X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিতে সবাই নেতা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১১ আগস্ট ২০১৬, ১৩:০৯আপডেট : ১১ আগস্ট ২০১৬, ১৩:২১

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত ১৯ মার্চ ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বিএনপির একদিনের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন আর তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশিষ্ট পদগুলো পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বেগম জিয়াকে। দুই দফা বেগম জিয়া কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেছেন। সর্বমোট কমিটির সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৫৯২ জন। স্থায়ী কমিটি ঠিক রাখা হয়েছে। শুধু চারটি শূন্য পদে আমির খসরু মাহামুদ চৌধুরী ও সালাউদ্দীনকে মনোনীত করা হয়েছে। অবশিষ্ট দুই শূন্য পদে কাউকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। অনেকে বলছেন এ দুটা শূন্য পদে তারেক রহমানের স্ত্রী ও কোকোর স্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তারেক রহমানের ৭ বছরের জেল এবং ২০ কোটি টাকা জরিমানার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার দু’তিনটা মামলার রায় প্রদানের সময়ও প্রায় নিকটবর্তী। বেগম জিয়ারও জেল জরিমানা হতে পারে। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে জিয়া পরিবারের লোককেই দলের হাল ধরতে হবে নয়তো দলের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না। সুতরাং তাদের জন্য পদ দু’টি শূন্য রাখা অপরিহার্য।
তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান শিক্ষিত, ভদ্র এবং সিলেটের সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান। তার বাবা মাহাবুব আলী খাঁন বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি রাজনীতিতে আসলে তারেকের চেয়ে ভালো করবেন বলে বিএনপির অনেকের প্রত্যাশা। অনেকে বলেছেন দলের ঐক্যও অটুট থাকবে। সিনিয়র নেতারাও কেউ তাতে নাকি আপত্তি করবেন না। আপত্তি করলেও কেউ কোনও সুবিধা করতে পারবেন না।
ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি একবার কংগ্রেস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং নিজে একটা নতুন দলও গঠন করেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাস চেষ্টা করে একটা পূর্ণাঙ্গ কমিটি পর্যন্ত করতে পারেননি। পরে কংগ্রেসে ফিরে এসেছিলেন। সাংবাদিকেরা ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি সোজা-সাপ্টা বলেছিলেন নেহরু পরিবারের সঙ্গে থাকলে মন্ত্রী হওয়া যায়। এ উপ-মহাদেশের রাজনীতি পরিবার কেন্দ্রিক। ভারতের নেহরু পরিবার। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার, নেওয়াজ শরিফের পরিবার, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও জিয়া পরিবার। পাকিস্তানের নেওয়াজ শরিফ পরিবার আর বাংলাদেশের জিয়া পরিবারের কোনও ঐতিহাসিক গ্ল্যামার নেই কিন্তু কালে ভদ্রে তারা দুই ঐতিহাসিক পরিবার বঙ্গবন্ধু আর ভুট্টো পরিবারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং গত ৪০ বছরব্যাপী টিকেও আছে। তাতে কেউ আপত্তি করলেও তো তাদের অবসান হচ্ছে না।
জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর নিজেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনীতির গুণগত মানটাই বিনষ্ট করে ফেলেছেন। রাজনীতি নীতিও আদর্শের বিষয়। রাজনীতিতে নীতি আদর্শ বিতাড়িত হলে সে রাজনীতি দিয়ে আর মানুষের কল্যাণ করা যায় না। জিয়াউর রহমান এমন জৌলুসের রাজনীতি জন্ম দিয়ে গেছেন যেখানে ত্যাগের কোনও শিক্ষা ছিল না, ছিল শুধু ভোগই ভোগ।
খাড়া দলিল করে গুলশানে বাড়ির মালিক হওয়া তার মন্ত্রীর আদর্শ। আবার অভিযোগের সুরে বলেন, রাজনীতিতে তাকে কোনঠাসা করার জন্যই এইটা সরকারের ষড়যন্ত্র। যে আমোক্তার নামা বলে তিনি বাড়ির মালিক হয়েছেন সে আমোক্তারনামা দাতা আমোক্তার নামায় দস্তখত করার বহু আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। এ সত্য প্রমাণিত হওয়ার পরও তিনি বলছেন এটা সরকারের ষড়যন্ত্র। নিজেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই জিয়াউর রহমান এসব জ্ঞান পাপীকে রাজনীতিতে এনেছিলেন।

কমিটি ঘোষণার পর মিডিয়ায় দেখেছি, অনেকে বলছেন ত্রিশ বছর বহু ত্যাগ স্বীকার করেছি কিছুই পেলাম না। গত শতাব্দীর ছয়দশক থেকে পরিপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে এদেশের সব অবলোকন করে আসছি। বিএনপি বলুন, ছাত্রদল বলুন, যুবদল বলুন-  সবাই যেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি- বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের হিজবুল বাহার নামে একটা জাহাজ ছিল। হজের মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে জেদ্দায় হাজি পরিবহন করতো। এ জাহাজটিকে প্রমোদতরী বানিয়ে তিন-হাজার ছাত্র-ছাত্রী যুবক-যুবতীকে চারদিনের জন্য বঙ্গোপসাগরে প্রমোদ ভ্রমণে পাঠিয়ে জিয়া ছাত্রদল গঠন করেছিলেন। সেখানে গায়ক-নায়ক সবই ছিল। শুধু দশ হাজার কোটা নাকি টাইগার বিয়ার ছিল। তারাই যদি বলে বহু ত্যাগ স্বীকার করেছি তবে দলের উদ্যোক্তা পরিবারের দুঃখ রাখার জায়গা থাকবে না।

দাউদকান্দির এক সাবেক মন্ত্রীর গল্প করে দাউদকান্দির লোকেরা। তিনি জিয়ারও মন্ত্রী ছিলেন। বেগম জিয়ারও মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তার নামে বা তার বাবার নামে নাকি একটা ৫ কাঠা জমিনের খতিয়ান দেখাতে পারবেন না অথচ দাউদকান্দির লোকদের কথা মতো তার নাকি বর্তমানে সম্পদ আছে এক হাজার কোটি টাকার। অবশ্য তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাও আছে। দীর্ঘদিন জেলে ছিল এখন জামিনে বের হয়ে এসেছেন। বাটি চালান দিয়েও দলটাতে একটা সৎ নেতা পাওয়া মুশকিল হবে। সবার চরিত্র জিয়াই বরবাদ করে দিয়ে গেছেন।

এখন পয়সা ছাড়া রাজনীতিতে পা বাড়ানোই মুশকিল। ছোট খাট দলগুলো টাকার অভাবেই দাঁড়াতে পারছে না। রাজনীতির এ বিনাশের জন্য জিয়াউর রহমান দায়ী। এখন আর একটা বিনাশ করলেন বেগম জিয়া। কমিটির সর্বমোট সদস্য সংখ্যা ৫৯২ জন। সবাই নেতা হতে চায়। সুতরাং সবার মন রক্ষা করতে না পারলে নেতা কর্মীরা রাগ করবেন তাই কমিটি এতো বড় করতে হলো। এর প্রতিক্রিয়াতো অন্যান্য দলের ওপরও পড়বে। এই উপমহাদেশে দলীয় রাজনীতি আরম্ভ হয়েছে ১৮৮৫ সাল থেকে, ভারতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে। গত ১৩১ বছরের মাঝে এতো বড় কমিটি কোনও রাজনৈতিক দলের হয়েছে বলে ইতিহাসে প্রমাণ নেই। নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিলেন বেগম জিয়া।

চট্টগ্রামের আব্দুল্লাহ্ আল-নোমানকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করেননি। পত্রিকায় দেখলাম তিনি চলে যাবেন। বিএনপি দলটির মাঝে তিনি আর তরিকুল ইসলমাই প্রকৃতভাবে রাজনৈতিক কর্মী। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসছেন। ভাসানী ন্যাপ, ইউপিপি ইত্যাদি করে শেষ পর্যন্ত বিএনপিতে আসলেন। দুইবার মন্ত্রীও হয়েছেন। নোমান ভাইয়ের বয়স এখন ৭২ বছর। এরমাঝে ১০ বছর মন্ত্রীত্ব করেছেন। একটা দল থেকে আর কী পাওয়ার থাকে। স্থায়ী কমিটির সদস্য না করলে চলে যেতে হবে এটাতো একটা অরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। স্থায়ী কমিটির সদস্য না হলে কি রাজনীতি বা দেশ সেবা করা যায় না! গান্ধী ১৯৩০ সালের পর কংগ্রেসের দু-আনার সদস্যও ছিলেন না।

ইতিহাসে সব জাতি দুর্গম পথ দিয়ে দুর্লভ জিনিস পেয়ে থাকে। আমরা আমাদের দুর্লভ ধন স্বাধীনতা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্গম পথ বেয়ে। এতে বঙ্গবন্ধু যে শতাংশের সমর্থন পেয়েছিল তা নয়, অবশ্য সিংহভাগ মানুষের সমর্থন তার প্রতি ছিল। যারা সমর্থন করেনি তারা গত ৪০ বছরে সুসংগঠিত হয়ে এখন প্রতিশোধ নিতে উদত্ত। বাংলাদেশের সব অর্জনকে এখন তারা ছারখার করে দিতে চায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে সুসংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। বেগম জিয়াও তা অব্যাহত রেখেছিলেন। নতুন কমিটি নিয়ে যাত্রালগ্নে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কী পুরানো পথে হাঁটবেন না বিএনপির নতুন রাজনীতির নকসা করে চলবেন। তিনি এরই মাঝে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে বুঝেছেন স্বাধীনতার পক্ষের কোনও প্রগতিশীল শক্তিই তার ডাকে সাড়া দেবেন না। মনে হয় এ ঘটনাটা তার বোধ উদয়ের জন্য যথেষ্ট হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

আরও খবর: সাংবাদিকের হাত কেন দড়িতে বাঁধা?

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ