X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফের হেফাজতে মৃত্যু: প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর কি জানা?

আমীন আল রশীদ
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:১১আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:১১

নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু রোধে দেশে একটি শক্তিশালী আইন থাকলেও এই ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। তবে এবার পুরান ঢাকার একজন বডিবিল্ডার পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়ার পরে পুলিশের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ এনেছেন তার স্ত্রী।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ চেয়েছে। না হলে পুলিশকে খুশি করতে বলেছে। পুলিশ কীভাবে খুশি হতে চেয়েছে বা ওই ভুক্তভোগী নারীকে পুলিশ কী বোঝাতে চেয়েছে—সেটি খুলে বলার কোনও প্রয়োজন নেই। যদি ওই নারীর অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে এটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এটি নিরাপত্তা হেফাজতে কাউকে মেরে ফেলার চেয়ে কম অপরাধ নয়।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোড থেকে ফারুক নামে একজন বডিবিল্ডারকে আটক করে পুলিশ। পরে কায়েতটুলী ফাঁড়ি ও বংশাল থানায় নির্যাতনে তার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ করছে তার পরিবার। পুলিশ নিহত ফারুককে মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করলেও পরিবারের অভিযোগ, তার পকেটে গাঁজা দিয়ে পুলিশ ফাঁসিয়েছে।

পকেটে ইয়াবা বা এরকম মাদক নিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে এর আগেও উঠেছে। যাদের এরকম মাদক দিয়ে ধরা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো প্রকৃতই মাদক ব্যবসায়ী। তথ্য-প্রমাণের অভাবে ধরা কঠিন বলে পুলিশ কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীর পকেটে মাদক দিয়ে তাদের আটক করে—এরকম কথাও শোনা যায়। কিন্তু যাদের এভাবে আটক বা গ্রেফতার করা হয়, তাদের সবাই কি মাদক ব্যবসায়ী? পুলিশ কি সবসময় মাদক দমনের অংশ হিসেবে এ ধরনের আটক করে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকে?

নিহত ফারুক পুরান ঢাকার যে খাজে দেওয়ান এলাকায় বসবাস করতেন, সেখানকার বাসিন্দারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ফারুক ভালো ছেলে। কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাটিও ছিল না। মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পুলিশ দাবি করলেও সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাছাড়া পুলিশ নিহত ফারুককে মাদক ব্যবসায়ী বললেও গণমাধ্যমের খবর বলছে, তার বিরুদ্ধে থানায় কোনও মামলা বা অভিযোগ নেই।

ফারুকের স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে পুলিশ প্রথমে এক লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিল। পরে দেওয়া হয় কুপ্রস্তাব। তার ভাষায়: ‘কায়েতটুলীর পুলিশ এক লাখ টাকা চাইছে আমরা স্বামীকে ছাড়ার জন্যে। পরে বলে আপনি আমাদেরকে খুশি করেন, আমরা আপনার স্বামীকে ছেড়ে দেবো।’

শুধু তাই নয়, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিতে এই পরিবারকে অপরিচিত নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও নির্যাতন চালিয়ে ফারুককে হত্যা এবং তার স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।

তাদের দাবি, ফারুকের ‍মৃত্যু হয়েছে থানা থেকে জেলখানায় পাঠানো পরে। অবশ্য পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরেই চরম নির্যাতন করেছে। এর ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে।

এ ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে ডিএমপির লালবাগ বিভাগ। প্রশ্ন হলো, পুলিশের পক্ষে তার নিজের বাহিনীর লোকদের বিরুদ্ধে সঠিক, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা কি আদৌ সম্ভব? সঠিক ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত ছাড়া কি ঘটনার সত্যতা জানা যাবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, যে বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই বাহিনীর লোকেরাই কেন অভিযোগের তদন্ত করবে? এই তদন্ত কতটা সঠিক ও প্রভাবমুক্ত হবে?

প্রতিটি ঘটনার পরে, অর্থাৎ হেফাজতে কারও মৃত্যুর পরে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়, সেটিও গৎবাঁধা এবং অনেক সময়ই সেসব বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

গত ডিসেম্বর মাসে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চুরির অভিযোগে পুলিশের হাতে আটকের কয়েক ঘণ্টা পরে থানা হেফাজত থেকে রাব্বানী নামে একজনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের দাবি, রাব্বানী নিজের গেঞ্জি ও বেল্ট দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তার স্বজনদের অভিযোগ, গোলাম রাব্বানীকে থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ। তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল।

প্রসঙ্গত, থানার হাজতখানায় সাধারণত ফ্যান থাকে না। আর থাকলেও তা বেশ উঁচুতে এবং কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়া সেটির কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এরপরও হাজতখানার ভেতরে বা বাইরে পুলিশসহ আরও লোকজন থাকার কথা। সুতরাং কীভাবে একজন লোক থানার ভেতরে নিজের গেঞ্জি ও বেল্ট দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করলেন, তা স্পষ্ট নয়।

মোটামুটি একই সময়ে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে আনোয়ার হোসেন নামে একজন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে থানা হাজতে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। স্বজনদের প্রশ্ন, পুলিশ সুস্থ অবস্থায় আনোয়ারকে ধরে নিয়ে গেছে। এমন কী হলো যে রাতেই তিনি মারা গেলেন? প্রসঙ্গত, একটি মারামারি মামলায় পুলিশ আনোয়ারকে গ্রেফতার করেছিল।

ধরা যাক, পুরান ঢাকার ফারুক সত্যিই মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। হবিগঞ্জের রাব্বানী চোর ছিলেন। আনোয়ার মারামারি করেছেন। তারপরেও কি তাদের থানায় নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে মেরে ফেলার অধিকার পুলিশের আছে?

পুলিশ বা অন্য যেকোনও বাহিনীর বিরুদ্ধে যেকোনও অপরাধের অভিযোগ উঠলে তাদের শীর্ষ ব্যক্তিরা একই কথা বলেন, ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না এবং অপরাধের তদন্ত হচ্ছে। দোষী যেই হোক তার শাস্তি হবে। প্রশ্ন হলো, বাহিনীর মধ্যে যদি দুর্নীতির বীজ রোপিত থাকে; যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি থাকে; যদি অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে; যদি বাহিনীর বিরাট অংশই কোনও না কোনোভাবে অপরাধ ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী কেন নেবে না? বাহিনীর কোনও একজন বা দুজন সদস্য অপরাধ করার সুযোগ বা সাহস কোথায় পাচ্ছে? কোনও একটি বাহিনী যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং তাদের দিয়ে যদি নানা ধরনের অপরাধ করানো হয়, তাহলে সেই বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনও অভিযোগের বিষয়ে সরকারও কি কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে?

হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু রোধে দেশে একটি শক্তিশালী আইন থাকার পরেও যে এই ঘটনা কমছে না, তার মানে কি আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না, নাকি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো এই আইনকে পাত্তা দিচ্ছে না?

এযাবৎ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর যত অভিযোগ উঠেছে, তার মধ্যে কতটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়েছে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, কতজন ভুক্তভোগী পুলিশ বা অন্য কোনও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বা করার সাহস পায়? পুলিশ বা অন্য কোনও বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বা মামলা দায়ের করে সেটি চালিয়ে নেওয়া কি খুব সহজ?

বলা হয়, পুলিশের রোষানলে কেউ পড়লে তার নিজের জীবন তো বটেই, পুরো পরিবারও তছনছ হয়ে যায়। একটি বাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে যে এই পারসেপশন তৈরি হলো, সেরকম পরিস্থিতিতে এই বাহিনীর কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ উঠলেও সেই অভিযোগটি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ের করে এর শেষ দেখার সাহস, ধৈর্য, আর্থিক ও সামাজিক সক্ষমতা কতজনের রয়েছে? বিশেষ করে রাজনৈতিক বিভিন্ন মামলায় আটক বা গ্রেফতার হওয়ার পরে যারা হেফাজতে নির্যাতনে মারা গেছেন, সেসব নিহতের পরিবারের পক্ষে এই ধরনের অভিযোগ দায়ের করে অপরাধ প্রমাণ করা আরও কঠিন।

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আগে কারাগারে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার মৃত্যু হয়। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ, তাদের নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে কারাগারে বিএনপির অন্তত সাত জন নেতার মৃত্যু হয়েছে। (আজকের পত্রিকা, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩)।

প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যুগুলোর একটিও কি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব? যদি না হয় তাহলে কি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হেফাজতে অপরাধী এবং নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব? আর একজন অপরাধীকেও কি কোনও বাহিনী নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতে পারে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, যে কাউকে আটক বা গ্রেফতারের পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি। এটা অনেকটা মুক্তিপণ আদায়ের মতো। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কি এই ধরনের মুক্তিপণ আদায় করতে পারে?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর
দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর
ওষুধের দাম নিয়ে যে নির্দেশ দিলেন হাইকোর্ট
ওষুধের দাম নিয়ে যে নির্দেশ দিলেন হাইকোর্ট
বাসচাপায় মাইক্রোবাসের ২ যাত্রী নিহত
বাসচাপায় মাইক্রোবাসের ২ যাত্রী নিহত
মুশফিকদের বন্ধু ফুটবলার হীরকের অকস্মাৎ মৃত্যু
মুশফিকদের বন্ধু ফুটবলার হীরকের অকস্মাৎ মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ