X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাউন্টার ন্যারেটিভস

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৭ আগস্ট ২০১৬, ১১:৪৯আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০১৬, ১২:০১

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা হলি আর্টিজান হামলার এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। আতংক কমেছে, তবে পুরোপুরি কমেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর। একের পর এক সাফল্য আসছে। হামলার আসল হোতারা চিহ্নিত হয়েছে, বলা হচ্ছে তারা গোয়েন্দা জালেই আছে। জেমএমবি’র নারী কমান্ডারসহ ক্যাডাররাও গ্রেফতার হয়েছে।
বেশ একটা সময় পার হলেও গণমাধ্যমে এখনও জঙ্গি আলোচনাই বেশি। পত্রিকা ও অনলাইনের মন্তব্য কলামে, টেলিভিশন টকশোতে যে কথাটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো, জঙ্গি মতবাদের পাল্টা আদর্শ বা কাউন্টার ন্যারেটিভসকে জোরালো করতে হবে। এটাও সবাই বলছে যে, এই সমস্যা ঢাকা কিশোরগঞ্জের যেমন, তেমনি সমস্যা নিউইয়র্ক, লন্ডন, মাদ্রিদ বা প্যারিসেরও। তথাকথিত জেহাদি হামলায় আজ তটস্থ, সন্ত্রস্ত বিশ্ব।
রাজনৈতিক ইসলামের জঙ্গি, ওয়াহাবি-সালাফি জেহাদ বিপন্ন করে তুলেছে আমাদের জীবন। বিষয়টি এতটাই ভয়ংকর যে আসছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও মুসলিম বিষয়টি এখন একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিউইয়র্কে একজন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত ইমামকে তার সহযোগীসহ হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। তবে এর মধ্যেই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের ইমিগ্র্যান্টরা বলতে শুরু করেছেন এটি আসলে হেট ক্রাইম বা মুসলিম বিদ্বেষ। সমস্যা ইউরোপেও। ইউরোপের দেশে দেশে বসবাসকারী লাখ লাখ মুসলিমের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হচ্ছে সন্দেহ, বিদ্বেষ, জাতি-ঘৃণা। যে উদারনীতি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন মারফত পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে অগণিত মুসলিম ও প্রাচ্যদেশীয়ের ভাগ্য পরিবর্তনে উৎসাহিত করেছিল, তা সঙ্কুচিত করে পুবের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠতে শুরু করেছে দক্ষিণপন্থীদের দিক থেকে।
কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে ‘শার্লি এবদো’, প্যারিসের নাইট ক্লাব বা নিস শহরে যে বর্বরোচিত হামলা হয়েছে, সেসবের প্রতিবাদে দেশটি বা বিশ্বের পথে পথে যে মানুষের প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ তাতে পা মিলিয়েছেন এবং মিলিয়ে চলেছেন বহু মুসলমানও।

এই অবস্থা বাংলাদেশেও। হলি আর্টিজানে বেছে বেছে বিদেশিদের হত্যা করা হয়েছে। আবার খুন হয়েছে এদেশের নাগরিক এবং মুসলমানও। এর আগে লেখক, পুরোহিত, সেবা,  ব্লগার, খ্রিস্টান, শিয়া এবং আহমদিয়া। কিন্তু খুন হয়েছেন ধর্মপ্রাণ মানুষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম এবং বেশ ক’জন পীর।

জঙ্গি আতংক গ্রাস করেছে আমাদের। আমাদের মাদ্রাসা পড়ুয়া, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী, ধনীর দুলাল, দরিদ্র কিশোর আর তরুণ কি এক মায়ায় আজ এক ছাদের নিচে বসে নিষ্ঠুরতম পন্থায় মানুষ খুনের তালিম নিচ্ছে। ভয়ংকর দুঃসময় তাই দেশের জন্য। এমন এক বাস্তবতায় কথা উঠেছে এই পাল্টা মতাদর্শকে জাগিয়ে তোলার।

প্রশ্নটা আজ এ কারণে উচ্চারিত যে, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার পরিবারসহ হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীতে। ১৯৯৬ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা সবাই ছিলেন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারিগর।

অতীত নিছক অতীত নয়, তার সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপটেই ভবিষ্যতের মুকুল। ১৯৭১ যেমন এক ইতিহাস, তেমনি ১৯৭৫-ও। আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সময়টাও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে ২১ আগস্ট-এর মতো নিকৃষ্টতম হত্যাযজ্ঞ রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে হয়েছে, দেশের মানুষ উগ্র সাম্প্রদায়িকতার রূপ দেখেছে। বাংলাদেশের অতীত অসাম্প্রদায়িকতার, বহুত্ববাদের। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের, নানা ধর্ম চর্চার। কিন্তু তবুও বারবার এখানে নানা কারণে উগ্রবাদী ধর্মীয় সংকীর্ণতা আমাদের আঘাত করেছে।

কাউন্টার ন্যারেটিভস নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন প্রসঙ্গ উঠে আসে হিন্দু-মুসলমান বিভেদের। এখনতো শুধু বিষয়টি হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বা মনস্তত্ব নয়। উদারতার সঙ্গে, আলোকিত পথের সঙ্গে, পাকিস্তানি ধারা, আরও উগ্রতার ধারায় পরিচালিত অন্ধকারের শক্তির দ্বন্দ্ব। অনেকেই বলেন সাম্প্রদায়িকতার বীজ সমাজের মধ্যে ছিল বলেই ১৯৭৫ পরবর্তী শাসকেরা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এই সমাজ বাস্তবের সুযোগ নিয়েছিল। সঙ্কীর্ণ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চিরায়ত। তবে একথাওতো সত্য যে, সংহতি ও সমন্বয়ের এক বৃহৎ চিত্র এদেশে ছিল। আমাদের সমাজে নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য ছিল, সেই ঐতিহ্য শান্তিপ্রিয় মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি। এটা যতটা ধর্মের ব্যাপার, তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনধারার।

প্রশ্ন হলো আমরা প্রগতি, শান্তি আর চিরায়ত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো কি? জামাতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ উগ্রবাদীদের ঘোষিত লক্ষ্য এ দেশে কট্টর মুসলিম ছাড়া বাকিদের হত্যা করা। এই দৃষ্টিভঙ্গির গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করার লড়াই এখন সবার সামনে। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, ধর্মীয় হিংসা বরদাস্ত করা হবে না। গুরুত্বপূর্ণ তার এই ঘোষণা। কিন্তু এখন শুধু বক্তৃতা নয়, শাসক দল এই ভাবনাকে কতটা বাস্তবায়িত করবে, সেটাই হচ্ছে বিচার্য বিষয়। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি করার যে লড়াই সেখানে তারাই অগ্রবর্তী সৈনিক।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত। সেটিও কী কারণ তবে অর্থ বছরের প্রথম দিন, পহেলা জুলাই এমন আঘাত করার? ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে উন্নয়ন যে ব্যাহত হয় সেকথা আমরা জানি। জানে না বা জেনেও এমনটা করছে একটা শক্তি যারা এদেশটি চায়নি ১৯৭১-এ। ধর্মীয় বিভাজন রোখা না গেলে উন্নয়নের গতি স্তব্ধ হতে বাধ্য। সুকৌশলে  সে কাজটিই আসলে শুরু করেছে সেই মহলটি।

সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলে টের পাওয়া যায় সন্ত্রাসী ও জঙ্গি মতাদর্শ কতটা বিস্তৃত। অনেক আলোচনাতেই দেখা যায় উদারতার কথা বলা মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ভাবটা এমন যে যেন অন্য কোনও মতামত থাকা বা ইসলামের বাইরে অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়াটা অপরাধ।

অন্তরের সম্পদই আসল সম্পদ, একথা বলার সময় এখন। বলতে হবে সবখানে। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার কাজটা করতে হবে আমাদের। আর তার ভিত্তিটা হবে মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ ততক্ষণই সফল, যতক্ষণ না সে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে।

হলি আর্টিজানের ঘটনার পর একথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় যে, সাধারণ মানুষ উগ্র ও জঙ্গি সাম্প্রদায়িক ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে। উগ্রবাদীদের সঙ্গে বাস করা কোনও ঐক্যের ডাকে নয়, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে বহুদূর পালাবে সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

আরও খবর: নব্য জেএমবি: এক জঙ্গি ২২ হামলায় জড়িত!

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ