X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গেরিলা নেতা: নেপালের ক্ষমতায় টিকবেন?

শুভ কিবরিয়া
১৯ আগস্ট ২০১৬, ১২:২০আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০১৬, ১২:৩২

শুভ কিবরিয়া দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক অস্থির সময় অতিবাহিত করছে হিমালয়কন্যা নেপাল। মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে রাজতন্ত্রের অবসানে এক গণতান্ত্রিক নেপালের উদ্ভব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। উত্তরে চীন এবং দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে ভারতকে নিয়ে নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান। গত কয়েক বছর ধরে সে দেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে সংকট অব্যাহত ছিল। বহু পালাবদল আর বিতর্কের মধ্য দিয়ে নেপালের সংসদ একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হলেও দেশে স্বস্তি ফিরে আসেনি। এ সংবিধান নিয়ে খুশি নয় পাশের ‘বিগ-ব্রাদার’ ভারত। বিক্ষুব্ধ ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন নেপালের দক্ষিণের সমতলভূমির মানুষও। নেপালের দক্ষিণের তরাই অঞ্চলের মাধেসী ও থারু জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীরা এই নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে তাদের ক্ষুব্ধ সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
পরবর্তীতে তা অবরোধের রূপ নিলে নেপালের দক্ষিণাঞ্চলের ভারত-নেপাল সীমান্ত পথে ভারত থেকে আসা জ্বালানিসহ সকল পণ্য আটকে দেওয়ায় এক বৃহত্তর সংকটে পড়ে নেপাল। জ্বালানি তেলের সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট নেপালকে অস্থির করে তুলে। বছরখানেক আগেকার ভয়াবহ ভূমিকম্পের আঘাত সামলে উঠতে না উঠতেই এই নতুন সংকট নেপালকে বড় বিপদের মধ্যে ফেলে। এর প্রতিঘাত পড়ে নেপালের রাজনীতিতেও। টালমাটাল হয়ে ওঠে নেপালের সরকার। চীনের প্রতি ঝুঁকে ভারতের বিরাগভাজন হয়ে নিজের  জাতীয়তাবাদী ইমেজ তৈরি করেও শেষ রক্ষা হয় না প্রধানমন্ত্রী খাদগা প্রসাদ শর্মা অলি’র। মাত্র নয় মাসের মাথায় তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ওঠে।
দুই.
সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব নেওয়ার তোড়জোড় করতেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে বসেন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। মাধেসি সম্প্রদায়ের দাবির মুখে অনড় ছিলেন অলি। তাই সংকট কাটেনি। ভারত-নেপাল সীমান্তে দীর্ঘদিনের অবরোধ ভূমিকম্প বিধ্বস্ত দেশটিকে ফেলে ভয়ংকর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে। এ ক’মাস ভারতবিরোধী মনোভাবের জিকির তুলেও টিকতে পারেননি কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট) সংক্ষেপে সিপিএন (ইউএমএল)-এর নেতা কে পি শর্মা অলি । ৬০১ আসনের নেপালি সংসদে ১৭৫ আসন নিয়েও কেপি শর্মা অলির নয় মাসের শাসনের অবসান ঘটে।
২০০৮ সালে কনস্টিটিউয়েন্স অ্যাসেম্বলি গঠিত হওয়ার পর তাই ৮ বছরে নবম প্রধানমন্ত্রীকে দেখল নেপাল। সংসদে মাত্র ৮০ আসন পাওয়া কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওইস্ট সেন্টার) বা সিপিএন (এম-সি) নেতা পুষ্পকমল দহল জনারণ্যে যিনি প্রচণ্ড নামে অভিহিত, তিনিই সবার সম্মতিতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন ৪ আগস্ট ২০১৬ তারিখে। এর আগেও সাবেক এই মাওবাদী গেরিলা প্রচণ্ডের অভিষেক হয়েছিল ক্ষমতার মসনদে। ১৮ আগস্ট ২০০৮ থেকে ২৫ মে ২০০৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তৎকালীন সেনাপ্রধানকে বরখাস্তের জের ধরে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয় সেসময়। রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতায়  জনরায় পেয়েও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারেননি তিনি। কিন্তু এবার তার সেই সাধ কি পূর্ণ করতে পারবেন সাবেক এই গেরিলা নেতা?
তিন.
দুর্ভাগ্য নেপালি জনগণের। দ্রুত রাজা বদল হচ্ছে কিন্তু রাজ্যের জনমানুষের দুর্ভোগ কমছে না। জনগণের সমস্যা সমাধানের চাইতে রাজনৈতিক মিউজিক্যাল চেয়ার খেলতেই ব্যস্ত এখানকার রাজনৈতিক দলের নেতারা। নেপালি কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি আর মাওবাদীরা ক্ষমতার চেয়ার বদল করছেন বারবার কিন্তু দূর হচ্ছে না জনদুর্ভোগ। বরং তা বাড়ছেই। ৮ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটানো নেপালির ভূমিকম্পের ক্ষতি এখনো কাটানো যায়নি। লক্ষাধিক লোককে এখনও ঘরে ফেরানো যায়নি। ভূমিকম্পে ক্ষতির মুখে পড়া অবকাঠামো, অর্থনীতি সাবেকি চেহারা পায়নি এখনও। নতুন সংবিধানের সবটুকু এখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি। এর মধ্যে প্রান্তিক, সমতলভূমির থারু ও মাধেসী সম্প্রদায়ের দাবিরও সুরাহা হয়নি। নেপালের প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যবদল হচ্ছে না বটে কিন্তু বারবার হাতবদল হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতার।
চার.
কিন্তু নেপালে এতো রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটছে কেন?
চীন ও ভারতের মতো দুই বড় নিকট প্রতিবেশীর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সইয়ে ছোট দেশ নেপাল কি নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে? নেপালের রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণটাও এখানেই নিহিত।
গেরিলা নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ড প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী যখন হন তখন সংসদ নির্বাচনে গরিষ্ঠতা পেয়েও টিকতে পারেন নাই অনভিজ্ঞতায়। বিশ্লেষকরা বলেন তার এই অনভিজ্ঞতা ছিল মূলত ভারত ও চীনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতায়। এবার নেপালি কংগ্রেসের সহায়তায়, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির নিঃশব্দ সমর্থনে, সংসদে মাত্র ৮০টি আসন নিয়েও সব সমস্যা সমাধান করবেন এই প্রত্যয়ে প্রচণ্ড যে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন তার পেছনে রয়েছে ভারতের সমর্থন। যারা পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ডের মাওবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিবৃত্ত জানেন তাদের মত হচ্ছে প্রচণ্ডের এই ভারত কানেকশন পুরনো। গেরিলা যুদ্ধের সময়েও তিনি ভারতের রাজনৈতিক-আর্থিক সমর্থন পেয়ে এসেছেন। আজকে নেপালের রাজনীতিতে পুরনো ভারতপন্থী বলে পরিচিত নেপালি কংগ্রেস কিংবা নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি যখন ভারতের হাতছাড়া হয়ে নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাবকেই উসকে দিচ্ছে, তখন ভারতের রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট মাওবাদি গেরিলার তকমা পরা পুরনো বন্ধু পুষ্প কমল দহরকেই রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরিয়ে আনলো। এখন দেখার বিষয় এই রাজনৈতিক গুটি চালাচালি শেষে কতটা সাফল্য পায়।
নেপালের রাজনীতিতে চীন, ভারত উভয় দেশই বড় ফ্যাক্টর। সাম্প্রতিক সময়ে মাধেসীদের দ্বারা অবরোধ চলার সময় ভারত থেকে যখন জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য সামগ্রি আসা যখন বন্ধ ছিল তখন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি চীনের সঙ্গে ট্রেড অ্যান্ড ট্রানজিট চুক্তি করে বিকল্প পথে এই সংকটের সমাধানের উদ্যোগ নেন। নেপালের পোখরায় আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর তৈরি সহ বেশ কিছু জলবিদ্যুত প্রকল্প তৈরির বিষয়ে চীনের আগ্রহে সম্মতিও দেন তিনি । ভারতের সংগে বৈরী সম্পর্কের এই উত্তাল সময়ে নেপাল -চীন সুসম্পর্কের এই সোহাগ সময়ের সূত্র ধরেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপাল সফরের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার চার মাস পরেই নেপালের সরকার পরিবর্তন হয়।
পাঁচ.
ভারতের প্রতি বিদ্বেষ আর চীনের প্রতি সহৃদয় নেপালের জনমতকে নিজেদের অনুকূলে আনতেই এক সমম্বয়বাদি রাজনীতির আশ্রয় নেয় ভারত। তার ফলাফল হচ্ছে মাওবাদি গেরিলা নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ড’র নেপালের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়া। এখন নেপালের সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চীনকে আস্বস্থ ও আস্থায় রাখা। কেননা সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই চীনের প্রেসিডেন্টের নেপাল সফর অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। চীনের দিক থেকে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে  নেপাল-চীন দুই দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে কীনা সেটা নিশ্চিত হওয়া। দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ কতটা অবিকৃত থাকে সেটা সুনিশ্চিত হওয়া। অন্যদিকে তিব্বতের প্রায় ২০ হাজার রিফিউজি নেপালে অবস্থান করছে। এদের কর্মকাণ্ড চীনের স্বার্থবিরোধী হয়ে ওঠে কী না সেটাও চীনের জন্য উদ্বেগের। এই বিষয়ে সচেতন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড ক্ষমতা পেয়েই চীনকে আস্বস্থ করতে সেদেশে তার বিশেষ দূত পাঠিয়েছেন। প্রচণ্ড চান চীনের প্রধানমন্ত্রীর পূর্বনির্ধারিত নেপাল সফর যেন বহাল থাকে। অন্যদিকে ভারতকেও তিনি খুশি রাখতে চান। সেকারণেই প্রথম বিদেশ সফর হিসাবে ভারতেই যেতে চান নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী। কেননা  প্রচণ্ডের মূল লক্ষ্য ভারতপক্ষকে না চটিয়ে চীনকে নমনীয় রাখা।
ছয়.
নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ডের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ পরবর্তী নির্বাচনের আগে পর্যন্ত সময়ে এই সরকারকে টিকিয়ে রাখা। এক্ষেত্রে নিজ দেশে মাধেসী সম্প্রদায়ের দাবি দাওয়া নির্ধারিত সময়ে মানার কাজটি শেষ করতে হবে। আবার এই কাজ করতে যেয়ে নেপালের মূল ভূ-খণ্ডের জনগণ যাতে বঞ্চিত না হয় সেটা নিশ্চিত করাও খুব জরুরি। নেপালের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার একটা বড় কাজ। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির শিকার যারা হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন করাটাও একটা কঠিন সমস্য। মাওবাদী ক্যাডারদের সমাজে পুনর্বাসন অতীতেও প্রচণ্ডের জন্য ছিল একটা জটিল কাজ। এবার সেটা কিভাবে সামলান সেটাও দেখার বিষয়। সংসদে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও সংখ্যাগুরু অন্যান্য দলের মনোবাসনা পূর্ণ করতে হবে প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডকে। সবচেয়ে বড় কথা ভারত ও চীনের প্রভাবকে ব্যালেন্স রাখতে না পারলে প্রচণ্ডের পক্ষে টিকে থাকা হবে খবই মুশকিল। এক সময়ের গেরিলা নেতার এই ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন কতটা টেকসই, কতটা সহনীয় হয় ---- কতটা মুন্সিয়ানার সাথে রাজক্ষমতাকে তিনি পরিচালনা করতে পারেন দেখার বিষয় এখন সেটাই।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও খবর: পাঁচ ত্রুটিতে নিজামীর প্লট বাতিল

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ