X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

অবন্তিকাদের ভালোবেসে পাশে থাকা জরুরি

ড. রাশেদা রওনক খান
১৯ মার্চ ২০২৪, ২০:০৫আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪, ২০:৩১

আমরা মানুষ হিসেবে খুবই বিচিত্র। বেঁচে থাকতে মানুষকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও কেউ মারা গেলে শোক করার সময় না নিয়ে বরং কেন, কীভাবে, কী পরিস্থিতিতে মারা গেলেন তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই করি। সাদি মহম্মদ কিংবা অবন্তিকা, দুটো স্বেচ্ছামৃত্যুই আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে, আপনাদেরও কি একইভাবে ভাবাচ্ছে?

দুটো বিষয় খুব ভিন্ন, আবার খুব অভিন্নও ঠেকছে আমার কাছে। একজন আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের খ্যাতনামা শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী,  অন্যজন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম স্থান অধিকার করা শিক্ষার্থী। দুজনেই যার যার জায়গায়, যার যার পরিসরে সেরা!

দুজনের প্রাপ্তি, বয়স, অবস্থান কিছুতেই তুলনা করার কিছু নেই, তবে দুজনের ঝুলিতেই সাফল্য রয়েছে, অবশ্য সেই সাফল্যের সংজ্ঞা সমাজ দ্বারা সংজ্ঞায়িত। তাদের কাছে সাফল্যের সংজ্ঞা হয়তো ভিন্ন রকমের কিছু। দুজনের কাজের সীমা, ব্যাপ্তি, আগ্রহ, পরিচিতি, চিন্তাভাবনা– কোনও কিছুই এক নয় কিন্তু কোথায় যেন এক সুরে, এক সুতোয় বাঁধা বলেই একভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।

পরপর দুটি ঘটনা ঘটে যাওয়ায় অনেকেই আত্মহত্যাকে নানানভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তবে আমার বিশ্লেষণটা কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক ও নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করার চেষ্টা করছি।

আজকাল কারও মৃত্যু হলে শোক পালনের চেয়ে শোরগোল হওয়ার যে বিষয়টি তা হয়তো বা জাস্টিফাইড হতো, যদি এই আত্মহত্যার পেছনে আমাদের নিজেদেরও যে ভূমিকা আছে, তা দেখার চেষ্টা করতাম। ‘আমরা’ বলতে আমাদের এই সমাজ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী, সহপাঠী, শিক্ষক, প্রশাসন, জানাশোনা মানুষজন, চারপাশ ও আমাদের জাজমেন্টাল মন-মানসিকতা। আমরা কি কোনোভাবে নিজেদের দোষী ভাবি? কেনই বা ভাবা দরকার? চলুন মিলিয়ে দেখি, আমাদের দায়টা কোথায়।

মানুষ মাত্রই বৈচিত্র্যময়। তাই এই পৃথিবী, আমাদের সমাজ এত বিচিত্র। অথচ আমরা মানুষ এতটাই অদ্ভুত প্রাণী, ধরেই নিই যে আমার যিনি বন্ধু, কাছের মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, সহকর্মী, সহপাঠী  কিংবা আত্মীয়-স্বজন, স্বামী-স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়ে– অর্থাৎ আমরা যাদের সঙ্গে চলাফেরা করি, আমাদের আশপাশের মানুষ– তিনি বা তারা একদম আমার মতোই হবে।

আমি যেভাবে ভাবি, আমি যেভাবে চিন্তা করি, যা পছন্দ করি আর যে বিষয় অপছন্দ করি, সব কিছু যেন আমার কাছের মানুষটিও একই রকম করে ভাবে। মানুষকে আমরা আমাদের মানসপটে আয়নারূপে দেখতে চাই মনের অজান্তেই। কি আশ্চর্য, মানুষ কি কখনও আয়না হতে পারে?  

তাহলে তো আয়না তৈরি হতো না। আমার উল্টো পাশে থাকা মানুষটি যদি আমার প্রতিবিম্ব হয়ে যায় তাহলে আর আয়নার কি দরকার ছিল এই পৃথিবীতে?

পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ ভিন্ন, সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকটি মানুষকে তৈরি করেছেন নিজস্বতায়, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে, যেখানে কেউ কারও সঙ্গে খুব বেশি মিলে যাওয়ার সুযোগ নেই। বর্ণ-ধর্ম শ্রেণি স্ট্যাটাস লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে বিভিন্নতা তো রয়েছেই, এমনকি একই লিঙ্গের, শ্রেণির, ধর্মের, বর্ণের এমনকি একই পরিবারের সদস্য হওয়ার পরেও আমরা একে-অপর থেকে কত ভিন্ন! কেউ হয়তো পজিটিভ চিন্তা করতে পারেন, কেউ খুব একটি বিষয়কেও নেগেটিভভাবে দেখেন। কেউ কেউ সহপাঠীর জন্মদিন উপলক্ষে পুরো দিনটি কীভাবে সেই বন্ধুটিকে খুশি রাখা যাবে, আনন্দে রাখা যাবে তা নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা সাজায় এবং অন্যান্য সহপাঠীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ করে তোলে বন্ধুটির জন্য, অন্যদিকে জন্মদিন যে বন্ধুটির সে হয়তো ভাবছে কেন জন্মদিন বিশেষ হতে হবে এবং তা ভেবেই বিরক্ত হয়ে ওঠে। কেউ হয়তো অনেক বুদ্ধিদীপ্ত, কেউ হয়তো কম বুদ্ধিসম্পন্ন।

কেউ হয়তো পছন্দ করেন সবুজ,  কেউ পছন্দ করেন কালো বা সাদা। কারও চিন্তাভাবনা আকাশের মতো বিশাল, কারও চিন্তাভাবনা খুবই সংকীর্ণ। কেউ হয়তো ভাবেন জীবনের সর্বোচ্চ অধ্যায়ে পৌঁছাতে পারাটাই সফলতার মাপকাঠি, কেউ হয়তো ভাবেন মনে শান্তি থাকাটাই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয় একজন মানুষের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে একটা নতুন পরিবেশে নতুনভাবে একজন মানুষ তার ‘নিজেকে’ আবিষ্কার করেন নবরূপে। দলের মাঝে, একঝাঁক তারুণ্যের মাঝে, বন্ধুত্বের মাঝেও সে যে আসলে দিনশেষে একা, তা তাকে বুঝে নিতে হয় কিংবা বুঝিয়ে দেওয়া হয় এই ক্যাম্পাস জীবন থেকেই। বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই প্রথম দূরে থাকা, নিজের সঙ্গে নিজের এক ধরনের বোঝাপড়া চলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ, সিজিপির চাপ। অর্থনৈতিক যুদ্ধ তো রয়েছেই, সঙ্গে বন্ধুত্বের যুদ্ধ, প্রেমের সম্পর্কের জটিলতা, পরীক্ষা- ক্লাস টেস্ট, প্রেজেন্টেশন, মিডটার্ম, ফাইনাল– সবকিছু মিলে জীবন যেন অন্যরকম, ভিন্ন গতির।

আছে এই পর্যায়ে শিক্ষকদের সঙ্গে ভিন্ন ধরনের যোগাযোগ, যা স্কুল-কলেজ থেকে অনেকটাই ভিন্ন।  স্কুল কলেজের শিক্ষকরা ছাত্রদের যেভাবে কঠোর অনুশাসনের  মধ্য দিয়ে পরিচালিত করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টা ঠিক সেরকম নয়। এখানে শিক্ষকরা প্রতিটি ছাত্রকে একজন পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করতেই বেশি আগ্রহী। ফলে, শিক্ষার্থীরা অনেকটাই দায়িত্ববান হওয়ার চেষ্টা করেন, আবার শিক্ষকরাও আশা করেন শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। এখানেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে কোথাও যেন কিছু কিছু ছাত্র এবং শিক্ষকের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। কেননা অনেক শিক্ষক ধরেই নেন সব শিক্ষার্থী একই রকম হবে, একইরকম দায়িত্বশীল আচরণ করবে, একই রকম ম্যাচিউরিটি আশা করেন তাদের কাছ থেকে। আবার অনেক শিক্ষার্থীও ধরেই নেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা সবাই তাদের প্রতি একইরকম দায়িত্ববান ও শ্রদ্ধাশীল হবেন। কিন্তু ওই যে প্রথমেই বলে নিলাম, মানুষ মানেই তো বিভিন্নতা থাকবে! তাহলে শিক্ষক বলতেই কেন আমরা ধরে নেবো সবাই এক ও অভিন্ন হবে? ঠিক যেমন শিক্ষার্থীরাও সবাই একরকম হবে না।

শিক্ষকদের বেশিরভাগই অভিভাবক-বৎসল মানসিকতার হলেও কারও কারও মাঝে নেতিবাচক চিন্তার যে উদয় হয় না তা বলা যাবে না। সমাজের সব পেশায় যখন ইতিবাচক এবং নেতিবাচক মানুষ থাকে, শিক্ষকতায় এই ধরনের নেতিবাচক মানুষ না থাকুক সবাই তো আশা করে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাই তো আমরা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, মাদ্রাসা শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কিছু বিপথগামী শিক্ষকের চরিত্র স্খলন দেখতে পাই। এই ধরনের শিক্ষকদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো বটেই, গোটা শিক্ষক সমাজ এখন প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষার্থীদের লাগাতার উচ্চকণ্ঠ, প্রতিরোধ, লড়াই পারে এই ধরনের শিক্ষকদের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে।

এই লেখার আলোচনা সেদিকে নিচ্ছি না, এসব নিয়ে  লিখেছি, সামনে হয়তো আরও লিখবো। আজ কেবল কেন কিছু মানুষ আমাদের মাঝে থেকেও একা, কেন নিজেকে হারিয়ে দিতে চায়, জীবনযুদ্ধে হেরে যায়, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে চায়, তাই নিয়ে আলোচনা করবো।

মানব সমাজের চিরন্তন সত্য বৈচিত্র্যময়তা বা বিভিন্নতা- যতদিন আমরা এই সত্যকে না বুঝবো ততদিন আমরা আসলে একে-অন্যের প্রতি সঠিক বিচারটি করতে পারবো না। আজ সমাজে যা কিছু ঘটে যাচ্ছে, অন্যায় অবিচার, মানুষে-মানুষে বিভেদ, পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝি, একটা বীভৎস সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে– এসবের পেছনে রয়েছে মানুষের এই বৈচিত্র্যতাকে বা বিভিন্নতাকে পাঠ করতে না পারার অক্ষমতা।

এবার আসি মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মহত্যা, হতাশা, হীনম্মন্যতাবোধ ও বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে। এই সব কিছুর পেছনে আমি দায়ী করছি মানুষের বিচিত্রতাকে, বিভিন্নতাকে পাঠ করতে না পারার অক্ষমতাকে। বিষয়টি সহজ করে বলি।

মানসিক স্বাস্থ্যের যে অসহায়ত্ব, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই শুরু হয় শৈশব থেকে। একটি শিশু যখন পরিবারে ৪/৫ বছরে উপনীত হতে হতে দেখতে পায় পরিবারের ভেতরে বিভিন্ন রকমের টক্সিক সম্পর্ক বিদ্যমান, তখন নানাভাবে সেসব সম্পর্ক তার শৈশবের সময়টিকে বিপন্ন করে তোলে। এই সম্পর্কগুলোর প্রভাব কখনও সরাসরি তার ওপরে আবার কখনও সরাসরি না হলেও তার মনোজগতে চাপ তৈরি করে। যেমন, যেসব পরিবারে বাবা-মায়ের মাঝে সবসময় দ্বন্দ্ব-ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে সেসব পরিবারের বাচ্চাদের পক্ষে সহজ, সুন্দর ও স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠাটা অনেক কঠিন একটি ব্যাপার।

যেসব পরিবারে বাবা কিংবা মা অসম্ভব রকম রাগী, বদমেজাজি, দাপুটে, অহংকারী, আধিপত্য বিস্তার করতে সারাক্ষণ ব্যস্ত এবং এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন, সেই পরিবারের প্রতিটি বাচ্চার ভেতরে অভিভাবকের চরিত্রের প্রভাব পড়বেই।

কেবল প্রভাব পড়ে তা নয়, প্রতিদিনকার জীবনযাপনে এই ধরনের অভিভাবকদের মাঝে যে টক্সিক সম্পর্ক, তা সন্তানদের ট্রমাটাইজড করে তোলে মনের অজান্তেই। অনেক সময় অভিভাবকরা ভাবতে পারেন তারা তো সন্তানের সঙ্গে কিছু করছেন না, যা করছেন তাদের নিজেদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ করছেন, কিন্তু দিনশেষে সেটি সন্তানদের ওপরেই প্রভাব পড়ে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এরকম একটি টক্সিক পরিবেশের মাঝেও বাবা মায়েরা আশা করেন সন্তানদের কাছ থেকে ভালো রেজাল্ট, উন্নত জীবন- যেমন, ভালো কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে, এই হতে হবে, সেই হতে হবে,  সুস্থ স্বাভাবিক জীবন তৈরি করতে হবে- এ যেন চাইলেই সম্ভব, হাতের মোয়া।

নিজেদের সফল না হবার অক্ষমতা, পারস্পরিক টক্সিক সম্পর্কের জটিলতায় পড়ে জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা এই বাবা মায়েরা সন্তানের কাছে আশা করে সম্পূর্ণ উল্টো দিকগুলো। ফলে সেই সন্তানগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে বাবা মায়ের এই আশাগুলো, যা তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। এই পরিবারের সন্তানেরা কোনোভাবে বাবা মায়ের আশা পূরণ করতে না পারলেই তাদের তুলনা করা হয় অন্যদের সঙ্গে, যা তাদের আরও একবার হীনম্মন্যতাবোধ তৈরিতে সহায়তা করে, বিপন্ন হয়ে ওঠে তাদের জীবন। এই বিপন্নতা সন্তানগুলোর বিষণ্নতার জন্য দায়ী। এই মানসিক বিষণ্নতা তাকে এত দুর্বল করে ফেলে যে জীবনের বাকি পথটুকুতে সে বারবার হোঁচট খায়, বারবার নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, বারবার থেমে যেতে চায়। যেহেতু ছোটবেলায় তার শৈশব চুরি হয়ে গেছে এই ধরনের বিভিন্ন রকমের বাস্তবতায়,  ফলে তার জীবনে নিজস্ব বলে কিছু থাকে না। এত সব বিপন্নতায়, বিধ্বস্ততায় ও প্রতিযোগিতায় কোনোমতে টিকে থেকে যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে, ততক্ষণে তার মানসিক স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।

শৈশব থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা তার ভেতরের ইমোশনাল ভালনারিবিলিটি তাকে পরাজিত ভাবতে শেখায়। ফলে, এতসব ছাত্রকে পেছনে ফেলে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, ভালো চাকরি পাওয়া, কিংবা ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে যাবার পরেও নিজেকে বারবার পরাজিত মনে হতে থাকে। জীবনের যেকোনও সাফল্যকেই তার অধরাই মনে হয়, ফলে সাফল্য পেলেও তা মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছেন বলে মনে হতে থাকে, কেননা কোনও সাফল্যই তাকে মনে শান্তি এনে দিতে পারছে না। কারণ তিনি তো নিজেকেই বিশ্বাস করছেন না। আর যে কারণে মেরিলিন মনরোর মতো খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে থেকেও আত্মহত্যা করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন অনেকেই।

আত্মহত্যা করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, ছোটবেলায় বাবা মা হারানো, কারও দ্বারা নিপীড়নের শিকার হওয়া, অথবা তার খুব প্রিয় মানুষটিকে অন্যের দ্বারা নিপীড়িত হতে দেখা, জীবনের কোনও একসময় কোনও ট্রমাটাইজড ঘটনার সাক্ষী হওয়া, অথবা নার্সসিসিস্ট কোনও বাবা-মা, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা দ্বারা অ্যাবিউজড হওয়া, কাছের কোনও মানুষ দ্বারা প্রতারিত হওয়া, বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়া, দিনের পর দিন একাকিত্ব জীবন, হঠাৎ করেই সম্পর্কের ভাঙন, কারও প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, ইত্যাদি অনেক কিছুই মানুষকে তার নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শিখতে সহায়তা করে। এসব ঘটনা মানুষকে নিজের কাছে নিজেকে হেরে যেতে শেখায়, যা তাকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে বা বিশ্বাস করতে ভয় পাইয়ে দেয়। এসবই মানুষকে ভয়ংকরভাবে একা করে ফেলে।

শুধু তাই নয়, জীবনের এসব ট্রমা তাকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগায়- একদিকে তারা নিজেদের অনেক সুপিরিয়র মনে করে ম্যাটেরিয়াল বা ক্যারিয়ারের বিভিন্ন পরিসরে নানান অ্যাচিভমেন্টের জন্য, আবার অন্যদিকে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাদের ইনফিরিয়র ভাবায়। যখন তাদের ভেতর সুপিরিয়রিটির ধারণা কাজ করে তখন তারা খুব আশাবাদী থাকেন এবং অনেক কাজ করতে পারেন। আবার যখন তারা ইনফিরিয়ররিটি বোধ করেন, তখন তারা হতাশায় নিমজ্জিত হোন এবং কিছুই করতে পারে না, তখন তাদের একাকিত্ব গ্রাস করে। এই একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ আত্মহত্যার মতো পরিকল্পনা করতে থাকে। একাকিত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় নানা ধরনের না পাওয়ার অভিযোগ-অনুযোগ, যা হয়তো তাকে আরও বেশি ইমোশনালি অসহায় করে তোলে। এই মানসিক অসহায়ত্ব যখন সে সইতে পারে না, তখনই সে পরিকল্পনা করতে থাকে আত্মহত্যার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি এই একা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারি, দাঁড়াতে চাই, শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি?

গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া দুটো আত্মহত্যাকেই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, হয়তো দেখতে পাবো ভয়ানক একাকিত্ব তাদের আঁকড়ে ধরেছিল এবং তাদের চারপাশে আমরা কোথাও কেউ নাই!  এই ‘আমরা’ এখন তাদের মৃত্যুর পর শোরগোল করছি, সেই ‘আমরা’ কিন্তু তারা বেঁচে থাকতে তাদের একাকিত্বের পাশে বন্ধু হয়ে হাত বাড়াইনি। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা খুব সহজ কাজ নয়, তারা বারবারই বিশ্বাস ভঙ্গের ভয়ে পিছু হটে যায়। কিন্তু শক্ত করে ভালোবাসা দিয়ে, ধৈর্য ধরে তাদের পাশে আমরা ক’জন দাঁড়াতে চাই? আমাদের জাজমেন্টাল মন তাদের একসময় দূরে ঠেলে দেয় কিংবা তারা অভিমান করে দূরে সরে যায়। আমাদের আর শক্তি সাহস কোনোটাই কুলোই না তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে। সেই অর্থে আমরা কিন্তু ব্যর্থ, পরাজিত। আত্মহত্যা যারা করে, তাদের আমরা পরাজিত বলি, কিন্তু নিজেদের কি একবারও বলি আমরাও পরাজিত?

শিল্পী সাদি মহম্মদের কিশোর বয়সে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বাবাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ঘটনাটি তার ‘চাইল্ডহুড ট্রমা’ তৈরির জন্য যথেষ্ট। পরবর্তীতে এই সময়ে এসে মা চলে যাবার পর পুরো পৃথিবী তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল, সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নানা রকমের না পাওয়ার হাহাকার, বন্ধুত্বহীন নিঃসঙ্গ জীবন। এই জীবনের কাছে তার সারা জীবনের সঞ্চয়, যশ-খ্যাতি, পরিচিতি, সামাজিক সম্মান, সব একসময় নস্যি মনে হলো হয়তো।

এই মানসিক যন্ত্রণা তিনি রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করেও সরাতে পারেননি, রবীন্দ্র চেতনার যে শক্তি সেই শক্তিকেও ম্লান করে দিয়েছিল তার এই মানসিকভাবে ভেঙে পড়া অসহায় জীবনবোধ। হাজারো শিল্পীর স্রষ্টা যিনি, সারা বিশ্বে যার শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারই শিখিয়ে দেওয়া পথে রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করে চলছেন, সেই মানুষটিই নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললেন, জীবনের শেষদিকে এসে।

অবন্তিকার জীবনবোধের সঙ্গেও কিন্তু একটা মিল দেখা যায় এক্ষেত্রে। মেধাবী অবন্তিকা বরাবর ক্লাসে প্রথমই হচ্ছিল, আর কিছু দিন পরেই হয়তো মাস্টার্স পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগের শিক্ষকও হতে পারতেন। চমৎকার উপস্থাপনাসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য যা যা করা দরকার সব কিছুই করতেন, কিন্তু ছিল না তার কোনও বন্ধু বা আপন মানুষ কিংবা একটি মানুষ– যে মানুষটিকে তিনি তার হৃদয়ের সব কথা খুলে বলতে পারেন, যে মানুষটির সঙ্গে চাইলেই তিনি নির্দ্বিধায় ‘আপনের চেয়ে আপন যে জন’ হয়ে উঠতে পারতেন। এতসব মানুষের ভিড়ে তিনি নিজেকে একাই আবিষ্কার  করতেন হয়তো, ২০/২৫ হাজার মানুষের ভিড়ে ক্যাম্পাসে একাকিত্বই জায়গা করে নিয়েছিল তার হৃদয়জুড়ে।

তার বিশ্ববিদ্যালয় সময়কালের ইতিহাস থেকে যা জানা গেলো, তিনি প্রথম বর্ষে ল’ পড়তে এসেও সিদ্ধান্ত বদলে চলে গেলেন পাইলট হবার জন্য, সেখান থেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পরের বছর পরের ব্যাচের সঙ্গে আবার ল’ পড়তে চলে এলেন, পরের বছরের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে গিয়ে যে যুদ্ধ তার করতে হয়েছে, তার জন্য হয়তো তিনি তৈরি ছিলেন না। পরবর্তীতে ক্লাসমেটদের কারও কারও সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, শিক্ষক বাবাকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত নিয়ে আসতে বাধ্য করা, সেই বাবার সাম্প্রতিক সময়ে চলে যাওয়া- এ সবকিছু নিশ্চিতভাবেই তার মনকে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছিল নানাভাবে, হয়তো হারিয়ে ফেলেছিল বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু। কিন্তু ক্লাসের সমস্যাটা কি ক্লাসের ভেতরেই সমাধান করে ফেলা কঠিন ছিল আমাদের জন্য?

আমরা কি আমাদের সহপাঠীদের মাঝে যারা একটু অন্যরকম, তাদের বেদনার নীল রঙকে ছুঁয়ে দেখতে পারি না? এটুকু চাওয়া কি মানবিক মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য বেশি চাওয়া হয়ে যায়?  চলুন আজ নিজেকেই এই প্রশ্নটি করি। যারা চলে যেতে চায়, তাদের চলে যাওয়াকে প্ররোচিত না করে, বরং আমরা কি পারি না ভালোবাসা দিয়ে তাদের জড়িয়ে রাখি মায়া আর মমতার বন্ধনে?

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ