এ বছরের অর্থ বাজেটে চিকিৎসা খাতকে ভ্যাটের আওতায় আনা হ্য়নি। ভ্যাট মুক্ত রয়েছে চিকিৎসা খাত। এটা মাননীয় অর্থমন্ত্রীর একটি সঠিক সিদ্ধান্তই বলতে হবে। কারণ চিকিৎসা কোনও ভোগ্য পণ্য নয়। স্বল্প ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়া জনসাধারণের মৌলিক অধিকার। আর সেই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব। তাই চিকিৎসা সেবার ওপর কোনও ভ্যাট বসানো যায় না। সঙ্গত কারণেই এই খাতটি ভ্যাট মুক্ত রয়েছে।
শিক্ষাখাতে ভ্যাটের বিষয়টি এবারও জগা খিচুড়িই রয়ে গেলো। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম ভ্যাট মুক্ত। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম কোনটা ভ্যাট মুক্ত আবার কোনটা ভ্যাট যুক্ত। অবশ্য এর একটি কারণও রয়েছে। গেলো বছর শিক্ষাখাতের ভ্যাট নিয়ে ৯ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর স্বল্প সময়ের আন্দোলনে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। এক. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি থেকে ভ্যাট সরকার প্রত্যাহার করেছিল। দুই. ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট হাইকোর্ট ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। প্রথমটির জন্য রাজধানী সহ সারাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তাঘাট বন্ধ করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছিল।
প্রথমদিকে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন আন্দোলনকারীদের সন্মুখ সমরে ঠেকাতে চেয়েছিল। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে এবং দাবির যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করে এ নিয়ে সরকার আর বাড়াবাড়ি করেনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
দ্বিতীয়টি একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছিল। এই পর্যন্তই। অবশ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিবাবকরাও আন্দোলনে নেমেছিল। আন্দোলন বেগবান করতে পারেনি। তারা রাস্তাঘাট বন্ধ করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে পারেনি। তাদের দাবিও পূরণ হয়নি। ফলশ্রুতিতে সরকারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের টিউশন ফি-তে ভ্যাট না থাকলেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিউশন ফি-এর সঙ্গে ভ্যাট রয়েই গেছে। এ নিয়ে তখনও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমরা অনেকেই লিখেছিলাম। লাভ হয়নি। বৈষম্য রয়েই গেছে।
এবার আসা যাক মেডিটেশন কার্যক্রমের কথায়। গত অর্থ বছরের বাজেটে মেডিটেশন সেবার ওপর অর্পিত ভ্যাট আরোপের যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। সে সময়ে প্রত্যাহারের কারণ হিসেবে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মেডিটেশন-সেবা গ্রহণ করে হতাশাগ্রস্ত অনেক মানসিক ও শারীরের ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ মুক্তির প্রয়াস পায়। সে কারণে মেডিটেশন-সেবার ওপর প্রযোজ্য মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছি’। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় গত ০৫ জুন ২০১৪ গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে মেডিটেশন-সেবাকে মূসক (ভ্যাট) থেকে অব্যাহতি প্রদান করে।
মেডিটেশনকে সারা বিশ্ব শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মেডিটেশন হচ্ছে সচেতনভাবে দেহ মন ও মস্তিষ্কে শিথিল করার প্রক্রিয়া। এতে মানুষের মনোযোগ সচেতনতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি হয়। হতাশা ও নেতিবাচক মানসিকতা দূর করে মানুষকে ইতিবাচক করে গড়ে তোলে। মেডিটেশন মানুষের মনে টেনশন দূর করে। টেনশনের কারণে মানবদেহে যে শতকরা ৭৫ ভাগ রোগ হয় তা মেডিটেশনই নিরাময় করতে পারে এবং মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে। শুধু তাই না, মেডিটেশন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়ে জীবনের সফলতা আনতে পারে।
এ কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ২০১১ সালে যোগ মেডিটেশনের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস মেডিটেশনকে মূলধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে সেদেশের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ চিকিৎসক রোগীদের মেডিটেশন প্রেসক্রাইব করছেন।
ভারতে ২০১৫-১৬ সালে ঘোষিত বাজেটে যোগ-মেডিটেশনের ওপর পূর্ব-আরোপিত সার্ভিস ট্যাক্স স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
যোগ-মেডিটেশনের বহুমুখী মনোদৈহিক উপকারিতা বিবেচনা করে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৬৯ তম সাধারণ অধিবেশনে ২১ জুনকে ‘বিশ্ব যোগ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সারা বিশ্বের মতই বাংলাদেশ সরকারও মেডিটেশনকে চিকিৎসা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। সরকার কর্তৃক প্রণীত উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা নীতিমালায় বলা হয়েছে, চিকিৎসকগণ যেন স্ট্রেস-আক্রান্ত ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের নিয়মিত যোগ, মেডিটেশন, শিথিলায়ন, দমচর্চা ইত্যাদির পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশ সরকারের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত এটাই প্রমাণ করে যে, মেডিটেশন কোনও ভোগ্য পণ্য নয়। এটি মানুষের জন্যে অপরিহার্য একটি পরিপূরক চিকিৎসা সেবা। বাংলাদেশে যেহেতু চিকিৎসা সেবার ওপর কোনও ভ্যাট নেই, তাই মেডিটেশন-সেবার ওপরও ভ্যাট থাকা উচিৎ নয়। তারপরও কেন যে সরকার বারবার মেডিটেশন-সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করে তা বোধগম্য নয়।
মেডিটেশন মানুষকে রোগমুক্ত সুস্থ ও প্রত্যয়ী করে তুলে এবং জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য অতি প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলপ্রিয় অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়ে তুলে। যা আমাদের দেশে বড় বেশি প্রয়োজন।
মেডিটেশন-সেবাকে ভ্যাটের আওতায় আনা হলে অধিক সংখ্যক মানুষ এ সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে। জাতি বঞ্চিত হবে শৃঙ্খলাপ্রিয়, অসাম্প্রদায়িক মানুষ উপহার পাওয়া থেকে। অতএব মেডিটেশন কার্যক্রমের ওপর প্রস্তাবিত ভ্যাট মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
আমরা আশা করবো মেডিটেশন সেবা যেহেতু পরিপূরক চিকিৎসা সেবা এবারের বাজেটে চিকিৎসা সেবার ন্যায় মেডিটেশন সেবার কার্যক্রমের ওপর কোনোরূপ ভ্যাট থাকবে না। শুধু তাই নয় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশনফির মতই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিউশন ফিও ভ্যাট মুক্ত হবে।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
আরও পড়তে পারেন: প্রবাসী আয়ে দুশ্চিন্তা
Save