X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

তাজউদ্দীন আহমদ: মিথ না রিয়েলিটি

শুভ কিবরিয়া
২৩ জুলাই ২০১৬, ১২:৩২আপডেট : ২৩ জুলাই ২০১৬, ১২:৪১

Shuvo Kibria বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাধীন দেশের প্রথম অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (২৩ জুলাই, ১৯২৫- ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫) স্বল্পায়ু জীবন পেয়েছিলেন। মাত্র ৫০ বছর বয়সে তার জীবন কেড়ে নেয় একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী। স্বাধীন দেশের কেন্দ্রীয় জেলখানায় সামরিক বাহিনীর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করে বুলেট ও বেয়নেটের খোঁচায়। তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন ছিল সেলফ-মেইড। তিনি আজীবন ছিলেন যুক্তিবাদী এবং বাস্তববাদী। জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর বিশ্লেষণের ওপর দাঁড়িয়ে জনসেবায় আত্মনিয়োগরত একটি কর্ম যে রাজনীতি, সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তাজউদ্দীন আহমদ।
তিনি আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন কিন্তু তার আদর্শবাদে কট্টরপন্থার জায়গা ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন সিভিল লিবার্টি বা মানবতাবাদে। গণতন্ত্র ছিল তার রাজনৈতিক আদর্শ। এক ধরনের জনগণতান্ত্রিক সমতাবাদী মানবিক সমাজ যাকে আজকাল ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ বলে অভিহিত করা হয়, সেই রকম শাসনতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন তিনি। গণমানুষের জীবন ছিল তার আজীবনের পাঠক্ষেত্র। এই ভূ-খণ্ডের মানুষের মনোজগতের গড়ন, তার জীবনাচরণ, তার সংস্কৃতি খুব ভালোভাবে জানতেন তাজউদ্দীন আহমদ। এই ভূ-খণ্ডের মানুষের ধর্মচারণ, ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মানুভূতিকে খুব নিবিড়ভাবে চিনতেন তিনি। তাজউদ্দীন আহমদের জনরাজনীতি ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি।
নিজে খুব মেথোডিক্যাল ছিলেন, ছিলেন নিয়মানুবর্তী। ব্যক্তিজীবনে সততা আর কর্মনিষ্ঠা ছিল তার শক্তি। এই ভূ-খণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসে বাঙালি রাজনীতিবিদদের মধ্যে এতো ‘র‌্যাশনাল’, এতো মেথোডিক্যাল, এতো সাংগঠনিক মানুষ খুব বড় একটা দেখা যায়নি। তিনি জ্ঞানকে রাজনীতির অন্যতম উপাদান মনে করতেন। রাজনৈতিক সংগঠনকে ভাবতেন দেশগড়ার একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। এই কারণে রাজনৈতিক সংগঠনে একল আদর্শবাদী, পরিশ্রমী, ত্যাগী, সৎ মানুষের সমাহার চাইতেন খুব করে। সমাজ-রাজনীতি-বিশ্ব ইতিহাস আর অর্থনীতির নিবিড় পঠন-পাঠন এবং তার নিরলস চর্চা তাকে সময়ের চাইতে এগিয়ে থাকা মানুষে পরিণত করেছিল।
তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে ছিল তাই অনেক মিথ। সত্যানুসন্ধান আর ন্যায্যতার প্রশ্নে তার অসম্ভব দৃঢ়তা তাকে প্রচলিত রাজনীতিবিদদের কাতার থেকে দূরে সরিয়ে একটা আলাদা প্রজ্ঞাবান নীতিনিষ্ঠ মানুষে পরিণত করেছিল। তাজউদ্দীন আহমদের জীবন তাই প্রচলিত ভক্তিবাদী-অসৎ-নীতিহীন, রাজনীতির সঙ্গে ছিল সাংঘর্ষিক। সে কারণেই নিজ দলে তো বটেই, নিজ সরকারেও তিনি খুব জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন না। তার এসব নীতিনিষ্ঠ গুণাবলি তার জন্য বিপদের কারণ হয়েছে বারবার। পরিশীলিত, পরিমার্জিত এবং সৎ রাজনীতিকে জীবনের অংশ ভাবতেন বলে, অপরাজনীতির সঙ্গে সংঘাতকে ভয় পাননি। আজও তাজউদ্দীন আহমদ তাই নিজদলে এক দূরবর্তী নাম।
দুই.

তাজউদ্দীন আহমদের এইসব চিন্তা-আদর্শের প্রভাব পড়েছিল তার কথা ও কাজে। ১৯৭৪ সালের বাজেট বিতর্কের সমাপনী অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী হিসাবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সংসদে তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু ভালো বক্তৃতা করে দেশের মানুষের মঙ্গল করতে পারবেন না। বক্তৃতা সত্যি হতে হবে। মানুষের সত্যিকার অবস্থা আগে তুলে ধরে তারপর প্রকৃত নির্দেশ দিতে হবে। এর নাম নেতৃত্ব। এটা খুবই কষ্টকর। কিন্তু সত্যিকার খায়েশ যদি হয়ে থাকে তা হলে তা করতে হবে। কিন্তু এছাড়া শুধু বক্তৃতা করে বেশি দিন নেতৃত্ব করা যাবে না।’

তাজউদ্দীন আহমদের এই কথা তখন অনেকের ভালো লাগেনি। কিন্তু অল্পদিনের দিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল তার কথার সত্যতা। তার দেওয়া ‘নেতৃত্বে’র সংজ্ঞা অনেককে বিব্রতও করে। ওই বছরের অক্টোবরে তাকে মন্ত্রীসভা থেকে সরতে বাধ্য করা হয়। বোঝা যায় তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক চিন্তা যে আদর্শের সঙ্গে যুক্ত তা অন্যদের চিন্তার সঙ্গে তখন সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছিল। তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রীত্ব ছাড়তে কার্পণ্য করেনননি কিস্তু আদর্শের পথ থেকে বিন্দুমাত্র সরে যাননি। আজও তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতির জগতে যে মিথ হয়ে আছেন তার কারণ তার এই অনড় নৈতিক অবস্থান।

তিন.

তিনি তখন অর্থমন্ত্রী। তার কাছে এলাকার নানারকম কাজের জন্য আসতেন তার নির্বাচনি এলাকার লোকজন। তাদের দাবি থাকতো এলাকার কাজটা অন্যদের আগে করে দিতে হবে। অর্থমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে, অন্য এলাকাকে প্রয়োজনে বাদ দিয়ে বা অন্য এলাকার বরাদ্দ কাটছাট করে কাপাসিয়া এলাকার উন্নয়ন দাবি করতো সে এলাকার জনগণ। এলাকার মন্ত্রী হিসাবে তার কাছে জনতার এই দাবি হয়তো অপ্রাসঙ্গিক ছিল না। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। ন্যায্যতার বোধ ছিল তার চিন্তা ও কর্মের মূল ভিত্তি। তিনি ভাবতেন অন্যভাবে। তার এই ভাবনার কথা বলেছেন সেসময় তার সাথে কাজ করা সচিব কফিলউদ্দিন মাহমুদ। কফিলউদ্দীন মাহমুদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘তিনি মুক্ত দৃষ্টি নিয়ে তার প্রশাসন চালাতেন। এলাকা থেকে মানুষজন এসে বলতেন, ওই জিনিসটা আমাদের এলাকার জন্য করিয়ে দেন। তখন তাজউদ্দীন আহমদ বলতেন, না না আমি তো সমস্ত দেশেরই মন্ত্রী। অতএব, আমার প্রতি আমার এলাকার যে দাবি আছে, সে রকম দাবি সমস্ত দেশেরই আছে। আমি সমস্ত দেশ থেকে আলাদা করে আমার নিজ এলাকার জন্য বিশেষ কিছু করবো, এ জন্য আমি মন্ত্রী হইনি। বরং সমস্ত দেশকে দিয়ে থুয়ে তারপর আমি নিজের এলাকার কথা চিন্তা করবো।’

আজ চিন্তক ও আদর্শবিবেচক মহলে তাজউদ্দীন আহমদ যে নতুন করে অলোচনার বিষয় হয়ে উঠছেন তার বড় কারণ হচ্ছে তার এইসব অসামান্য গুণাবলি। বিশেষত রাষ্ট্রভাবনার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা বিবেচনায় তার এসব কাজ ও কথা নতুনভাবে ভাবনার খোরাক জোগাচ্ছে।

চার.

তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক প্রচারণা হচ্ছে তার পশ্চিমা বিদ্বেষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি কঠিন শর্তযুক্ত পশ্চিমা দেশের ঋণ নিতে চাননি। বিশেষত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী আমেরিকার শর্তযুক্ত ঋণ নেওয়ার ফলে দেশে রাজনৈতিক বিপত্তি ঘটতে পারে এই আশংকা ছিল। তিনি ভাবতেন এই শর্তযুক্ত ঋণের আড়ালে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের আমদানি ঘটবে। এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত স্বপ্নবান আদর্শ ও চেতনা বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু শর্তহীন ঋণের ব্যাপারে তার কোনও আপত্তি ছিল না।

অন্যায্য কারণে আবেগতাড়িত আদর্শবাদেও তার ভক্তি ছিল না। এই বিষয়ে চমৎকার একটা বয়ান দিয়েছেন তার সাথে কাজ করা অর্থসচিব মতিউল ইসলাম।

তিনি বলছেন, ‘অনেকই বলে, তাজউদ্দীন সাহেব পশ্চিমা দেশগুলোর সাহায্য বা সহযোগিতা চাননি বা নেওয়া পছন্দ করতেন না। এটা কিন্তু আমি শুনেছি। অথচ অর্থ সচিব হিসেবে আমি কিন্তু কোনোদিনও তার এই মনোভাবের কোনও ইঙ্গিত পাইনি। তিনি খুব প্র্যাগম্যাটিক ছিলেন। আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে ভীষণ সজাগ ছিলেন এবং সেইসাথে সুচিন্তিত বাস্তবসম্মত কর্মপদ্ধতিরও মানুষ ছিলেন। তিনি বুঝতেন পশ্চিমের সাহায্য ছাড়া আমাদের চলবে না, সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। একটি বিষয়ে তিনি পাকিস্তান সরকারের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে আমার সুপারিশ নিয়েছিলেন।

যেমন একটি ঘটনার কথা বলি: জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি যিনি এখানে ছিলেন, উমব্রিখট্ তার নাম। সুইস নাগরিক। তিনি রিলিফের তদারকি করতেন। তিনি একই সঙ্গে সম্ভবত সুইস কোম্পানি সিবা-গেইগিরও প্রতিনিধি ছিলেন। আমি অর্থ সচিব হিসেবে যোগ দেওয়ার দিন সাতেক পর একদিন তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে ডাকলেন। গিয়ে দেখি দু’জন বিদেশি ভদ্রলোক বসা। তিনি তাদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এরা সিবা গেইগি থেকে এসেছেন। সিবা-গেইগি আমাদেরকে কীটনাশক দিয়েছিল, অর্থাৎ সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানকে। পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বিতরণের জন্য এখানে ওই কীটনাশক এসেছিল বাকিতে। এখন এরা এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে, যাতে করে সরকার সেই কীটনাশকের টাকা শোধ দেওয়ার দায়িত্ব নেয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমরা পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব নেব কী নেব না। আমি তখন বললাম, দেখুন এটা পলিসি ম্যাটার। তবে যদি কেউ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে কোনও কিছু দেয় সেটা পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই ছিল। অর্থাৎ আমাদের জন্যই দেওয়া হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে আমরা এই দায়িত্ব নিতে পারি।

তিনি বিষয়টি মেনে নিলেন এবং বললেন, আমরা পাকিস্তান সরকারের একমাত্র সেই সমস্ত দায়িত্বই নেব যা সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য আনা হয়েছিল বা ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় তাজউদ্দীন সাহেব কতখানি প্র্যাগম্যাটিক ছিলেন। তিনি বলতে পারতেন, আমরা পাকিস্তানের দায়িত্ব নেব না। আমরা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছি, আমরা কেন পাকিস্তানের দায়িত্ব নেব। কিন্তু তিনি তা বলেননি কিংবা সেই মনোভাব দেখাননি। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে যা হওয়া উচিত তিনি তাই করেছেন। একজন পরিপক্ব দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদের যা করা উচিত তিনি তাই করেছেন।’

পাঁচ.

তাজউদ্দীন আহমদ জনপ্রিয়তা চাননি, তা পানওনি। সহকর্মীরা তাকে শ্রদ্ধা করলেও বিপদের দিনে তার পাশে দাঁড়াননি। যে নৈতিক শক্তি ও মনীষাদীপ্ত প্রজ্ঞা থাকলে তাজউদ্দীন আহমদকে রাজনীতির কেন্দ্রে রেখে আলোচনা জারি রাখা যায় বাংলাদেশের রাজনীতি সেই মানে এখনও পৌঁছায়নি। সে কারণেই তাজউদ্দীন আহমদের অনেক গুণ, প্রজ্ঞা এবং কর্তব্য মিথের মতো শোনায়। সেই মিথ যে কতটা বাস্তব সেটা জানতে হলে তার কর্ম ও জীবন পাঠ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের এই দুর্দিনে সেই আশা খুব বিপুলতর নেই বটে কিন্তু একথা সত্য তাজউদ্দীন আহমদের চিন্তা এখন অনেককেই আকর্ষণ করছে। তরুণদের একটা অংশ এই ভাবনায় তাড়িত হচ্ছে। আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশকে যখন তার স্বপ্নের কাছে পৌঁছাতে হবে তখন তাজউদ্দীন আহমদকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ২৩ শে জুলাই তাজউদ্দীন আহমদের ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে তাকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও খবর: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি: ‘দাবি অযৌক্তিক, নষ্ট হবে শিক্ষার পরিবেশ’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
হামাসের সংশোধিত প্রস্তাব গাজায় যুদ্ধবিরতি অচলাবস্থা ভাঙতে পারে: যুক্তরাষ্ট্র
হামাসের সংশোধিত প্রস্তাব গাজায় যুদ্ধবিরতি অচলাবস্থা ভাঙতে পারে: যুক্তরাষ্ট্র
বৃষ্টিতে ভোটার উপস্থিতি কম নোয়াখালীর সুবর্ণচরে
বৃষ্টিতে ভোটার উপস্থিতি কম নোয়াখালীর সুবর্ণচরে
জানাজা শেষে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত
জানাজা শেষে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ