X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নদীর তালিকা বাতিল করুন

আমীন আল রশীদ
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:৫১আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:৫১

তালিকা নিয়ে আমাদের দেশে মাঝেমধ্যেই রাজনীতি, জটিলতা এবং তজ্জনিত উত্তেজনা তৈরি হয়।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল ২০১৯ সালে রাজাকারের তালিকা নিয়ে। আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ৫২ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ, দলনিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রাহ্য তালিকা করা সম্ভব হয়নি। বরং এখনও ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগের সংবাদ নিয়মিত গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়।

তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির আওতায় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ এবং তাঁদের সঙ্গে কোন কোন সাংবাদিকের নাম স্যাংশনের (নিষেধাজ্ঞা) তালিকায় রয়েছে—সেটি নিয়ে।

এ মুহূর্তে একটি অরাজনৈতিক বিষয়ের তালিকা নিয়েও দারুণ সমালোচনা হচ্ছে—যেটি আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক হলেও মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার এবং মার্কিন স্যাংশনের তালিকার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সেটি সরাসরি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেটি হচ্ছে দেশের নদীর তালিকা।

বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ—যাকে বলা হয় নদীমাতৃক। অর্থাৎ নদী যার মা। যে দেশটি গড়ে উঠেছে নদীর পলি জমে জমে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বদ্বীপ। সুতরাং নদী এই দেশের লাইফলাইন বা জীবনরেখা।

সৈয়দ শামসুল হক আমার পরিচয় কবিতায় লিখেছেন: ‘তেরোশত নদী শুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে’। এই যে তেরোশত নদীর কথা তিনি লিখলেন, এটি কি কেবলই সংখ্যা? এটি কি নিছকই অন্ত্যমিল? না। গবেষকরাও এ বিষয়ে একমত যে, এই দেশে একসময় তেরোশত বা তারও বেশি নদী ছিল।

রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা বলছে, ১৯৭২ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশে বারোশত নদী ছিল। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা বলছে, বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ৪০৫। তাহলে বাকি প্রায় আটশো নদী কোথায় গেলো—এই প্রশ্ন দীর্ঘদিনের।

২০০৯ সালে হাইকোর্টের আদেশে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করার পরে তারা নদীর সংখ্যা জানায় আটশোর কিছু বেশি। এরপর সারা দেশের জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং এসিল্যান্ডদের মাধ্যমে তালিকা সংগ্রহ করে গত আগস্ট মাসে দেশের নদীর একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করে কমিশন। সেখানে নদীর সংখ্যা ছিল ৯০৭। কিন্তু এই খসড়া তালিকা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিবাদ আসতে থাকে যে, অনেক নদীর নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। তারপর কমিশন আবার ওই তালিকা সংশোধন করে গত ২৪ সেপ্টেম্বর রবিবার বিশ্ব নদী দিবসে নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা নামে একটি বই প্রকাশ করে—যেখানে ১০০৮টি নদীর নাম রয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাবে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নদীর সংখ্যা এক হাজার ৮।

হাজার নদীর দেশ বলে খ্যাত বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা যে এক হাজারের বেশি, এটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এই হিসাবেই স্পষ্ট। কিন্তু তাতেও বিভ্রান্তি এড়ানো যায়নি। কেননা এই তালিকা প্রকাশের পরেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নদীরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা দাবি করেছেন যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ নদীর নাম এই তালিকায় নেই। অনেক আন্তঃসীমান্ত নদীর নাম এই তালিকায় নেই। এটি খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ ভবিষ্যতে তালিকায় নাম না থাকা আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের কোনও জটিলতার সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ ওই নদীর ব্যাপারে কোনও দাবি উত্থাপন করতে পারবে না। কেননা ভারত বা মিয়ানমার তখন নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা দেখিয়ে বলবে, তালিকায় এই নামে কোনও আন্তঃসীমান্ত নদী নেই।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নদীরক্ষা আন্দোলনের কর্মী ড. তুহিন ওয়াদুদ অভিযোগ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া অনেক নদীর নাম এই তালিকা নেই। উদাহরণ হিসেবে তিনি কুড়িগ্রামের রৌমারি উপজেলার ‘ধরনি’ নদীর নাম নেই বলে উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালে যে ‘কালো নদী’ পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মানকার চরে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছেন, অসংখ্য শরণার্থী যে নদীটি পার হয়েছেন, সেই নদীর নামও এই তালিকায় নেই। ভাওয়াইয়া গানে যে ‘তোরশা’ নদীর কথা বারবার এসেছে, সেই নদীটির নামও এই তালিকায় নেই। ‘বারোমাসি’ নামে একটা স্বাস্থ্যবান নদী তালিকায় নেই। ‘মালদহ’ নামে একটি আন্তঃসীমান্ত নদী তালিকায় নেই। সুতরাং ভারত যদি এই নদী থেকে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশ এর কোনও প্রতিকার পাবে কি না—সেই প্রশ্ন রাখেন তুহিন ওয়াদুদ।

প্রসঙ্গত, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এই তালিকাটি করেছে সারা দেশের স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে নদীর নাম নিয়ে। মুশকিল হলো, যাদের কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর সর্বনাশ সবচেয়ে বেশি হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন তাদের অন্যতম। তারাই নদীকে ব্যক্তির নামে লিখে দেয়। নদীকে খণ্ড খণ্ড করে পুকুর বানিয়ে প্রভাবশালীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেয় (উদাহরণ লালমনিরহাটের চাকিরপশার নদী)। হবিগঞ্জের ‘শুটকি’ নামে একটি নদী রাজা সাহেব নামে একজনের মালিকানায়। নদীর মালিক রাষ্ট্র, মানে জনগণ। অথচ এই দেশে নদীর মালিক ব্যক্তি! কারা ব্যক্তির নামে নদী লিখে দিলেন? যারা ব্যক্তির নামে নদী লিখে দেয়; যাদের প্রশ্রয়ে নদী দখল, ভরাট ও দূষিত হয়; যারা প্রভাবশালীদের সুবিধার্থে নদীর সীমানা কমিয়ে সেখানে পিলার বসায়, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে—তাদের কাছ থেকে নাম নিয়ে নদীর তালিকা করতে হলো কেন?

এটা ঠিক, নদী রক্ষা কমিশন কোনও খারাপ উদ্দেশ্যে বা কাউকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য হয়তো নদীর তালিকা করেনি। তাদের উদ্দেশ্য হয়তো মহৎ। কিন্তু এই মহৎ কাজটি করতে গিয়ে অসেচতনভাবেই তারা যে কিছু জটিলতার জন্ম দিলো, এ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। এই ইস্যুতে কালক্ষেপণের কোনও সুযোগ নেই।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উচিত তাদের নদীর তালিকাসম্বলিত বইটি প্রত্যাহার করে নিয়ে ওয়েবসাইটে নদীর নাম, দৈর্ঘ্য প্রস্থ, উৎস ও পতনমুখ ইত্যাদি তথ্য প্রকাশ করে এটিকে সাধারণ মানুষের মতামতের জন্য উন্মুক্ত রাখা। যখন মনে হবে যে কারো কোনও আপত্তি নেই বা যখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, দেশের ছোট বড় সকল নদীর নামই তালিকায় এসেছে; খাল নামে পরিচিত বড় জলধারাগুলোও যখন এই তালিকায় আসবে; যখন নদীগুলোর দৈর্ঘ্য প্রস্থ নিয়ে কারো কোনও সংশয় থাকবে না—তখনই কেবল এটিকে চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করে বই আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। কেননা, যত ভালো উদ্দেশ্যেই নদীর তালিকা করা হোক না কেন, দেশের একটি নদীও যদি তালিকার বাইরে থেকে যায়, তাহলে ওই নদীটি যদি প্রভাবশালীরা দখল করে নেয়, তখন আইনত ওই নদীতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। কারণ অফিসিয়ালি সেটি তখন নদী নয়। আপাতদৃষ্টিতে এরকম ছোটখাটো অনেক ব্যাপার নদীর তালিকার সঙ্গে যুক্ত।

রাজাকারের তালিকা করতে গিয়ে সরকার যেমন টের পেয়েছে এর কী জটিলতা; দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছর পরেও যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনগ্রাহ্য তালিকা করা সম্ভব হয়নি—তেমনি নদীর তালিকা নিয়েও যে জটিলতার সৃষ্টি হলো, তা থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ হলো এই তালিকাটিকে অসম্পূর্ণ ঘোষণা করে পুনরায় ওয়েবসাইটে দিয়ে নাগরিকের মতামত আহ্বান করা।

মোদ্দা কথা, নদীর তালিকা করার চেয়ে নদীর দখল দূষণ বন্ধ করা জরুরি। সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের নামে এবং নদীর জায়গা দখল করে কল-কারখানা নির্মাণ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নামে নদীর যে বারোটা বাজানো হয়েছে, সেটি বন্ধ করা জরুরি। সেই কাজে সরকার কতটা আন্তরিক এবং নদী রক্ষা কমিশন দেশের নদী রক্ষায় আদৌ কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে কি না; না পারলে তার কারণসমূহ চিহ্নিত করে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নিউ ইয়র্কে দুই বাংলাদেশি হত্যায় সন্দেহভাজন যুবক গ্রেপ্তার
নিউ ইয়র্কে দুই বাংলাদেশি হত্যায় সন্দেহভাজন যুবক গ্রেপ্তার
বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ
বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ
মহসিনকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত সাব্বির-কায়সার-বিপ্লবরা
মহসিনকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত সাব্বির-কায়সার-বিপ্লবরা
দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর
দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ