X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের জিনেও কি ফল্টলাইন আছে

মো. জাকির হোসেন
২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:৩৯আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:৩৯

ভূমিকম্পের যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে থাকা ফল্টলাইন। ভূত্বকের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে থাকা ফাটলকে ফল্টলাইন বলা হয়। গোটা পৃথিবীর ভূত্বক কয়েকটি ছোট-বড় প্লেটে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে সাতটা মহাদেশীয় প্লেট এবং বেশ কয়েকটি তুলনামূলক ছোট প্লেট।

ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্লেট এদের মধ্যে অন্যতম। এসব প্লেট স্থির নয়। খুব ধীরে হলেও এগুলো চলতে থাকে। যেমন ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্লেট একসময় আফ্রিকার কাছাকাছি ছিল। ধীরে ধীরে এটা এশিয়ার দিকে সরে আসে। চলতে চলতে কখনও একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কাও লাগে। আমাদের দেশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, এর কারণ টেকটোনিক প্লেট।

উপমহাদেশীয় প্লেটের সঙ্গে এশীয় প্লেটের সংস্পর্শ আর সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেই এত ভূমিকম্প এখন দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলে। টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জায়গায় যে ফল্টলাইন রয়েছে সেখানে ১৭৬২ সালে ৮.৫ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। এর ফলে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড তিন মিটার ওপরে উঠে আসে। এর আগে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। একই ভূমিকম্পে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে কঠিন শিলা ভেদ করে নিচ থেকে কাদা বালুর উদগীরণ হয়। এই ভূমিকম্পের কারণে বঙ্গোপসাগরে সুনামি হয়। এই সুনামির কারণে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বাড়িঘর ভেসে গিয়ে সে সময় ৫০০ মানুষের প্রাণহানি হয়।

২০১৬ সালে প্রকাশিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় একটি গোপন ফল্ট রয়েছে, যা বাংলাদেশে ৯ মাত্রার মতো ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রতিবেদনে গোপন এই ফল্টকে মেগাথার্স্ট ফল্ট নামে উল্লেখ করে বলা হয়, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পললের নিচে এই মেগাথার্স্ট অবস্থিত। এটি দুই প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত এই মেগাথার্স্ট। দুই প্লেটের সংযোগ স্থলে যে ভূমিকম্প হয় তা খুবই ভয়াবহ। ভূমিকম্পের জন্য পরিচিত রিং অব ফায়ার যেটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত সেটিও সাবডাকশন জোনের অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলে যে ভূমিকম্পগুলো হয় সেগুলোর বেশিরভাগই ৭.৫-এর ওপরে হয়ে থাকে। এগুলো শক্তিমত্তার দিক থেকে সবসময়ই ধ্বংসাত্মক। এ কারণে এই অঞ্চল নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তার বিষয়।

বিজ্ঞান বলছে, কোনও মানুষের আচরণ তার ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করে। কোনও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, অভ্যাস, রসানুভূতি, রুচি, চাল-চলন, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, মনোভাব, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, আবেগ, আগ্রহ ইত্যাদির সমন্বয়ে হলো ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো বংশগতি, দৈহিক গঠন, বুদ্ধি, ভৌগোলিক অবস্থা, জেন্ডার ইত্যাদি। আর পরিবেশগত উপাদান হলো পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রোমোজমে অবস্থিত জিনের মোলিকুলার কাঠামো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা প্রদান করে। জিন হচ্ছে বংশগত বৈশিষ্ট্যের বাহক।

আমাদের দৈহিক, মানসিক, নৈতিক, স্বভাবগত সব রকম সহজাত বৈশিষ্ট্যই জিনগুলোর ক্রিয়াকলাপের ওপর নির্ভর করে। সে কারণে সন্তানের চলাফেরা, আচার-আচরণ, দৈহিক গঠন পিতামাতার মতো হয়। কিছু বাঙালির আচরণ আমাকে কৌতূহলি করে তুলেছে, ভূত্বকের টেকটোনিক প্লেটের মাঝের ফল্টলাইন যেমন ভূমিকম্পের জন্য দায়ী, তেমনি আমাদের কিছু মানুষের জিনেও কি এমন ফল্টলাইন রয়েছে, যা রাষ্ট্র-সমাজ ধ্বংস করে। আমার মনে এমন কৌতূহল কেন হলো?

কিছু ঘটনা আমার মনে এমন প্রশ্নে অবতারণা করেছে –

এক. আন্দোলনের নামে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে মা-শিশুপুত্রসহ চার জনকে পুড়িয়ে মারার নৃশংস দৃশ্য আমাদের লোভের ও লাভের রাজনীতির নগ্নরূপের আরেকটি প্রকাশ। পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের দৃশ্য বোধকরি শিশুসন্তানকে বুকে জড়িয়ে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে মা-শিশুর পুড়ে কয়লা হওয়া। নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করতে টাকার বিনিময়ে লোক ভাড়া করে কিংবা পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে বাসে, ট্রেনে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারে মানুষ।

নির্বাচন প্রতিহত করতে ও ব্যর্থ হয়ে প্রতিহিংসায় একইরূপ ঘটনা ঘটানো হয়েছিল ২০১৩-২০১৫ সালে। ওই সময় পেট্রোলবোমায় স্বামী-সন্তান হারানো মাশরুহা বেগম বলেন, ‘স্বামী ও কোলের শিশু মাইশা নাহিয়ানকে নিয়ে বাসে যাচ্ছিলাম। পেট্রোলবোমায় চলন্ত বাসে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায়। আমার স্বামী ধাক্কা দিয়ে আমাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। কিন্তু চোখের সামনে স্বামী ও সন্তানকে হারাই। আমার বেঁচে থাকা দুঃস্বপ্নের মতো, এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে?

নির্বাচন বর্জনের ঘটনা বাংলাদেশেই প্রথম নয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এরূপ বর্জনের ঘটনা স্বাভাবিক। সমসাময়িক বিশ্বে বিরোধী দল কর্তৃক প্রথম নির্বাচন বর্জনের ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সাধারণ নির্বাচনে। এরপর রেফারেন্ডাম, জাতীয় সংসদ কিংবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উত্তর আয়ারল্যান্ড, গায়ানা, নামিবিয়া, জ্যামাইকা, দক্ষিণ আফ্রিকা (পর পর দুটি নির্বাচন), বুরকিনা ফাসো, ঘানা, টোগো, মালি, ইয়েমেন, স্লোভাকিয়া, সার্বিয়া (দুটি নির্বাচন), আলজেরিয়া (দুটি নির্বাচন), আইভরি কোস্ট (দুটি নির্বাচন), সাবেক যুগোস্লাভিয়া, মন্টিনেগ্রো (দুটি নির্বাচন), গাম্বিয়া (দুটি নির্বাচন), আজারবাইজান, গিনি, ভেনিজুয়েলা (চারটি নির্বাচন), থাইল্যান্ড (দুটি নির্বাচন), জিবুতি, হাঙ্গেরি, পুয়ের্তোরিকো, স্পেন, কেনিয়া, মিসর, রাশিয়া, মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া, তিউনিশিয়া, ইরান, হংকং, কসোভো ও পোল্যান্ডের নির্বাচন বয়কট করেছে বিরোধী দল।

২০২৩ সালেও কসোভো ও পোল্যান্ডের নির্বাচন বয়কটের ঘটনা ঘটেছে। এসব দেশের বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের অন্যতম কারণ ছিল নির্বাচনে কারচুপি-জালিয়াতি, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক আচরণ, নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের বৈধতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধীদের পার্থক্য হলো, ওই সব দেশে নির্বাচন প্রতিহত করতে বর্জনকারীরা সহিংসতা করেনি। গাড়ি পুড়িয়ে, বাসে-ট্রেনে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে, ট্রেন লাইন কেটে মানুষ হত্যা, প্রিজাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা কিংবা ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়ে নারকীয় তাণ্ডব করেনি। কোনও মানুষের ভালো-খারাপ কি জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে হয়, নাকি পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের জন্য হয়, এ নিয়ে বিরাট বিতর্ক রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ত্রুটিপূর্ণ জিনের কারণে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে কারও কারও স্নায়ুর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়, যা সহিংসতার জন্ম দেয়।

দুই. কোনও কোনও দল বিজয় দিবসের র‌্যালি করে। কিন্তু যার অতল ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের দুর্গম পথ বেয়ে এই বিজয় অর্জিত হয়েছে জাতির সেই প্রাণভোমরা, রাষ্ট্রের স্থপতিকে তারা স্বীকার করে না। এটি জাতির সঙ্গে ভয়ংকর প্রতারণা। যুগ যুগ ধরে বাঙালি স্বপ্ন দেখেছে নিজেদের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ঠিকানার।

একবারের জন্য পাওয়া জীবনের সবটুকু বিলিয়ে দিতে পারে এমন একজন মুজিবের দেখা পায়নি বাঙালি বহু যুগ, আর তাই স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন কল্পনার কারাগারেই ছটফট করেছে। অবশেষে জন্ম হলো শেখ মুজিবের। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য দুই যুগ ধরে প্রস্তুত করলেন তিনি বাঙালিকে।

অবশেষে এলো বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিজয় অর্জনের দীর্ঘ সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে রয়েছে অনেক মাইলফলক, যে পথ বেয়ে এসেছে পরম আরাধ্য বিজয়। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ এবং ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই মাইলফলকের সব কয়টিতেই রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ওতপ্রোত সম্পৃক্ততা।

একটি স্বাধীন দেশের জন্য তিনি ৪,৬৮২ দিন কারাবরণ করেছেন, যা তাঁর জীবনের এক-চতুর্থাংশ। একাধিকবার মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ইতিহাসের এসব বাঁকবদল আমাদের নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস। এর কোনোটিকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে বিশ্বাসী হওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন। কিন্তু বিএনপি ও তাদের মিত্ররা এর কিছুই মানে না। অধিকন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবমাননা করতে স্লোগান দেয়। বিএনপির সমাবেশে মৌসুমি নামে বিএনপি গান গায় ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’। এই গান শুনে বিএনপির নেতাকর্মীরা উল্লসিত হয়, গলা মেলায়, হাততালি দেয়। জিনের ফল্টলাইনের কারণে কিছু মানুষ কি রাষ্ট্রের স্থপতির প্রতি এমন কৃতঘ্ন হয়? অবমাননাকর স্লোগান দেয়, গান গায়?

তিন. সত্য-অসত্য মিলিয়ে বিএনপি তার নেতাকর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে সোচ্চার। বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা বিএনপির নেতাকর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে কেবল বিবৃতি প্রদান নয়, বিদেশিদের ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সর্বত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বিএনপি ও তার পোষ্য বুদ্ধিজীবী-সুশীলরা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার মানবাধিকার বিষয়ে নিশ্চুপ।

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পিতা, মাতা, ১০ বছরের শিশু রাসেলসহ তিন ভাই, পঙ্গু চাচা ও নিকট আত্মীয় মিলে ২৬ জনকে হত্যা করা হয়। খুনি ফারুক, রশিদ বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা টেলিভিশন ও পত্রিকার সাক্ষাৎকারে ও মামলার সাক্ষ্যে সুস্পষ্টভাবে দিন, তারিখসহ বলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে জিয়ার সঙ্গে কি কথা হয়েছে তাও খুনিরা বলেছে। টেলিভিশন ও পত্রিকায় খুনিদের সাক্ষাৎকার জিয়ার জীবদ্দশায় প্রচারিত হয়েছে। খুনিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস জিয়াকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। জিয়া সব জেনেশুনে খুনিদের দূতাবাসে চাকরি-পদোন্নতি দিয়েছেন।

জাতির পিতাসহ ২৬ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যার বিচার করা যাবে না মর্মে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেছিলেন খুনি মোশতাক। অবৈধ রাষ্ট্রপতি মোশতাক কর্তৃক সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি দায়মুক্তি অধ্যাদেশ শুরু থেকেই বাতিল ছিল। তদুপরি সংবিধানে বলা হয়েছে, কোনও অধ্যাদেশ জারির পর প্রথম যেদিন সংসদ অধিবেশন বসবে সেই অধিবেশনে তা উত্থাপন করা না হলে কিংবা উত্থাপনের পর অনুমোদন না হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল হয়ে যাবে।

মোশতাক রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন মাত্র ৮৩ দিন। মোশতাকের অপসারণের পর দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করা যেত। কিন্তু জিয়া দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল দূরে থাক, খুনিদের বাঁচাতে অধ্যাদেশকে সংসদে উত্থাপন করে এটিকে সংসদের আইনে পরিণত করেন। পরবর্তীতে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। বিএনপি ও তার মিত্র বুদ্ধিজীবী-সুশীলরা বিএনপি নেতৃবৃন্দের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উচ্চকিত এটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বিচার পাওয়ার মানবাধিকার বিষয়ে তাদের মুখে কুলুপ আঁটা। উপরন্তু, বিএনপির ১৫ আগস্টের পুনরাবৃত্তির স্লোগান ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ তথা হত্যাকাণ্ডের হুমকির বিষয়েও বিএনপির বুদ্ধিজীবী-সুশীলরা নীরব। জঙ্গি, বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রযন্ত্র মিলে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। দলের সভানেত্রীকে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। নরমেধ যজ্ঞের বিচার বন্ধে দায়মুক্তির নতুন স্টাইল জজ মিয়ার মিথ্যা গল্প সাজিয়েছে। এতে কি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়নি?

২০১৩ থেকে শুরু করে এখনও বাসে-ট্রেনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, ট্রেনলাইন কেটে ফেলে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, এসব নির্মম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট নষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সুশীলদের মুখে রা নেই। কিন্তু তফসিল বাতিল করে, সংসদ বিলুপ্ত করে পুনরায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে তারা একের পর এক বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। শত শত সেনা সদস্যকে প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে জিয়ার শাসনামলে।

স্বজনের কাছে লাশও হস্তান্তর করা হয়নি। কোথায় তাদের দাফন করা হয়েছে সে তথ্যও স্বজনদের জানানো হয়নি। এটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করে না বিএনপি ও তাদের বুদ্ধিজীবী-সুশীলরা। এক দলের মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার আর অন্যদের মানবাধিকার নিয়ে নির্বিকার হওয়ার জন্য কি জিনের ফল্টলাইন দায়ী?

চার. খুনি মোশতাক অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তিন মাসেরও কম সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে বেতার ও টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।’

নির্বাচন দেওয়া হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসবে সেই আশঙ্কা থেকে বিচারপতি সায়েমকে দিয়ে নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণা দেন জিয়া। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর বেতার ও টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। নির্বাচন স্থগিতের পর ২৮ নভেম্বর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব তার বরাবরে ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। অনেক বাগবিতণ্ডার পর রাত একটায় সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তরের কাগজে সই করেন। এর মধ্য দিয়ে মধ্যরাতে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাতে বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন জিয়া।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লিখেছেন, পিস্তল ঠেকিয়ে সায়েমের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন জিয়া। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকার বঙ্গভবনে একই নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন হয়। বিচারপতি সায়েম তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে ‘At Bangabhaban: Last Phase’ গ্রন্থে লিখেছেন, “রাত ১১টায় বুটের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। সেনাপ্রধান জিয়া অস্ত্রশস্ত্রসহ বঙ্গভবনে আমার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করেন। জিয়াউর রহমান আমার বিছানায় তার বুটসহ পা তুলে দিয়ে বলেন, সাইন ইট। তার এক হাতে ছিল স্টিক, অন্য হাতে রিভলবার। আমি কাগজটা পড়লাম। আমার পদত্যাগপত্র। যাতে লেখা ‘অসুস্থতার কারণে আমি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলাম’। আমি জিয়াউর রহমানের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আট-দশ জন অস্ত্রধারী আমার বিছানার চারপাশে অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিয়া আবার আমার বিছানায় পা তুলে আমার বুকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে বললেন, সাইন ইট। আমি কোনোমতে সই করে বাঁচলাম।” এরপর ওই বছরই প্রহসনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করেন জিয়া। নির্বাচনে জিয়াই একমাত্র প্রার্থী ছিলেন। ব্যালট পেপারে লেখ ছিল, ‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বি,ইউ এবং তাঁর অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি আপনার আস্থা আছে কি? হ্যাঁ, না।’ ভোটকেন্দ্রে স্বল্পসংখ্যক ভোটার উপস্থিত হলেও উপস্থিতির হার দেখানো হয় ৮৮.১ শতাংশ। আর প্রদত্ত ভোটের ‘হ্যাঁ’ অর্থাৎ জিয়ার পক্ষে দেখানো হয় ৯৮.৯ শতাংশ।

ভয় দেখিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বিদেশি গণমাধ্যমগুলো ভোট চুরির ঘটনা ফলাও করে প্রচার করেছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে বলা হয়েছিল, নির্বাচনে কোথাও কোথাও ১১০-১২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সামরিক শাসন জারি রেখে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। তদুপরি নির্বাচনে জিয়ার প্রার্থী হওয়াও ছিল বেআইনি। বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্টের ২৯২ ও ২৯৩ বিধিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনীর কোনও সদস্য তার চাকরির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সামরিক বাহিনীতে সেনাপ্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে জন্য হ্যাঁ/না ভোটে প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। আইনগতভাবেই জিয়া ছিলেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি। অথচ বিএনপি ও তার মিত্রদের কাছে জিয়া গণতন্ত্রের পথিকৃত।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সংলাপের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে বিএনপি ও তার মিত্ররা বর্জন করেছে। ২৯টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। অথচ বিএনপি ও তার মিত্ররা একে একতরফা নির্বাচন আখ্যায়িত করে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। একমাত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে জিয়ার রাষ্ট্রপতি হওয়াকে বিএনপি গণতন্ত্র বলছে আর ছোট-বড় ২৯ দলের নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে প্রতিহত করতে অরাজকতা, সহিংসতা ও নাশকতা করছে। তথাকথিত অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।

কোনও মানুষের ভালো-খারাপ কি জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে হয়, নাকি পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের জন্য হয়, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এসব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, গবেষণা এখনও চলছে। আপাতত গবেষকদের অনেকে এ সিদ্ধান্তে এসেছেন যে কোনও ব্যক্তির অপরাধপ্রবণতার ওপর জিন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, দুয়েরই প্রভাব রয়েছে। জিনের কারণে যার খারাপ মানুষ হওয়ার কথা, তিনি হয়তো শুধু সুন্দর পরিবেশের প্রভাবে সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। আবার জিনগত বৈশিষ্ট্য ভালো হওয়া সত্ত্বেও খারাপ পরিবেশের কারণে কাউকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখা গেছে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ