X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

'হত্যা-খুনে’ই সুবিচার!

শুভ কিবরিয়া
০১ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৩৩আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৩৫

শুভ কিবরিয়া রাষ্ট্র বা সমাজে অপরাধ প্রবণতা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আবার সেই অপরাধ নিবারণেই রাষ্ট্রে থাকে আইন, বিচার, শাস্তি। সভ্যতার যত অগ্রগতি হয়েছে, ততই এসব আইন, বিচার প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিবেচনা মানুষ গ্রহণ করেছে। আইনের চোখে চূড়ান্তভাবে অপরাধী প্রমাণিত হলেও সব মানুষেরই অধিকার আছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাওয়ার। এই মানবাধিকার বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়েই নতুন নতুন অপরাধকে মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন আইন, শাস্তি এবং বিচারের প্রক্রিয়া। তবু অনেকে আছেন, যারা ভাবেন এই অপরাধ তদন্ত, বিচার, শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সুদীর্ঘ। এই প্রক্রিয়ায় অপরাধীকে শাস্তি দেওয়াটাও কঠিন। অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়াটাকেও অনেকে মনে করেন বাতুলতা। এই মতের যারা সমর্থক তাদের মধ্যে যারা গোঁড়া বা মৌলবাদী কট্টর চিন্তা করেন, তারা বিচার-আইন-মানবাধিকারকে থোড়াই কেয়ার করেন। তারা ভাবেন অপরাধের নিরাময় হলো তাৎক্ষণিক ‘হত্যা’র ব্যবস্থায়। বিচারবহির্ভূত হত্যা বা এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়েই তাদের আগ্রহ।
এই বিচারবহির্ভূত হত্যার একটা তাৎক্ষণিক প্রভাব আছে অপরাধ জগতে। এই প্রবণতায় কথিত অপরাধীদের তাৎক্ষণিক হত্যা করা যায়। তাতে অনেক সময় সাধারণ মানুষ খুশিও হয়। তাই অনেক দেশে, অনেক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যার সমর্থনও জোটে জনগণের কাছ থেকে। অপরাধীদের অপরাধ কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট জনগণের কাছে তখন ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’কে মনে হয় উপশম। এই বিবেচনায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকারী বাহিনী, সংস্থা বা ব্যক্তি অভিনন্দিত হন। এই কৃতিত্বকে সুবিচার ঠাওরে মানুষ অনেক সময় বাহ্‌বাও দেয়। সুযোগ পেলে হত্যা-খুনে কথিত সুবিচার দেওয়া নেতাটিকে মাথায় তুলেও নাচে আমজনতা। মানুষের এই তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বহুজনকে উৎসাহিত করে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’কে সাধারণ প্রবণতা হিসেবে ব্যবহার করতে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রিক পর্যায়ে এরকম একজন জনপ্রতিনিধির দেখা মিলেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা-খুনকে নিরাময় আর অপরাধ প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করেই যিনি উঠে এসেছেন বিশ্বব্যাপী আলোচনায়। তার নাম রদরিগো দুতের্তে। যিনি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আর নানারকম অপ্রাতিষ্ঠানিক মন্তব্য করে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছেন। যাকে এখন চিহ্নিত করা হয়েছে, ‘দ্য পানিশার’ হিসেবে। যিনি সগর্বে ঘোষণা করেছেন তার প্রেসিডেন্টকালীন শাসন হবে ‘রক্তাক্ত’।
দুই.

ফিলিপাইনে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এক সাহসী নাম রদরিগো রোদি রোয়া দুতের্তে। জন্ম ২৮ মার্চ ১৯৪৫। সাধারণের কাছে যিনি ‘দিগং’ নামে পরিচিত। ফিলিপাইনের ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। ৯ মে ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৯.০১ শতাংশ ভোট পেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ৬০ লাখের ওপরে ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছেন। ফিলিপাইনে তিনি খ্যাত অবৈধ মাদক ব্যবহার, মাদক বিক্রি, মাদক চালানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে। মাদক ব্যবহারকারী, মাদকব্যবসায়ী, মাদক সরবরাহকারীদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যাই হচ্ছে রদরিগো দুতের্তের কৌশল। ৩ হাজারের ওপর মানুষকে এই প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। রদরিগো দুতের্তে নির্বাচনকালীন প্রচারাভিযানকালে কথা দিয়েছিলেন, ‘মাদক গ্রহণকারীরা সবাই কুকুরের বাচ্চা। আমি সত্যি সত্যিই তোমাদের হত্যা করব।’ তার নির্বাচনি প্রচারাভিযানকালে প্রচারণা ছিল মাদকবিরোধী যুদ্ধে প্রয়োজনে ১ লাখ ক্রিমিনালকে হত্যা করা হবে। এই প্রচার মানুষকে প্রভাবিত করে। ফিলিপাইনের ৩৯% ভোটার তাতে অনুপ্রাণিতও হয়। বিশেষ করে তিনি যখন নির্বাচনি প্রচারণায় জোর দিয়ে বলেন, ‘নিজের সন্তানকেও যদি মাদক গ্রহণ করতে দেখি, তাকেও বিনাবিচারে স্পটেই খুন করে ফেলব।’

তিন.

রদরিগো দুতের্তে ফিলিপাইনের মিন্দানাও দ্বীপের দাভাও সিটির মেয়র হিসেবে ৭ মেয়াদে প্রায় ২২ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন । পেশায় আইনজীবী দুতের্তে সেখানকার সহকারী মেয়র এবং কংগ্রেসমেন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বলা যায় দাভাও সিটিতে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং খুন’কে সেখানকার অপরাধ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেই তিনি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

প্রেসিডেন্ট দুতের্তে প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণের দিনটিতে পুলিশ অফিসারদের বলেছিলেন—দায়িত্ব পালনকালে যদি তাদের এক হাজার লোককে হত্যা করতে হয়, তিনি তাদের স্বার্থ দেখবেন।

দুতের্তের আমলে মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর এখন সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ১০ মে ২০১৬ দুতের্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মাদক কারবারে জড়িত সন্দেহে ১৫০৬ জন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। অধিকাংশ হত্যাই পুলিশের হাত দিয়ে হয়েছে। আবার কিছু কিছু হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রকে সহায়তা পাওয়া অজ্ঞাতনামা ঘাতকদলও করেছে। নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই মাদক কারবারী হিসেবে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ছিল সত্য। তবে মাদকসেবীদেরও টার্গেট করা হয়েছে। যেমন এক মহিলার লাশ পাওয়া গিয়েছে যার গলায় ঝুলিয়ে রাখা মোটা কাগজে লেখা ছিল ‘সে একজন মাদকসেবী, পকেটমার এবং সমাজের জন্য অভিশাপ।’ সন্দেহভাজন যেসব অপরাধীকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের কখনও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। তাই সত্যই তাদের বিরুদ্ধে কী তথ্য প্রমাণ ছিল তা বহুলাংশেই অজ্ঞাত।

দুতের্তের হিসাবে ৩০ থেকে ৪০ লাখ ফিলিপিনো মাদকাসক্ত। তিনি তাদের বিরুদ্ধেও অভিযানে নেমেছেন। তাদের মাদকের নেশা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট দুতের্তে মাদকবিরোধী তার ক্রুসেডকে রাজপথ থেকে প্রসারিত করেছেন ক্ষমতার দুর্গে। ৭ আগস্ট ২০১৬ তিনি প্রকাশ্যে নাম উল্লেখ করে দেড়শ’রও বেশি বিচারক, রাজনীতিক, সিনিয়র সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে, তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত। তিনি তাদের আত্মসমর্পণের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। তার এই আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ও রাজনীতিবিদরা।

চার.

স্বভাবতই রদরিগো দুতের্তের এই বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেশের ও বাইরের মানবাধিকার সংগঠনগুলো। কিন্তু তা তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। তার বক্তব্য হলো, এসব তাত্ত্বিক মানবাধিকার সূত্রগুলো কোথায় ছিল এতদিন? যখন আমেরিকা ও ব্রিটেন ইরাকে লাখ লাখ মানুষ খুন করেছে তখন মানবাধিকার কই ছিল?

এইসব আচরণের বাইরে দুতের্তে খ্যাতি পেয়েছেন তার ঠোটকাঁটা মন্ত্যব্যের জন্য। সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ‘পতিতার সন্তান’ উল্লেখ করে বিতর্কিত হয়েছেন। পোপকেও তিনি ‘বেশ্যার ছেলে’ বলতে দ্বিধা করেননি। আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আলোচিত প্রার্থি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন ‘ধর্মান্ধ উম্মাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

 ফিলিপাইনে পুলিশ বা ঘাতক দল দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা-খুন করার বিষয়ে আমেরিকার মানবাধিকার সংগঠনের নিন্দা শুনে এক প্রেস কনফারেন্সে তিনি ক্ষেপে ওঠেন। বলেন , ‘আমেরিকানরা সেখানে কালোদের গুলি করে হত্যা করছে। আমেরিকা আর ফিলিপাইনের তফাৎ কোথায়? কোনও তফাৎ নেই’। ফিলিপাইনস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে নোংরা ভাষায় অভিধা দিতেও দ্বিধা করেননি। তার এসব আচরণের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে , তিনি জাতিসংঘ থেকে বেরিয়ে আসার হুমকিও দেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে মিটিং করতেও অস্বীকার করেন। তার পরিষ্কার কথা হচ্ছে, এসব কাগুজে মানবাধিকারে আমার আস্থা নেই। তার সুস্পষ্ট ঘোষণা ‘বিচার-বহির্ভূত হত্যা -খুন’ দিয়েই মাদক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে  সর্বাত্মক যুদ্ধ চলবেই।

পাঁচ.

প্রকৃতই জনভোটে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টের এই আচরণ বিস্ময়কর। তদন্ত-বিচার ছাড়াই ‘হত্যা-খুন’ দিয়েই তিনি শাসনকাজ চালাতে চান। আবার তার এই কর্মকাণ্ডে জনগণের একটা বড় অংশ খুশি। এতে বোঝা যায় প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনমানুষের আস্থাও কমছে। প্রকৃতই সুশাসনের অভাবে মানুষ তাৎক্ষণিক উপশম হিসেবে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকেই শ্রেয়তর ভাবছে। অথবা রাজনৈতিক সরকারগুলোর স্বজনপ্রীতি ও অবৈধ ক্ষমতাচর্চা যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে তাও মানুষকে এই সহিংস-অন্যায্য শাসনে উৎসাহিত করছে। ফিলিপাইনের সমাজ-রাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে যে লুটপাট-দুর্নীতি-কুশাসন চলেছে তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে একশ্রেণির জনগণ দুতের্তের এই ‘হত্যা-খুন’ মডেলের শাসনকে বাহবা দিচ্ছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের এই মডেল থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। প্রচলিত সুশাসন তিরোহিত করে আমরা কি এইরকম হত্যা-খুন মডেলকে ভালো বলার সুযোগ তৈরি করবো কিনা সেটাই এখন বিবেচ্য।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
তীব্র তাপে গলছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের কার্পেটিং
তীব্র তাপে গলছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের কার্পেটিং
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ