X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছেলেমেয়েরা কী শিখছে, সেটা জানা জরুরি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০১ জুন ২০১৬, ১২:০৮আপডেট : ০১ জুন ২০১৬, ১২:১২

ইশতিয়াক রেজাএকটি রিপোর্ট, সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক হৈচৈ। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টে আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে শিশু-কিশোরদের চেহারা দেখানো, প্রশ্ন করার ধরন নিয়ে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা নিশ্চয়ই এই রিপোর্টটি কিছুটা হলেও দেখিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডে এই রিপোর্টের অনেক সমালোচনা করা সম্ভব। কিন্তু একটি প্রজন্ম যে ধ্বংস হতে চলেছে তার কিছুটাতো দেখলাম।
ছেলে-মেয়েদের এখানে দোষ দেওয়ার আগে দেশের শিক্ষার চেহারাটা দেখা দরকার। এ নিয়ে যে-সমস্ত উদ্বেগ চারদিকে, তার একটা প্রধান কারণ হলো শিক্ষার গুণগত মান। শিক্ষায় অবকাঠামো এবং অনুষঙ্গিক কিছু উন্নয়নের কল্যাণে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে ভরসা জেগেছে, স্কুলমুখী হয়েছে শিশুরা, বিশেষভাবে বেড়েছে ছাত্রীসংখ্যা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পাস। এখন ফেল করে কম, পাস করে বেশি, তাও আবার সর্বোচ্চ গ্রেড এভারেজ জিপিএ-৫ নিয়ে। কিন্তু তারা শেখে কতটুকু—এ প্রশ্নই এখন চারদিকে উচ্চারিত।
প্রাথমিক থেকে উচ্চ পর্যায় সর্বত্রই চিত্রটা কোনও স্বস্তি দেয় না। করপোরেট জগতের উদ্যোক্তারা বলেন, তারা ভালো কর্মী, বিশেষ করে, বড় ব্যবস্থাপনা পদে দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ দেশে পাচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশি কর্মী নিয়োগ করতে হচ্ছে বেশি টাকা দিয়ে। ঢাকার অনেক নামিদামি স্কুলে অংক আর ইংরেজির শিক্ষক আসছেন পাশের দেশ থেকে।
২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলেছিল প্রতি বছর স্নাতক ডিগ্রিধারীদের অন্তত ৭০ ভাগের মান সন্তোষজনক নয়। কারণ হিসেবে ইউজিসি বলছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার যে সংস্কৃতি এখন আছে, তা কেবল বাড়ছে, সরকার যদিও স্বীকার করছে না। সামাজিক মাধ্যমে, ইন্টারনেটে প্রশ্ন চলে আসছে পরীক্ষার আগের রাতে, বা পরীক্ষার দিন সকালে। আর এসব পেয়ে সবাই ভালো ফল করছে, কিন্তু শিখছেটা কী, তার প্রমাণ সেই রিপোর্ট। পরীক্ষা মানেই এখন টোকাটুকি, পরীক্ষার হলে না হলেও, হলের বাইরে।  

শিক্ষার গুণগত মান বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা নিয়ে মতভেদ থাকবে, আলোচনা হবে এটা ঠিক। শিক্ষা মানুষ হওয়ার জন্য, না কি নম্বর পেয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য, এ বিতর্ক থাকবে। কিন্তু ন্যূনতম একটি মান নিশ্চিত হওয়া দরকার। সে সম্পর্কে কোনও তর্ক নেই। আর তা হলো পড়তে লিখতে ও সাধারণ অঙ্ক করতে শেখা, নিজের দেশ, সাধারণ ইতিহাস, সমসাময়িক বিষয়ে ধারণা রাখা। দেখা যাচ্ছে, সেই মূল জায়গাতেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

ক’দিন আগে বিজ্ঞজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষাবিদরা বলেছেন, এমসিকিউ প্রশ্নপত্র পদ্ধতিতে পরীক্ষা চিরতরে বাতিল করতে হবে। প্রশ্ন পদ্ধতি সৃজনশীলতার নামে পুরো ব্যবস্থা অসৃজনশীল করা হয়েছে। মতবিনিময়ে শিক্ষক-শিক্ষাবিদ সবার মধ্যে একটা আন্তরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা প্রায় সবাই অনুভব করেছেন। গলদ আছে ব্যবস্থায় সেটা মেনেই শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে নানা পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, শিক্ষকরা সৃজনশীলতা বোঝেন না। সৃজনশীলতা না বোঝার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ই ঝুঁকছেন গাইড বইয়ের দিকে। অভিভাবক ছুটছেন কোচিং সেন্টারের দিকে। প্রাইভেট টিউটরের দিকে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি হওয়ার কারণেই এই বিপত্তি হয়েছে। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি সৃজনশীল হলেই সমস্যা কাটবে।

আরও পড়তে পারেন: ‘ওদের শিক্ষা কি পুরা হইয়াছে?’

একটি শিশুকে তার না-শিখতে পারার জন্য এক জায়গায় আটকে রাখা যেমন ঠিক নয়, তেমনই কোনও কিছু না শিখিয়ে পরের স্তরে তুলে দেওয়াও ঠিক নয়। বরং তার সাফল্য-ব্যর্থতাগুলোকে সামগ্রিকভাবে চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কিন্তু আজকাল মানসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি শিক্ষকদের অতিরিক্ত কোচিং মানসিকতা পুরো ব্যবস্থাকে শুধু ফল নির্ভর করে রেখেছে, জ্ঞান নির্ভর নয়। শিক্ষার নিরপেক্ষ বাস্তবমুখী বহির্মূল্যায়নে অভিভাবকদেরও ভূমিকা আছে।  পরীক্ষা না থাকলে ছাত্রের প্রগতি কিভাবে নির্ধারিত হবে? কত নম্বর পেল, সেটা নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু এটা জানা জরুরি যে, সে কতটা কী পারছে।

শিক্ষক, বই ও পরীক্ষা, এ তিনটি বিষয় বিবেচনা করলে সবচেয়ের দুর্বল অবস্থানে শিক্ষকরা। ভালো শিক্ষক এখন বিরল। আর আমাদের সর্বনাশের মূলে মুখস্থ-বিদ্যার জয়জয়কার। সিলেবাস নিয়ে কারও কোনও আগ্রহ নেই, জানার জন্য পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষার্থীর কাজ স্রেফ নির্ধারিত কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা এবং সেগুলো গাইড বই আর শিক্ষকদের কাছ থেকে ছেঁকে নেওয়া।

মুখস্থ করাটাকে গুণ ধরবেন কেউ কেউ। সেই বিবেচনায় এখন মুখস্থও করছে না অনেক শিক্ষার্থী। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে স্রেফ টুকলিবাজি করছে। এই জায়গাটা বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু তা চলছে অবারিত। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা, পাঠ্যবইয়ের হেরফের, নানান পরিবর্তন ও বিবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও বেশ কিছু শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী শিক্ষাকে শক্ত জমিতে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় চালিয়ে যাচ্ছেন, একথা কেউ অস্থীকার করবে না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মান নজর না দিয়ে শুধু পাশে নজর দিলে যা হয়, তাই ঘটছে এখন।   

শিক্ষা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, সাহস জোগায় স্বপ্নকে সফল করার। কাউকে কটাক্ষ করে নয়, আলোচনার মাধ্যমেই এই স্বপ্নগুলো মিলতে পারে, পরস্পরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। শিক্ষা একটি সামাজিক আন্দোলন যে পথ ধরেই আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে মেয়েরাও স্কুলে আসছে। সর্বজনীন শিক্ষার হাত ধরে নিশ্চয়ই আমাদের ছেলেমেয়েরা আগামী দিনে গোটা সমাজকেই নতুন আলো দেখাবে। দরকার সস্তা জনপ্রিয়তা বাড়ানোর মোহ ছেড়ে শিক্ষামন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের মানের দিকে নজর দেওয়া।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ