X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর অব্যাহতি বাতিল পুনর্বিবেচনা জরুরি

মো. জাকির হোসেন
০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬

তিন দশকের বেশি সময় ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা প্রসারে ভূমিকা রাখছে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য মতে, দেশে ১০৭ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। 

একটা সময় ছিল শিক্ষার্থীরা সাধারণত কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দমতো বিষয়ে ভর্তি হচ্ছেন। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কালক্ষেপণ না করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ  প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান যথেষ্ট ভালো।

তাছাড়া, নিজের পছন্দমতো এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে চাহিদা আছে এমন বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট না থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে অধ্যয়ন শেষ করার নিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে। পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা ধরনের বৃত্তির সুবিধা দিচ্ছে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা কম খরচে তাদের উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে পারছে।

সংঘর্ষহীন নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষার সুযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে। ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও সেই সূত্রে বিদেশে স্থায়ী অভিবাসনের সুযোগ পাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আমাদের নতুন প্রজন্ম এই সুযোগকে গ্রহণ করছে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অবকাঠামো, ল্যাব সুবিধা ও শিখন পদ্ধতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এগিয়ে। এসব কিছুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের ক্রমশ আগ্রহী করে তুলছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন এমন ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই পড়ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এতে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনের প্রবণতা হ্রাসের পাশাপাশি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।

এমনকি অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বাংলাদেশে আসছে। এছাড়া, দেশে ও বিদেশে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী তৈরিসহ বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রুপান্তরিত করার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রধানত ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ এর আওতাধীন। এই আইনে ট্রাস্টের অধীনে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হবার সুবাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর অব্যাহতির সুযোগ ভোগ করে আসছিলো। এটি কেবল বাংলাদেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরুপ, যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫৪ সনের Internal Revenue Code (IRC) এর ৫০১(সি)(৩) ধারা মোতাবেক সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে কর অব্যাহতির তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কেবল ফেডারেল আইন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর আইন অনুযায়ীও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক করপোরেশন, এবং যেকোনও সম্প্রদায়ের তহবিল, বা ফাউন্ডেশন, শুধুমাত্র ধর্মীয়, দাতব্য, বৈজ্ঞানিক, জননিরাপত্তা, সাহিত্য বা শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে সংগঠিত এবং পরিচালিত জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ শিক্ষাদান, গবেষণা এবং জনসেবার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজের কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে যাতে তারা তাদের রাজস্বের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম ব্যয়/বিনিয়োগ করতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যে কল্যাণ ও সেবামূলক কাজ করে থাকে কর অব্যাহতির ফলে তা সর্বাধিক হারে করতে সক্ষম হয়। যার মধ্যে রয়েছে: একটি শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণি তৈরি যা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য; একটি উচ্চ-শিক্ষিত, দক্ষ এবং উৎপাদনশীল কর্মীবাহিনী, যা আমাদের দেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ নতুন উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি তৈরির মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করে, জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করে। কর অব্যাহতির কারণে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তার তহবিল শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা, একাডেমিক প্রোগ্রাম, চিকিৎসা গবেষণা, অত্যাধুনিক গবেষণা ও উন্নয়ন এবং অন্যান্য পরিষেবা কার্যক্রমসহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে অধিকহারে বিনিয়োগ, ব্যবহার করতে পারে। নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ইভানস্টন লেকফ্রন্টে ২৪০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। শিকাগোর ব্যয়বহুল স্ট্রিটরভিল এলাকায় রিয়েল এস্টেটের মালিক এই বিশ্ববিদ্যালয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় হাইড পার্কে ২১৭ একর জমিতে অবস্থিত। ডিপল ইউনিভার্সিটি, লয়োলা ইউনিভার্সিটি শিকাগো এবং রাজ্য জুড়ে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিও তাই।  এই ক্যাম্পাসগুলোর বিশাল সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও কর থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত।

বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর অব্যাহতির সুবিধা বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২০০৭ সালে বাৎসরিক আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ আয়কর নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বাৎসরিক আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ আয়কর নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আদালতে ৪৬টি রিট আবেদন করে সংক্ষুব্ধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো।

ওইসব রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন হাইকোর্ট। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে চলতি বছরের (২০২৪) ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায় বাতিল করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ডেন্টাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আদায়ের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

রায়ের পরেই আয়কর আদায়ে তৎপরতা শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। বকেয়া আয়কর পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার অন্তত ৪০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয় রাজস্ব বোর্ড। চিঠিতে কর পরিশোধের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ১৫ মার্চ। নির্ধারিত ওই সময়ের মধ্যে কর পরিশোধ না করলে জরিমানাসহ অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও চিঠিতে সতর্ক করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে “কিন্তু তারপরও তারা আয়কর পরিশোধ করেননি, এমনকি অনেকে যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি”।

আয়কর পরিশোধ না করায় ঢাকার ৩১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। ওই তালিকায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এবং সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, নটর ডেম ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, এক্সিম ব্যাংক ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানা যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই পদক্ষেপকে অমানবিক আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।

প্রশ্ন হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল, ডেন্টাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কর অব্যাহতির সুবিধা বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কেন তাদের বাৎসরিক আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করার প্রজ্ঞাপন জারি করলেন? কর অব্যাহতি পেতে হলে আইন অনুযায়ী আবশ্যিক কিছু শর্তপূরণ করতে হয়। কর-মুক্ত সত্তা হিসাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবশ্যই রাষ্ট্রের আইন মেনে ট্যাক্স ফাইলিং, অডিট ইত্যাদি সম্পন্ন করতে হয়। অনেক দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনগুলিকে তাদের মিশন, রাজস্ব, ব্যয়, এনডাউমেন্ট, কর্মচারীদের বেতন এবং সুবিধা, দাতব্য উপহারসহ আরও অনেক কিছুর রিপোর্ট করতে হয়।

এই তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কর-মুক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কহীন ব্যবসায়িক আয়কর (Unrelated Business Income Tax, UBIT) এর অধীন। তাদের অবশ্যই বিভিন্ন কার্যকলাপ, ব্যবসা বা ব্যবসা থেকে আয়ের উপর ট্যাক্স দিতে হবে যা তাদের শিক্ষা সম্পর্কিত কর অব্যাহতির উদ্দেশ্যগুলোর সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্পর্কিত নয়। উদাহরণস্বরুপ, কর অব্যাহতির আওতাধীন যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০২২ সালে ৮ মিলিয়ন ডলার কর পরিশোধ করতে হয়েছে এজন্য।

বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের আয়-ব্যায়ের হিসাব স্বচ্ছ নয়। অনেকেই নানা আঙ্গিকে মুনাফা গ্রহণ করছেন, মেকানিজম করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন– “যেসব শর্ত ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কর আওতার বাইরে রাখা হয়েছিলো, তাদের বেশিরভাগই এখন সেগুলো মেনে চলছে না”। তিনি আরও বলেন, “কর রেয়াতের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ সাধন, কিন্তু তারা এখন রীতিমত লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। কাজেই তাদের উপর করারোপ করাটা মোটেই অযৌক্তিক নয়”। একই কথা বলছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, “করটা নেওয়া হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করপোরেট আয়ের ওপরে। সুতরাং এর যৌক্তিকতা রয়েছে”। তবে আয়ের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও পড়াশোনার গুণগতমান উন্নয়নে ব্যয় করতে চায়, সেটি বিবেচনায় নিয়ে তাদের করের হার আরেকটু কমানো যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

ট্রাস্ট আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা। আইন অনুযায়ী, এগুলোর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরাও কোনও ধরনের বেতন বা লাভ নিতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীত চিত্র থাকার অভিযোগ উঠছে প্রতিনিয়ত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “অডিট করতে গিয়ে আমরা দেখছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকেই নিয়মিতভাবে মুনাফা অর্জন করছে এবং মালিকপক্ষ নানান কৌশলে মুনাফার সুফলও ভোগ করছে। এমনকি লাভে থেকেও অনেকে লোকসান দেখিয়েছেন, এমন ঘটনাও আমরা পেয়েছি”।

ওই কর্মকর্তা বলেন, “মূলত এরকম প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে সেগুলোর উপর করারোপ করা হচ্ছে”। আপিল বিভাগের রায়ের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কারা করের আওতায় পড়বেন, সেটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-সহ অন্যান্য আয় থেকে সমস্ত পরিচালন ব্যয়, বেতন ইত্যাদি মেটানোর পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকবে, তার উপরেই এই কর ধার্য হবে”। তিন বলেন, “কাজেই পরিচালন ব্যয় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচের পর যদি দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের তহবিলে কোনো উদ্বৃত্ত বা বাড়তি অর্থ নেই, তাহলে তাদেরকে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে না”।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু খারাপ মানুষ সিটিং অ্যালাউন্স, অন্যান্য ভাতা, বিলাসবহুল গাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অবৈধ ব্যবসায়িক চুক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ আহরণে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অর্থ পাচার করছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের এই অপরাধমূলক কাজের জন্য অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু কয়েকজনের অপরাধের জন্য সামগ্রিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর অব্যাহতি বাতিল পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এটি অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মৃত্যুঘণ্টা হয়ে আবির্ভূত হতে পারে। বেসরকারি বিশ্বদ্যিালয়ের জন্য স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর আইন অনুযায়ী আবশ্যক। একটি স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক শ’ কোটি টাকা প্রয়োজন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মচারীদের স্বল্প বেতন দিয়ে, গবেষণার পিছনে সামান্য ব্যয় করে অর্থ জমানোর চেষ্টা করছে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের জন্য।

এই জমানো টাকার উপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করলে তাদের স্থায়ী নিবাসে যাওয়ার বদলে ভাড়া বাড়িতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনাবসান হবে। কর অব্যাহতি বাতিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার খরচকে আরেক দফা বৃদ্ধি করবে। করের খড়গ অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপানো হবে। এটি তাদের জন্য বৈষম্যমূলকও বটে। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তারা নামমাত্র খরচে পড়াশোনা করে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি প্রতিবেদন বলছে, সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিজন শিক্ষার্থীর পিছনে গড়ে ১,৫৫,২৯৮ টাকা খরচ করে। তাদের কোনও কর দিতে হয় না। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজের খরচে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করে। কোনও সরকারি অনুদান নেই। এরপরও তাদের উপর করের দায় চাপানোর আগে আরেকবার বিবেচনার দাবি অন্যায্য নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর অব্যাহতি চালু রাখাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের তরফ থেকে বড়ো সহায়তা।

আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে অনেকদূর এগিয়েছি। বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে বিরামহীন কাজ করছেন। উন্নত রাষ্ট্রে রুপান্তরের অন্যতম শর্ত হলো, শিক্ষিত নাগরিক এবং যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ। সব উন্নত দেশই টেকসই উন্নয়নের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার শিক্ষাবান্ধব সরকারও একই পথ বেছে নিয়েছেন। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমেই আমরা আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হবো।

সবেমাত্র মাননীয় আদালত রায় প্রদান করেছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশিত হয়নি। রায়ের সার্টিফায়িড কপি সংগ্রহ করে রায় রিভিউ করার আবেদনের সুযোগ থাকলে সে সময়টুকু দেওয়া উচিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনও কর পরিশোধ করে না এমন নয়, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও বিভিন্ন কেনাকাটায় উৎসে কর ও ভ্যাট কর্তন করে সরকারের কোষাগারে জমা করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সাথে জড়িত কিছু অপরাধীকে শাস্তি দিতে তড়িঘড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ফলে করপ্রদানকারী নিরপরাধ শিক্ষক-কর্মচারীরা ও তাদের পরিবার-পরিজন ঈদ উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার হুমকির মুখে পড়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষস্থানসমূহের সিংহভাগ হার্ভার্ড, ইয়েল, স্ট্যানফোর্ড, বোস্টন, প্রিন্সটন, জন হপকিন্স, এমআইটি, ক্যালটেক, ভ্যান্ডারবিল্ট প্রমুখ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ের মর্যাদায় আসীন হয়েছে। আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে আসীন হওয়ার সম্ভাবনা দৃশ্যমান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ হারে করারোপের বিষয়টি মানবিক, সহানুভূতিশীল ও গঠনমূলকভাবে পুনর্বিচেনার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের কাছে বিনীত আবেদন করছি।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ