X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলো রে...’

আহসান কবির
১২ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:৪৫আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:৪৫

মানুষ পিঁপড়া বা কুমির না। কুমির এক চোখ খোলা রেখে ঘুমায় আর পিঁপড়া সারা দিন ঘুমায় না! মানুষ দুই চোখের পাতা বন্ধ করা ছাড়া ঘুমাতে পারে না।

–‘ঘুমঘুমীয়’ প্রবাদ

এক ভদ্র মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছেন। স্বামী বেচারা ঘুমের ভেতরে বাচালের মতো বকবক করেন। স্ত্রী ঘুমাতে পারেন না। যে করে হোক তার কথা থামাতে হবে। ডাক্তার ভদ্র মহিলার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন– শুধু তো আপনি কথা বলেন। বাসায় আপনি আর অফিসে বস! দয়া করে আপনার স্বামীকে দিনে একটু কথা বলতে দিয়েন। রাতে সে শান্তিতে ঘুমাবে! আপনি রোমান্টিক্যালি তার ঘুমের ‘মাসিপিসি’ হন!

পৃথিবীর তাবৎ প্রাণিকুলের মধ্যে শুধু মানুষেরই ‘ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি’ আছে। এই মাসিপিসিদের কারণে মানুষ ঘুম আসার আগে বা পরে ঘুমিয়ে যেতে পারে। প্রাণীদের সেই অভ্যাস নেই বা তারা ঘুমের আগে বা পরে যেতে পারে না। কুমির ঘুমোয় এক চোখ খোলা রেখে। পিঁপড়াদের চোখের পাতা নেই এবং সারা দিনে ২৪০-২৫০ বার কাজহীন বা কাজ না করলেও সেটা তাদের বিশ্রাম। এ কারণে বলা হয় প্রাণিকুলে পিঁপড়া ঘুমায় না, তারা সবসময় দৌড়ের ওপর থাকে। আবার বনের রাজা সিংহ ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা আয়েশ করে ঘুমায় বা বিশ্রাম নেয়। জিরাফ ঘুমোয় মাত্র তিন চার ঘণ্টা। অন্যদিকে খরগোশ ঘুমায় সাত আট ঘণ্টা।

কৌতুকে এই খরগোশ ও জিরাফের মধ্যে বিয়ে হতে দেখা যায়। বিয়ের তিন চারদিন পরে খরগোশকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল– বিয়ে পরবর্তী জীবন কেমন? ঘুম কি আগের চেয়ে বেশি না কম হয়? খরগোশের উত্তর– সব আগের মতোই আছে। শুধু চুমু দিতে গেলে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়!

যাহোক, জিরাফের মতো দাঁড়িয়ে ঘুমাতে পারে ঘোড়া কিংবা হাতি। অতিকায় দেহের হাতি ঘুমায় খুব কম। মাত্র দুই ঘণ্টা। পাখি আর মাছের মধ্যে একটা মিল আছে। পাখি ওড়ার সময় আর মাছ সাঁতরানোর সময়েও ঘুমিয়ে নিতে পারে। মাছের ভেতর দিনরাতের কোনও বালাই নেই। পাখিদের আছে। এজন্য কথায় আছে রাতজাগা পাখি। পেঁচার মতো কোনও কোনও পাখি দিনে ঘুমায়, রাতে শিকার ধরে, ঘুরে বেড়ায়। পায়ে ঝুলে দিনে প্রায় ১৮-১৯ ঘণ্টা ঘুমাতে পারে বাদুড়।

কিন্তু মানুষ? বিড়াল তার জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ আর মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুম কারও কারও কাছে ধ্যান, কারও কাছে এবাদত আর কারও কারও কাছে ভিন্ন এক অনুভূতির নাম। ঘুম না এলে স্বপ্ন আসে না, আর স্বপ্ন না এলে জীবন রঙিন হয় না। মজা করে বলা হয়, প্রেম করলেও নাকি ঘুম আসে না। কারণ স্বপ্ন হাতের মুঠোয় চলে আসে তখন! ঘুমের চেয়ে স্বপ্ন বাস্তবতা অনেক ভালো! কিন্তু প্রেম ভাঙলেও ঘুম আসে না। অতি আনন্দ কিংবা বিরহেও নাকি ঘুম আসে না।

মানুষের ঘুম নিয়ে অনেক মিথ আছে। ঘুম প্রার্থনা কিংবা সাধনারও ব্যাপার। যেমন কুম্ভকর্ণ। রামায়ণের উল্লেখযোগ্য এক খলচরিত্র কুম্ভকর্ণ, যার সহোদর ছিলেন রাক্ষসরাজ রাবণ ও বিভীষণ। যুদ্ধে তার পারঙ্গমতা ছিল অসাধারণ। দুঃখ এই তার জিহ্বা আড়ষ্ঠ ছিল। ধর্মকর্মের মাধ্যমে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে তিনি বর লাভ করেন। ব্রহ্মের কাছে ‘ইন্দ্রাসন’ বর চান কিন্তু উচ্চারণ জটিলতায় সেটা ব্রহ্মের কানে যায় ‘নিদ্রাসন’ হিসেবে। রাবণের অনুরোধ না মেনে ব্রহ্মা তাকে নিদ্রাসন বর দেন, যার ফলে বছরের ছয় মাস ঘুমিয়ে থাকতেন কুম্ভকর্ণ। ঘুম থেকে জেগে হাতের কাছে মানুষ পশু পাখি যা পেতেন তা-ই ভক্ষণ করতেন।

সম্ভবত ঘুম নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প ওয়াশিংটন হার্ভির লেখা ‘রিপ ভ্যান উইংকল’। রিপ ছিল এক মজার মানুষ। সে বাচ্চাদের গল্প শোনাতো আর খেলনা দিতো। রিপের স্ত্রী তাকে পছন্দ করতো না। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একদিন সে তার প্রিয় কুকুর আর বন্দুক নিয়ে চলে যায় পাহাড়ের দিকে। সেখানে এক লোকের সঙ্গে দেখা হয়। সে তার বাজনা শোনে আর পান করে। এরপর সে দীর্ঘ ঘুমে যায়। যখন ঘুম ভাঙে তখন বন্দুকে মরিচা ধরেছে, কুকুরটা আর বেঁচে নেই। লোকালয়ে ফেরার পর কেউ আর রিপকে চিনতে পারে না। এক বৃদ্ধ লোক তাকে চিনতে পারে এবং রিপ জানতে পারে তার স্ত্রী মারা গেছে। এরপর নিজ ছেলে আর মেয়ের সঙ্গে রিপের দেখা হয়। রিপ ভ্যান উইংকেল গল্পের মতো বিখ্যাত কিছু মানুষের ঘুমের গল্পও বিখ্যাত হয়ে আছে।

সত্য মিথ্যা অকাট্টভাবে না হলেও প্রচলিত আছে যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঘুমাতেন কম, যার প্রভাব পড়েছিল তার জীবনে। রবিঠাকুর যখন ভাবতেন বা নিদ্রায় যেতেন তখন তার গায়ে পোকামাকড় বসলেও উনি নাকি টের পেতেন না। প্রচলিত আছে যে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যুদ্ধযাত্রার দীর্ঘপথে ঘোড়ার পিঠে ঘুমাতে পারতেন। উনি রাতে ঘুমাতেন কম আর দিনে ঝিমাতেন। চীনা উপকথা অনুসারে যে পুরুষের স্ত্রী রাগী বা মারমুখো তাদের স্বামীরা ভয়তে ঘুমায় না, অফিসে ঝিমানোটাই তাদের কাছে মধুর। স্ত্রীর কারণে অনেক পুরুষ নাকি অফিসে নিয়মিত হয়। সুরস্রষ্টা বিটোফেনের বাজনা শুনে কেউ ঘুমায় আবার কেউ সকালে জেগে ওঠেন তার বাজনা শুনে। বিটোফেন ঘুমাতেন নিয়ম করে। এর বিপরীত জীবন ছিল বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের। ঘুমহীনতার কারণে তার অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকতো। সামরিক বাহিনীর মানুষদের ঘুমহীনতা কম। তারা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমায়, সকালে প্রায় একই সময়ে ঘুম থেকে জাগে। এদের কারণেই জানি না ইংরেজি এই প্রবাদটার প্রচলন হয়েছিল কিনা– ‘আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস আ ম্যান হেলদি ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ!’ পাকিস্তান আর নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্যরা নাকি অলওয়েজ ‘হেলদি অ্যান্ড ওয়েলদি’। তাদের ঘুমও ভালো হয়, কিন্তু এরাই আবার নিদ্রাহীনতায় ভোগে যখন নাকি তারা ক্ষমতায় চলে আসে।

ক্ষমতার ঘুম বা ওম অন্যরকম। সুখী মানুষ নাকি গাছের নিচে ইটে মাথা রেখেও ঘুমাতে পারে। জানি না পুরোনো কালের এসব কথা এখনকার মানুষ বিশ্বাস করে কিনা! ক্ষমতা কিংবা ধনীদের ঘুম সেই তুলনায় কেমন সেসব নিয়েও কম মাথা ঘামানো হয়নি। ফেসবুক খ্যাত মার্ক জুগারবার্গের ঘুম নাকি বেশ ঘন। তিনি ধনী এবং কোনও না কোনোভাবে ক্ষমতাবান। ধনীরা নাকি ঘুম কিনতেও পারে। গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল ‘ঘুম কিনে খাই’!

মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায় বলে ঘুম নিয়ে তাদের আদিখ্যেতার কমতি নেই।

লক্ষ গান কিংবা ছবি পাওয়া যাবে ঘুম নিয়ে। সময় থাকলে এখনও দেখতে পারেন- ‘স্লিপিং উইথ অ্যান এনিমি’। শুনতে পারেন ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে’ থেকে শুরু করে ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা’র মতো যেকোনও গান। মনে রাখবেন, ঘুম বা মনভাঙা গান কোনোভাবেই গাওয়া যাবে না। কারণ গানেই আছে– ‘কেউ যেন ভুল করে গেও নাকো মনভাঙা গান/ওরা আসবে চুপি চুপি/যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ/সবক’টা জানালা খুলে দাও না!’

নাগরিক বা শহুরে জীবনে জানালা খোলা রাখলে আসে চোর কিংবা মশা! বাতাস এলেও সেটা দূষিত। তবু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। বিয়ের রাতে আপনার ঘুম না এলেও লোকাল বাসে সিট পেলে প্রচণ্ড গরম কিংবা হর্নের শব্দেও ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আর যদি ঘুম না আসে তাহলে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করুন, যেন অজ্ঞান পার্টির পানিপড়া খেয়েও আপনার ঘুম না আসে। অলস বা অবসর নেওয়া মানুষের স্লোগান অনেকটা এমন– কাজের মধ্যে দুই/খাই আর শুই! এক চিলতে ঘুমের জন্য যে শোয়া সেটা অব্যাহত থাকুক। সুখ মাপার একটা মানদণ্ড হচ্ছে ঘুম। সেই হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ঘুম বা সুখের দেশ ফিনল্যান্ড। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮তম। সম্ভবত এ কারণে বাংলাদেশে এমন গান জনপ্রিয় হয়– ‘ঘুমাইয়া ছিলাম ছিলাম ভালো জাইগা দেখি বেলা নাই!’ ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারণে একবার ঘুমে ধরলে সহসা নাকি ঘুম ভাঙে না। সেখানে রোমান্টিক ভিলেন হতে পারে কোকিল। গানে আছে– ‘আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলোরে মরার কোকিলে’!

মরার কোকিলরা যেখানে ঘুম ভাঙায়, অজ্ঞান পার্টিরা সেখানে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পছন্দ করে। ঘুমহীন মানুষ নেই পৃথিবীতে। ঘুমের সময়টাই ভালো। আপনি স্বপ্ন দেখতে পারেন। যত বিপদ আপদ সব আসে যেন জেগে থাকার সময়। ঘুমের মধ্যে চিরঘুমে চলে যাওয়াও নাকি ভালো। আসুন কৌতুক শুনে ঘুমাতে যাই অথবা ঘুম পালানো কৌতুক শুনি।

এক. আমাদের স্কুলের অঙ্ক স্যার স্কুলে এসে ঘুমাতেন বা ঝিমাতেন। একদিন কথায় কথায় বললেন, দিনে অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছাত্র ইউসুফ জানতে চাইলো- স্যার স্কুল তো সাড়ে ছয় ঘণ্টা। বাকি দেড়ঘণ্টা কোথায় গিয়ে ঘুমান?

দুই. বল্টুর ঘুম আসে না। তার বাসার আশপাশে কুকুর ডাকে। সে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার তাকে সাত দিনের ওষুধ দিলো। সাত দিন পর বল্টু ফিরলো বিরস বদনে। ডাক্তার জানতে চাইলেন ঘুম কেমন হচ্ছে? বল্টু বললো ঘুম আরও কমেছে। সাত দিন ধরে অনেক কষ্ট করে কুকুরগুলোকে ওষুধ খাওয়ালাম। ওদের ডাক কমেনি, শুধু ঝিমুনি বেড়েছে!

মোবাইল বা ইন্টারনেটের যুগে ঘুমের চেয়ে নাকি ঝিমুনি বেড়েছে!

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ