X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

রোমান সানা, সুরো কৃষ্ণ, সিদ্দিকুরদের আক্ষেপ করতে হবে কেন?

তানজীম আহমেদ
০৮ মার্চ ২০২৪, ১৭:১২আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪, ১৭:১২

স্বাধীনতার ৫৩ বছর হয়েছে। একটি দেশ পরিণত হয়েছে। তারপরও  হতাশা পিছু ছাড়ছে না। অনেক জায়গায় আমরা সফল হলেও স্পোর্টিং কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের নাম বিশ্বদরবারে সেভাবে জায়গা করেছে কোথায়? একমাত্র ক্রিকেট ছাড়া বৈশ্বিক অন্যান্য খেলায় বেশ পিছিয়ে। মাঝে মধ্যে অন্য খেলাগুলোতে ঝলক দেখালেও তা এগিয়ে নেওয়ার দিকে কর্তৃপক্ষের মনোযোগ কম। বরং চারদিকে হাহাকার, আক্ষেপ আর বঞ্চনার কাহিনি আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অবস্থা হলো, ক্রিকেট ছাড়া বাকি সব খেলার চেহারা অনেক করুণ। যারাই অবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো করছেন তারা আবার না পাওয়ার বেদনায় পুড়ছেন। সদ্য তিন তারকা ক্রীড়াবিদ মিডিয়ার কাছে নানান বিষয় নিয়ে নিজেদের হতাশার পাশাপাশি রাগ-ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। নতুন করে অবহেলা-বঞ্চনার কথা নিয়ে এসেছেন সামনে।

প্রায়ই এমনটি হয় অবহেলিত ক্রীড়াবিদরা নিজেদের দুঃখের কথা নানান সময়ে বলে বেড়ান। এতে যদি কর্তৃপক্ষের একটু হলেও টনক নড়ে। তাতে সাময়িক কাজ হলেও স্থায়ীভাবে কোনও কিছু দাঁড়ায়নি। এবার পেশাদার বক্সার সুরো কৃষ্ণ থেকে শুরু করে গলফার সিদ্দিকুর ও আর্চার রোমান সানা নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা নতুন করে জানান দিয়েছেন। শুধু নিজেদের জন্য নয়। ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে থাকার জন্য এখনই যেন কিছু একটা করা হয়, সেটাই তাদের আর্জি কিংবা দাবি।

প্রশ্ন হলো, একজন রোমান সানা কিংবা সুরো কৃষ্ণ কিংবা সিদ্দিকুর রহমানদের ক্যারিয়ার কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে কেন? যারা দেশের জন্য খেলছেন, সাফল্য বয়ে আনছেন, আরও আনার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, তাদের তো সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত।

এক রোমান সানা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নতুন করে চিনিয়েছেন। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতে টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলেছেন। এমন অর্জন বাংলাদেশের কজন করতে পেরেছে? বিশ্বদরবারে লাল-সবুজের হয়ে এমন কীর্তি চাট্টিখানি কথা নয়। এছাড়া তার ঝুলিতে ২৬টির মতো আন্তর্জাতিক পদকই রয়েছে। এর মধ্যে এক ডজনের মতো সোনার পদক! সেই রোমানের বেতন যদি হয় মাসে সর্বসাকুল্যে ৩০ হাজার টাকা তাহলে সে স্ত্রী-বাবা-মাসহ অন্যদের নিয়ে চলবে কী করে? এ নিয়েই হতাশাগ্রস্ত হয়ে রাগে-দুঃখে ২৮ বছর বয়সী আর্চার সমাজের দিকে আঙুল দেখিয়ে লাল-সবুজ দল থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

পেশাদার বক্সার হিসেবে সুরো কৃষ্ণ এখন পর্যন্ত যত  ম্যাচ খেলেছেন সবকটিতে জিতেই চলেছেন। বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত কিংবা থাইল্যান্ডের বক্সারদের পাঞ্চে কুপোকাত করে যাচ্ছেন। দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে দূত হয়ে একের পর এক জয় করে নতুন করে চেনাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পরও সুরো কৃষ্ণের সরকারি বা বেসরকারি সম্মানজনক কোনও চাকরি নেই। নিজের চেষ্টায় এতদূর এগিয়ে এসেছেন। একটা স্থায়ী চাকরির জন্য নিজে হন্যে ঘুরে বেড়ালেও কোথায় কোনও আশার আলো নেই। তারপরও পেশাদার বক্সিংয়ের সঙ্গে লেগে আছেন। যদি একসময় কিছু হয়।

গলফার সিদ্দিকুর তো দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বেরিয়ে এখন বড় তারকা। গলফ খেলে নিজে আপাতত স্বাবলম্বী হয়েছেন। অলিম্পিকে সরাসরি খেলা বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ তিনি। রোমান সানা দ্বিতীয়। তারপরও অর্থচিন্তায় কাবু হতে হয় তাকে।

পারফরম্যান্সের উত্থান-পতন হলেই তাকে আর্থিক সংকট ঘিরে ধরে। বিশেষ করে প্রতিবছর তার অনুশীলনের জন্য কোটি টাকার প্রয়োজন হয়, যা তিনি নিজেই বহন করে থাকেন। দেশের জন্য খেলে সরকার কিংবা বেসরকারি থেকে কোনও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা নেই বললেই চলে।

কিছু দিন আগে বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিকসে পদক পাওয়া জহির রায়হান ও মাহফুজুর রহমান দেশে ফিরে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কথা জানিয়ে হাহাকার করেছেন। সেই সঙ্গে শক্ত আর্থিক অসহায়ত্ব তো আছেই।

শুধু কী তারাই। অন্য ডিসিপ্লিন নিয়েও সমান হতাশা। দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টাররা খেলছেন, কিন্তু কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এরপরও তারা খেলছেন মনের আনন্দে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্ক মেলাতে গেলে হতাশা ছাড়া আর কিছুই পান না গ্র্যান্ডমাস্টাররা। এমন দুরবস্থা অন্য জায়গাতেও।

আসলে সবকিছুই তাদের পারফরম্যান্সকে সামনের দিকে নেওয়ার জন্য। একজন খেলোয়াড় দেশের জন্য খেলছেন। পদকও নিয়ে আসছেন। যখন বয়স হয়ে যাবে কিংবা দেওয়ার কিছু থাকবে না তখন তাদের কে দেখবে? তাদের সবার না আছে শক্ত ভিত না আছে আর্থিক সামর্থ্য। তাই রোমান সানা-সুরো কৃষ্ণরা চাইছেন দেশ তাদের জন্য কিছু একটা করুক। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের চিন্তা করতে না হয়।

প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকালে আমাদের ক্রীড়াবিদদের আফসোস হয় বেশি। সেখানে ক্রীড়াবিদদের অন্তত বেঁচে থাকা কিংবা জীবন ধারণের জন্য অর্থের চিন্তা করতে হয় না। সরকার বা বেসরকারিভাবে চাকরির সংস্থান রয়েছে। ছোট থেকে তাদের গড়ে ওঠার সময়ও সঙ্গী হিসেবে পান পৃষ্ঠপোষকদের। তাদের সঙ্গে যখন আন্তর্জাতিক মিটে দেখা হয় তখন রোমান কিংবা সুরো কৃষ্ণসহ অন্যদের কষ্টটা বেশি অনুভব হয়। অসহায় বোধ করেন।

তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশে ক্রীড়াবিদদের একদম পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না বললে ভুল বলা হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কেউ একটু ভালো করলেই আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ফুটবলাররা জমি পেয়েছিলেন। এছাড়া এসএ গেমসে সোনার পদক পাওয়া মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, মাহফুজা খাতুন শীলা ও কমনওয়েলথ গেমসে রুপাজয়ী শাকিল আহমেদ ফ্ল্যাট পেয়েছেন। দেরিতে হলেও আরেক এসএ গেমস জয়ী সোনাজয়ী শারমিন আক্তারও পেয়েছেন ফ্ল্যাটের সমপরিমাণ অর্থ।

এছাড়া নানাভাবে দুস্থ ও অসহায় ক্রীড়াবিদরা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে আসছেন।

এছাড়া দেশের ক্রীড়াঙ্গন বেঁচে আছে সার্ভিসেস বাহিনীর মাধ্যমে। তাদের অধীনে হাজারও ক্রীড়াবিদ চাকরি করে থাকেন। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা হলো সাধারণ ক্রীড়াবিদরা কষ্টে সৃষ্টে বেঁচে আছেন। খেলছেন। কিন্তু যারা একটু ভালো করছেন তাদের সুযোগ সুবিধা কমই। রোমান সানা কিংবা জহির কিংবা সুরো কৃষ্ণের বেলায় তা বলাই যায়। তারা চাইছেন দেশের ক্রীড়াবিদদের জন্য নীতিমালা। দেশের জন্য পদক তৈরিতে অ্যাথলেটদের সেভাবে পরিচর্যা করা, পদক জিতলে অর্থ পুরস্কার, সম্মানজনক চাকরির নিশ্চয়তা এবং চোটে পড়লে চিকিৎসার ব্যয়ভার নেওয়াসহ অন্য সবকিছু যেন ঠিক থাকে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রীড়াবান্ধব। তার মতো ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী আগে কখনও পায়নি এদেশ। ক্রীড়াবিদদের বিশ্বাস, তিনিই পারবেন ক্রীড়াবিদদের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করতে।

প্রধানমন্ত্রী এবার ক্রীড়ার দায়িত্ব দিয়েছেন নাজমুল হাসান পাপনকে। তিনি বসেছেন সব ফেডারেশনের সঙ্গে। তাদের সমস্যা শুনেছেন, সমাধানের পথও খুঁজছেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার কথা বলেছেন তিনি। তার দিকেই চেয়ে আছেন ক্রীড়াবিদরা। তার ম্যাজিকেই যদি ছোট খেলার অ্যাথলেটদের ভাগ্য বদলায়।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ