়ার ঘোষণা ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের
অশ্রুসিক্ত হয়ে চেলসি ছাড়ার ঘোষণা ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের
বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-রিসোর্সের ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান ইউজিসি’র
বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-রিসোর্সের ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান ইউজিসি’র
নগরের তীব্র উত্তাপ কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনকে ছুঁতে পারে?
নগরের তীব্র উত্তাপ কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনকে ছুঁতে পারে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ