X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামি খেলাফত বনাম আইএস-এর খেলাফত

আনিস আলমগীর
১৯ জুলাই ২০১৬, ১৩:১৫আপডেট : ১৯ জুলাই ২০১৬, ১৩:৪৯

আনিস আলমগীর গত ১৪ জুলাই ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসী হামলায় ৮৪ জন লোক নিহত ও কয়েকশ লোক আহত হয়েছেন। নিস শহর সমুদ্র উপকূলবর্তী। ইতালি সীমান্ত থেকে ফ্রান্সের ২০ কি. মি. অভ্যন্তরে শহরটির অবস্থান। ফ্রান্সের লোক বিলাস ভ্রমণে সমুদ্র সৈকতের এ শহরটিতে অহরহ এসে কোলাহলময় করে রাখে। প্রতিবছর বাস্তিলের পতন দিবস উপলক্ষে এ শহরে আতশবাজি উৎসব হয়। ১৪ জুলাই ছিল বাস্তিল দিবস। বাস্তিল দিবস ফরাসি বিপ্লবেরই অংশ।
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ দখল করেছিল ফরাসি জনগণ। বাস্তিল দুর্গ ছিল কারাগার। সব বন্দীকে জনতা মুক্ত করে দিয়েছিল। রাজা লুই ওইদিন তার সৈন্যদের জনতার ওপর গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছিল- কিন্তু সৈন্যদল জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে। বাস্তিলের পতন ফরাসি দেশের ইতিহাসে একটা স্মরণীয় দিন। এ ঘটনা থেকেই ফরাসি বিপ্লবের শুরু। বাস্তিলের পতন দিবসটি ফ্রান্সে ঘটা করে পালন করা হয়।
এবারের হামলাসহ ফ্রান্সে তিন তিনবার হামলা হলো। গত ৮ মাস আগে প্যারিসের হামলায় ১৩৫ জন লোক মারা গিয়েছিল। এবারের হামলায় কোনও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। ১৯ টনের একটি ট্রাক দীর্ঘ দুই কিলোমিটার বেপরোয়াভাবে জনাকীর্ণ সড়কে চালিয়েই এই লোকগুলোকে হত্যা করা হলো। ট্রাকের চালক তিউনিশিয়ার বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক। ৩১ বছর বয়স্ক বুহলেল ছিল মুসলমান। তার সঙ্গে আইএস- এর কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি। তবে বুহলেল এ শহরের একজন পেশাদার ট্রাক ড্রাইভার, পুলিশও তাকে চেনে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞেসও করেছিল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ড্রাইভার মোহাম্মদ লাওয়েজ বুহলেল বলেছিল, আইসক্রিম নিয়ে এসেছি, বিশ্রাম করছি। একদিন বিরতির পর আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। বলেছে ড্রাইভার বুহলেল তাদেরই লোক। দু’মাস আগে অবশ্য আইএস লরি চাপা দিয়ে দুশমন হত্যার পরামর্শ দিয়েছিল তার সমর্থকদের।

সন্ত্রাসের ব্র্যান্ড আইএস এখন কারও কারও চোখে বিদ্রোহের ব্র্যান্ড। যুবা বয়স রোমঞ্চকর। এ বয়সের যুবকেরা বিদ্রোহ করতে চায় বেশি। বাংলার অগ্নিযুগে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যারা কথায় কথায় বিদ্রোহ করতেন, তারা সবাই যুবা বয়সের লোক। সূর্যসেন, বাঘা যতিন, লোকনাথ বল, কল্পনা দত্ত সবাই যুবক-যুবতি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মুসলিম জাহানের কিছু যুবক-যুবতিও আইএস ব্র্যান্ডের ইসলামি বিপ্লবের শরিক হতে উৎগ্রীব হয়ে উঠেছে।

২০১৪ সালের জুন মাসে আবু বক্কর বাগদাদী যখন ঘোষণা দেন যে, তিনি ইরাক ও সিরিয়ার বিরাট এলাকা নিয়ে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তিনি নিজেই এ খেলাফতের খলিফা, তখন ইসলামি বিশ্বে কিছু সংখ্যক যুবা বয়সের মানুষের কাছে বিষয়টা এক রোমাঞ্চ হিসেবে দেখা দেয়। ইউরোপ থেকে শত শত যুবক এসে খেলাফতের সেনা বাহিনীতে যোগদান করে।

নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন উল্লেখ করেছে খেলাফতের বিস্তৃতি প্রায় ৩৫ হাজার বর্গমাইল, অর্থাৎ রাষ্ট্র হিসেবে জর্ডানের সমান। ইরাকের আনবার, সালাদীন, কিরকুক ও নিনেভাহ; সিরিয়ার রাকা, দিবুযার. এলজুর, হামাকা, আলেপ্পো এবং পালমিরা অঞ্চল প্রাথমিকভাবে খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই এলাকাগুলো খুবই দ্রুততার সঙ্গে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সাদ্দামের সেনাবাহিনীর বিতাড়িত লোকগুলো এসে খেলাফতের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। দেখতে দেখতে তাদের সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ৩০ হাজারে এসে দাঁড়ায়। খেলাফতের সেনা বাহিনীর মাঝে ১১ হাজার সাদ্দামের নিয়মিত বাহিনীর লোক ছিল, আর অবশিষ্ট ১৯ হাজার সৈন্য ছিল বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় থেকে এসে যোগ দেওয়া যুবাগোষ্ঠী।

কিছুদিন খেলাফতের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ইরাক আর সিরিয়ার সৈন্য দাঁড়াতেই পারেনি। এ চমক দেখে বিশ্বের বহু দেশ থেকে যুবা বয়সের লোকেরা এসে আইএস-এর সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিল। খেলাফত নিয়মিত উচ্চহারে সৈন্যবাহিনীর লোকজনের বেতন প্রদানের ব্যবস্থাও করেছিল। পরবর্তী সময়ে খেলাফত বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা ইরাকি অভিযানের এবং রাশিয়া-সিরিয়া বাহিনীকে এয়ার কাভারেজ প্রদান করেছিল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও ইরাক ও সিরিয়া থেকে খেলাফতিদের নির্মূল করা এখনও সম্ভব হয়নি। অবশ্য খেলাফতের আমিরুল মোমেনীন আবু বক্কর বাগদাদী নিহত হয়েছেন। তবে আইএস-এর অফিসিয়াল নিউজ এজেন্সি আমাক তাকে ১৪ জুন ২০১৬ তারিখে মৃত ঘোষণা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও এই মৃত্য সম্পর্কে নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছে। বাগদাদীর খেলাফতের যথেষ্ট জায়গা হাতছাড়াও হয়েছে। অনেকে নিজের দেশে ফিরে গেছে। যে কারণে এখন খেলাফতের সৈন্য সংখ্যা ১৯ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।
আবু বক্কর বাগদাদী ৩৫ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত জায়গা নিয়ে খেলাফতের যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন, আর ৩০ হাজার নিয়মিত সৈন্যের যে বাহিনী গঠন করেছেন এবং খেলাফতের অভ্যন্তরে যে যে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেছেন, তা খুবই দক্ষ ও সুনিপুণ। এসবই হচ্ছে খেলাফতের চমক। এ সবই বহির্বিশ্বের মুসলমান যুবগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করেছে খেলাফতের সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে। সপ্তম শতাব্দীর মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটিকে খেলাফত বলা হতো। এ নামটার প্রতি মুসলমানের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ ও দুর্বলতা রয়েছে। ১৯২২ সালে কামাল আতাতুর্ক যখন ওসমানিয়া খেলাফত উচ্ছেদ করে, তখন বিশ্বের বহু বিশিষ্ট ইসলামিক জগতের ব্যক্তিত্ব তাকে খেলাফত উচ্ছেদ না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কামাল আতাতুর্ককে যখন সিদ্ধান্তে অটল দেখলেন তখন তারা আহ্বান জানিয়েছিলেন, কামাল যেন নিজেই নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন এবং তুরস্ককে খেলাফত বলে আখ্যায়িত করেন। যারা এ আহ্বান জানিয়ে ছিলেন তাদের মাঝে ভারতের আগা খাঁন এবং জাস্টিস স্যার আমির আলীও ছিলেন।
আগা খাঁন এবং স্যার আমির আলীর মতো বিশ্ববরেণ্য মুসলমানের যদি খেলাফত নামক শব্দটির প্রতি দুর্বলতা থাকে, তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আবেগ জড়িত মুসলিম যুবাগোষ্ঠীর দুর্বলতা থাকাতো অস্বাভাবিক নয়। রাসুলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, খেলাফত ত্রিশ বছর। হযরত আবু বক্কর সিদ্দিকের (রা.) ইসলামি জগতের প্রথম খলিফা হিসাবে শপথ গ্রহণের দিন থেকে হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষে হযরত হাসান  (রা.)- এর খেলাফতের দাবি প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত সত্যি সত্যিই খেলাফতের বয়স ৩০ বছরের একদিন বেশিও নয়, একদিন কমও নয়। হযরত মুহাম্মদ (স.) সম্ভবতো ইসলামিক খেলাফত পরিচালনার জন্য হীরকখণ্ডের মতো যে সব কামেল ইনসানের প্রয়োজন, তার অভাব তার দিব্যদৃষ্টি দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই খেলাফতের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।
খেলাফতের পরিসমাপ্তির পর হযরত আমির মুয়াবিয়া (রা.) ৮ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তারপর তার ছেলে ইয়াজিদ উমাইয়া বংশের দ্বিতীয় আমির হিসাবে ক্ষমতায় বসেন। ইয়াজিদ সাহাবী ছিলেন এ কথা সত্য। হয়তো অনেকে মানবেন না কিন্তু ইয়াজিদের ব্যক্তিগত কার্যকলাপ ইসলামের ইতিহাসে বিতর্কিত। রাসুল (স.)- এর বিদায় নেওয়ার ৩৮ বছর পর ইসলামি জগতের যদি এ অবস্থা হয় তবে খেলাফতের সময়সীমা দীর্ঘ হয় কিভাবে? আব্বাসীয় খেলাফত বলুন, ওসমানিয়া খেলাফত বলুন আর আবু বকর বাগদাদীর খেলাফত বলুন– সবই খোলস। ইসলামের প্রথম খেলাফতের সঙ্গে এদের শাসন তুলনাই হয় না। প্রথম খেলাফতের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) দি গ্রেট রমজানে ইফতার করতেন ৪/৫ টি খুরমা খেঁজুর আর এক গ্লাস সাদা পানি দিয়ে, আর আব্বাসিয়া খেলাফতের খলিফা হারুন আল-রশিদের ইফতারি তৈরি করতে ১২ হাজার দিরহাম খরচ হতো। হযরত ওমর (রা.)-ও খলিফা, হারুন-আল-রশিদও খলিফা।

এতো কিছু আলোচনা করছি, ইসলামি জগতের যুবাগোষ্ঠীর বর্তমান সোর্স অব ইন্সপাইরেশন সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দেওয়ার জন্য। সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, সিরিয়া যদি বাগদাদীর খেলাফতের অবসান ঘটাতে না পারে তবে সোর্স অব ইন্সপাইরেশন তো অব্যাহত থাকবে। আশু কর্তব্য হলো এ খেলাফতের অস্তিত্ব পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করা। অবশ্য এখন নাকি খেলাফতের সৈন্য সংখ্যা ১২ হাজারে নেমে এসেছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক সুচতুর সাংবাদিক ইন্টারনেট ভিত্তিক অডিও সার্ভিসে এক খেলাফতির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তারাও নাকি স্বীকার করেছেন, তারা বহিরাগতদের আসতে নিষেধ করেছেন। তারাও খেলাফতের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ের মাঝে আছেন। অর্থবিত্ত নাকি অন্যত্র সরানোর কাজ আরম্ভ করেছেন। বিদেশিরা নাকি সিংহভাগ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। এখন প্রত্যেক দেশ স্বদেশে ফেরত যাওয়া খেলাফতি যোদ্ধাদের নিয়ে কিছু অসহনীয় অবস্থায় হয়তো পড়তে পারে। কিন্তু সেন্ট্রাল কমান্ড বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফেরত যাওয়া খেলাফতি যোদ্ধার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে ইউরোপে। সুতরাং ইউরোপকে আরও ২/৩ বছর বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

আরও খবর: ‘চিন্তা করো না, আমরা মুসলিম কান্ট্রিতে আছি’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জানাজা শেষে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত
জানাজা শেষে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত
কবিগুরুর  ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী: গঠিত হলো সোসাইটি, দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজন
কবিগুরুর ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী: গঠিত হলো সোসাইটি, দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজন
প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ শুরু
প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ শুরু
পিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগপিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ